কোনো উপন্যাস তেমন করে ভাবায় না, গল্প পড়ে সচরাচর মন বিবশ হয় না। ভালোলাগা ছড়ায় না। মধ্যমেধার যুগে সৃজনশীলতাও উধাও হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
একটা সময় ছিল, যখন আমরা পুজো সংখ্যার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতাম। কবে হাতে আসবে। শীর্ষেন্দু, সুনীল, সমরেশ, রমাপদ চৌধুরী, বানী বসু বা তারও আগে বিমল কর, সমরেশ বসুর উপন্যাস পড়বো। রমানাথ রায়ের গল্প বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। তখন পুজো সংখ্যা নামটা সার্থক ছিল। পুজোর আগে আগে তা প্রকাশিত হতো। সাত থেকে দিন কুড়ি বা খুব বেশি হলে একমাস আগে। এখন সেপ্টেম্বরের শেষ বা অক্টোবরে পুজো হলে পুজোসংখ্যা পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে জুলাই থেকে। তখন শরতের শ-ও নেই। ভরা বর্ষা।
কারণ, এখন পুজো সংখ্যা নিয়ে সেই হুড়োহুড়ি নেই। ফলে বিক্রি করার তাগিদে তিন মাস আগে থেকেই পত্রিকা বের হয়ে যায়। এই ঘটনাই বলে দিচ্ছে, আকর্ষণ কমে যাচ্ছে। মানুষ আর সেই টানটা অনুভব করছে না। আর এই টান কমে যাওয়া মানে, উপন্যাস, গল্প, কবিতা আর তাদের আগের মতো আকর্ষণ করতে পারছে না। আর এখান থেকেই প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি পশ্চিমবঙ্গের লেখক, লেখিকাদের সৃজনশীলতা কমে যাচ্ছে?
এখানে সৃজনশীলতা মানে পাঠক যে লেখার সঙ্গে নিজেকে খুঁজে পাবে। যে লেখায় সে নিজের লড়াই, আশা-আকাঙ্খা, ব্যর্থতা, সাফল্য, একাকীত্বকে খুঁজে পায়। অথবা অন্যের লড়াই তাকে প্রভাবিত করে। সেই লেখা ভাবায়, পথ দেখায়, মন ছুঁয়ে যায়। তা আনন্দ বা কষ্ট দেয়, চিন্তান্বিত করে। পড়ার দীর্ঘদিন পরেও মনে হয়, একটা লেখা পড়েছিলাম বটে। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, কবি ও পাঠক দেবাশিস ভৌমিকের মতে, ''যে লেখা পড়ছি, ভালো লাগছে বা ঠিকঠাক লাগছে, পড়ার পর তার রেশ চলে যাচ্ছে, সে সব হলো গড়পড়তা লেখা। এখন গড়পরতা লেখাই বেশি। সৃজনশীল লেখা পাই না। এখনকার লেখাগুলোকে স্টিরিওটাইপ লাগে। সব চরিত্রের মধ্যে যেন লেখকই থাকেন।'' শেষ যে লেখা দেবাশিসকে ভাবিয়েছিল, বহুদিন ধরে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছিল, তা সুপ্রিয় চৌধুরীর দ্রোহজ।
প্রসঙ্গ : পাঠকের রুচি ও অগ্রাধিকার
করোনাকালের বইমেলার ‘বেস্টসেলার’ দিয়ে কি পাঠকের সার্বিক রুচি এবং বই কেনায় পরিবর্তনের ধারা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়? তরুণ পাঠক এখন কী বেশি পড়ছেন? কেন পড়ছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইংরেজিতে দক্ষতা এখন অনেক জরুরি
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি’র সাংবাদিক স্যাম জাহানের মতে, ‘‘বিগত এক দশকের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তরুণদের কাছে শিল্প-সাহিত্য চর্চার চেয়ে ইংরেজি শেখাটা এখন বেশি লাভজনক বিনিয়োগ৷ বিপুল সংখ্যক মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে এখন দেশত্যাগে আগ্রহী৷ বিদেশে স্থায়ী হওয়ার জন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়া জরুরি, তাই সেদিকেই তাদের মনোযোগ বেশি৷’’
ছবি: Privat
অনিশ্চয়তার মধ্যে সাহিত্য-চর্চা সম্ভব না
ইকমার্স নির্বাহী সামিউর রহমান বলেন, ‘‘তরুণদের বই পড়ায় আগ্রহ কমছে, আমি তা মনে করি না৷ গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যে আত্মোন্নয়ন এবং ইংরেজি শেখার চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে৷ অনেক দেশের তুলনায় আমাদের ইংরেজি শিক্ষার মান অত্যন্ত দুর্বল৷ আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত৷ সুতরাং এই অবস্থায় সাহিত্য-চর্চা শুধু নাটক-সিনেমাতে সম্ভব, বাস্তবে নয়৷’’
