1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মধ্যমেধার যুগে সাহিত্য ভালোলাগার আবেশ ছড়ায় না

গৌতম হোড়
১৬ এপ্রিল ২০২১

কোনো উপন্যাস তেমন করে ভাবায় না, গল্প পড়ে সচরাচর মন বিবশ হয় না। ভালোলাগা ছড়ায় না। মধ্যমেধার যুগে সৃজনশীলতাও উধাও হচ্ছে।

ছবি: DW/R. Chakraborty

একটা সময় ছিল, যখন আমরা পুজো সংখ্যার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতাম। কবে হাতে আসবে। শীর্ষেন্দু, সুনীল, সমরেশ, রমাপদ চৌধুরী, বানী বসু বা তারও আগে বিমল কর, সমরেশ বসুর উপন্যাস পড়বো। রমানাথ রায়ের গল্প বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। তখন পুজো সংখ্যা নামটা সার্থক ছিল। পুজোর আগে আগে তা প্রকাশিত হতো। সাত থেকে দিন কুড়ি বা খুব বেশি হলে একমাস আগে। এখন সেপ্টেম্বরের শেষ বা অক্টোবরে পুজো হলে পুজোসংখ্যা পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে জুলাই থেকে। তখন শরতের শ-ও নেই। ভরা বর্ষা।

কারণ, এখন পুজো সংখ্যা নিয়ে সেই হুড়োহুড়ি নেই। ফলে বিক্রি করার তাগিদে তিন মাস আগে থেকেই পত্রিকা বের হয়ে যায়। এই ঘটনাই বলে দিচ্ছে, আকর্ষণ কমে যাচ্ছে। মানুষ আর সেই টানটা অনুভব করছে না। আর এই টান কমে যাওয়া মানে, উপন্যাস, গল্প, কবিতা আর তাদের আগের মতো আকর্ষণ করতে পারছে না। আর এখান থেকেই প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি পশ্চিমবঙ্গের লেখক, লেখিকাদের সৃজনশীলতা কমে যাচ্ছে?

এখানে সৃজনশীলতা মানে পাঠক যে লেখার সঙ্গে নিজেকে খুঁজে পাবে। যে লেখায় সে নিজের লড়াই, আশা-আকাঙ্খা, ব্যর্থতা, সাফল্য, একাকীত্বকে খুঁজে পায়। অথবা অন্যের লড়াই তাকে প্রভাবিত করে। সেই লেখা ভাবায়, পথ দেখায়, মন ছুঁয়ে যায়। তা আনন্দ বা  কষ্ট দেয়, চিন্তান্বিত করে। পড়ার দীর্ঘদিন পরেও মনে হয়, একটা লেখা পড়েছিলাম বটে। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, কবি ও পাঠক দেবাশিস ভৌমিকের মতে, ''যে লেখা পড়ছি, ভালো লাগছে বা ঠিকঠাক লাগছে, পড়ার পর তার রেশ চলে যাচ্ছে, সে সব হলো গড়পড়তা লেখা। এখন গড়পরতা লেখাই বেশি। সৃজনশীল লেখা পাই না। এখনকার লেখাগুলোকে স্টিরিওটাইপ লাগে। সব চরিত্রের মধ্যে যেন লেখকই থাকেন।'' শেষ যে লেখা দেবাশিসকে ভাবিয়েছিল, বহুদিন ধরে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছিল, তা সুপ্রিয় চৌধুরীর দ্রোহজ।