ছবি: Privat
বিষয়টি দ্বান্দ্বিক এবং অশনিসংকেত
লেখক ও আলোকচিত্রী শাহরিয়ার খান শিহাব বলেন, তরুণ সমাজ যে-কোনো বই পড়ছে বিষয়টি আনন্দের৷ তবে বইমেলায় কেন সৃষ্টিশীল রচনা সর্বোচ্চ বিক্রির আসনে নেই, সেখানে কেন একটি ভাষা শিক্ষার বই, এটি একটি দ্বন্দ্বপূর্ণ আলাপ৷ অন্তরালের কারণ হিসেবে বলা যায়, এখনকার লেখকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে লেখনীর মান যেমন তলানিতে যাচ্ছে, তেমনি পাঠ্যপুস্তকের বাইরের মৌলিক বইয়ের প্রতিও তরুণদের অনীহা বাড়ছে, এটা আশঙ্কাজনক৷
ছবি: Privat
সৃষ্টিশীল বই পড়ার সুযোগ কম
ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মাশুক শাহরিয়ার বলেন, ‘‘আমার আশেপাশের সবাই এখন পড়াশোনা, চাকরি এবং ক্যারিয়ার নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ তীব্র প্রতিযোগিতার এই যুগে পাঠ্যপুস্তক পড়ার পর যেটুকু সময় হাতে থাকে, তা আমরা অনলাইনে দেই৷ আমি নিজেই আগের মতো গল্প বা উপন্যাসের বইয়ের প্রতি সেভাবে আগ্রহ অনুভব করি না৷ বিগত কয়েক বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখন মানুষ বই কিনছে মনের খোরাক মেটাতে নয়, প্রয়োজনের তাগিদে৷’’
ছবি: Privat
বই পড়া বাদেও এখন অপশন অনেক
ব্যাংক কর্মরত ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের সময়ে আমরা তিন গোয়েন্দা, কমিকস এসব বই পড়তাম, কারণ, আমাদের অপশন ছিল না৷ এখন ছেলেমেয়েদের ঘরে বসে সময় কাটানোর মাধ্যমের অভাব নেই৷ সৃষ্টিশীল বই-বিমুখতার পিছনে অভিভাবকরাও দায়ী, তারা সন্তানদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়তে দিতে আগ্রহী না৷ যেহেতু এখন সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা বেশি, ইংরেজিতে দক্ষতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সুতরাং এ ধরনের বইয়ের প্রতি ঝোঁকটা স্বাভাবিক৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মৌলিক চাহিদা সবার আগে
চাকরিপ্রত্যাশী স্থপতি এনায়েত হোসেন বলেন, ‘‘একজন মানুষ শিল্প-সাহিত্যের দিকে তখনই মনোনিবেশ করবে যখন তার মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে,পেটভরা থাকবে৷ তরুণ সমাজ এখন হতাশায় ভুগছে, বিভিন্ন দিকে তারা ব্যর্থ৷ এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা অনুপ্রেরণামূলক বই অথবা ইংরেজির মতো আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে৷ তরুণদের বেকারত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে এইসব সাহিত্য চর্চা এখন বিলাসিতারই নামান্তর বলে আমি মনে করি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মানুষ বই কিনছে নিতান্তই প্রয়োজনে
প্রতীক প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার নূর ই প্রতীক বলেন, ‘‘মানুষ এখন নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বই কেনে না৷ বিষয়গুলো মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার সাথে কিছুটা জড়িত৷ তবে ইংরেজি ভাষা বা অনুপ্রেরণামূলক বই বেস্ট সেলার হচ্ছে মানে যে অন্যান্য বই বিক্রি একদম কম হয়, বিষয়টা তা-ও না৷ মানুষ বই পড়ছে, তবে সেসব বই বিক্রির তথ্য অতটা আলোকপাত হয় না৷ কে জানে, পরের বছরে হয়ত কোনো সৃষ্টিশীল বই সর্বোচ্চ বিক্রির জায়গা দখল করতেও পারে৷’’
ছবি: Privat