সেই সব লেখা হারিয়ে যাচ্ছে। যা টেনে ধরে রাখে পাঠককে। ভাবায়, হাসায়, কাঁদায়, আলোড়িত করে, ভালোলাগা ছড়ায়। মনের মধ্যে একটা আবেশ তৈরি হয়। এখন পড়তে পড়তে কিছুদূর এগিয়ে উৎসাহ হারিয়ে যায়। পাতা উল্টে যাই বা সরিয়ে রেখে দিই। অনেক লেখক এখন ইতিহাসের কাহিনির দিকে ঝুঁকছেন। কেউ ঝুঁকছেন জীবনীর দিকে, আর একটা বড় অংশ থ্রিলারের দিকে। সেই সব লেখা হলো ওই পড়তে পড়তে মনে হয়, ঠিক আছে, কিন্তু ভাবায় না। বানী বসুর গান্ধর্বী বা সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের মল্লারপুর যেমন ভালো লেগেছিল। যেমন তাড়া করে বেড়াত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন, ''ছোট্ট হয়েই আছে/একের, না হয় বহুর, না হয় ভিড়ের বুকের কাছে। একটি ঝিনুক তাকে/জন্ম থেকেই, একটু-আধটু, বাইরে ফেলে রাখে।'' অথবা 'এক দেশে সে মানুষ, যখন অন্য দেশে পোকা/ দেখতে দেখতে গাছভরে ফুল ফুটল থোকায় থোকায়'। এই পদ্য পড়তে পড়তে কী যেন একটা চেপে বসে বুকের ভিতর।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ফেরিঘাট উপন্যাসের নায়ক অমিয় একটা স্বপ্ন দেখত। ফেরিঘাটের। তার মনে হতো, সে একটা চড়ায় বসে আছে। অনেক দূর পর্যন্ত বালিয়াড়ি গড়িয়ে গেছে– আধমাইল-একমাইল-তারপর ঘোলা জল–একটা জেটি–প্রকান্ড নদী দিগন্ত পর্যন্ত। কখনো কখনো রাতের স্টিমারঘাট-কেবল বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে, জেটির গায়ে জলের শব্দ–ওপারে ভীষণ অন্ধকার। এটা পড়ার পর এই স্বপ্ন অনেকদিন তাড়া করে বেরিয়েছে আমায়।

অথবা সেই অমোঘ জীবনানন্দ। ''সকল লোকের মাঝে ব'সে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?'' যতবার পড়েছি বা শম্ভু মিত্রের গলায় আবৃত্তি শুনেছি, ততবারই যেন হৃদয় মুচড়ে জেগে উঠেছে একটা বেদনা। এ তো আমারই কথা। জনকোলাহলের মধ্যে আমি কতবার তো এমনই একা হয়ে যাই। আমার তো তখন সত্যিই ''সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়, সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়/শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়।''

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

এখন এমন ভালোলাগার রেশ পাই না কেন? এ কী শুধু আমারই মনে হয়। না কি, আরো অনেকের এরকম মনে হয়। ফোন তুলি। কথা বলি। লেখক, প্রাক্তন আমলা এবং বাংলা বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক অমিতাভ রায় বললেন, তারও মনে হচ্ছে সৃজনশীল সাহিত্য হচ্ছে না। তার মনে হয়, যবে থেকে সাহিত্য একটা প্রোডাক্ট হয়ে গেছে, তবে থেকে সৃজনশীলতা পিছনের পঙতিতে চলে গেছে। আর এখন সামাজিক মাধ্যমের রমরমার যুগে সকলেই লেখক। সকলেই কবি। সকলেই না কি ভালো লেখেন। ওই চার লাইনের লেখারই এখন দাপট।

বাংলার অধ্যাপক আশিস চক্রবর্তীও মনে করেন, সৃজনশীলতা কমছে। বিশেষ করে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে। আগে জীবনের বৃহত্তর ক্যানভাসকে ধরার চেষ্টা হতো। সেটা এখন আর নেই। মনে হয়, এখন যেন সব সিরিয়ালের জন্য ভেবে লেখা হচ্ছে। বৃহত্তর জীবনকে ধরার চেষ্টা নেই। তাই গণদেবতা আর লেখা হয় না। সব ছোট হয়ে আসছে। মেধার অভাব বা শ্রম দেয়ার ইচ্ছে কমে গেছে সেটাও হতে পারে।

ঠিকই। এখন তো মধ্যমেধার রাজত্ব। সেখানে রাজা-প্রজা-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদ-শিক্ষাবিদ সকলেই মধ্যমেধার। তাই সবকিছুই এখন ছোট্ট হয়েই থাকে। সাহিত্যের সৃজনশীলতাও।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