সংখ্যা সবকিছু যাচাইয়ের মাপকাঠি নয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, ‘‘দেখা যায় একটি ‘গম্ভীর’ বইয়ের তুলনায় একটি সাধারণ বই অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে৷ সব বইয়ের পাঠক যে সবাই না, এটাও বুঝতে হবে৷ যা প্রয়োজনে কেনা হয়, সেটা দিয়ে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি মাপা কঠিন৷ তরুণরা বই পড়ছে এবং কিনছে৷ গতবছর প্রায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়, যার অধিকাংশ ক্রেতা এই তরুণেরা৷ যুগ ডিজিটাল হচ্ছে, কিন্তু বই পড়া থেমে নেই৷’’
ছবি: privat
তরুণ প্রজন্ম এখন বাস্তববাদী এবং সচেতন
একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর পরামর্শক মোস্তফা ফেরদৌস ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘‘আমার আশেপাশের তরুণরা এখন চাকরি, ব্যবসা, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন৷ মহামারির কারণে সবাই চাচ্ছে ঘরে বসেই নিজেদের দক্ষতাকে শাণিত করতে৷ তবে আমি দেখেছি যারা প্রকৃত পাঠক, তারা বই কিনছেই৷ কিন্তু বই পড়ার আগ্রহ একদম কম দেখতে পাচ্ছি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রজন্মের মাঝে, যারা ডিজিটাল দুনিয়ায় নিজেদের হারিয়েই ফেলছে বলা চলে৷’’
ছবি: privat
9 ছবি1 | 9
সেই সব লেখা হারিয়ে যাচ্ছে। যা টেনে ধরে রাখে পাঠককে। ভাবায়, হাসায়, কাঁদায়, আলোড়িত করে, ভালোলাগা ছড়ায়। মনের মধ্যে একটা আবেশ তৈরি হয়। এখন পড়তে পড়তে কিছুদূর এগিয়ে উৎসাহ হারিয়ে যায়। পাতা উল্টে যাই বা সরিয়ে রেখে দিই। অনেক লেখক এখন ইতিহাসের কাহিনির দিকে ঝুঁকছেন। কেউ ঝুঁকছেন জীবনীর দিকে, আর একটা বড় অংশ থ্রিলারের দিকে। সেই সব লেখা হলো ওই পড়তে পড়তে মনে হয়, ঠিক আছে, কিন্তু ভাবায় না। বানী বসুর গান্ধর্বী বা সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের মল্লারপুর যেমন ভালো লেগেছিল। যেমন তাড়া করে বেড়াত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন, ''ছোট্ট হয়েই আছে/একের, না হয় বহুর, না হয় ভিড়ের বুকের কাছে। একটি ঝিনুক তাকে/জন্ম থেকেই, একটু-আধটু, বাইরে ফেলে রাখে।'' অথবা 'এক দেশে সে মানুষ, যখন অন্য দেশে পোকা/ দেখতে দেখতে গাছভরে ফুল ফুটল থোকায় থোকায়'। এই পদ্য পড়তে পড়তে কী যেন একটা চেপে বসে বুকের ভিতর।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ফেরিঘাট উপন্যাসের নায়ক অমিয় একটা স্বপ্ন দেখত। ফেরিঘাটের। তার মনে হতো, সে একটা চড়ায় বসে আছে। অনেক দূর পর্যন্ত বালিয়াড়ি গড়িয়ে গেছে– আধমাইল-একমাইল-তারপর ঘোলা জল–একটা জেটি–প্রকান্ড নদী দিগন্ত পর্যন্ত। কখনো কখনো রাতের স্টিমারঘাট-কেবল বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে, জেটির গায়ে জলের শব্দ–ওপারে ভীষণ অন্ধকার। এটা পড়ার পর এই স্বপ্ন অনেকদিন তাড়া করে বেরিয়েছে আমায়।
অথবা সেই অমোঘ জীবনানন্দ। ''সকল লোকের মাঝে ব'সে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?'' যতবার পড়েছি বা শম্ভু মিত্রের গলায় আবৃত্তি শুনেছি, ততবারই যেন হৃদয় মুচড়ে জেগে উঠেছে একটা বেদনা। এ তো আমারই কথা। জনকোলাহলের মধ্যে আমি কতবার তো এমনই একা হয়ে যাই। আমার তো তখন সত্যিই ''সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়, সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়/শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়।''
এখন এমন ভালোলাগার রেশ পাই না কেন? এ কী শুধু আমারই মনে হয়। না কি, আরো অনেকের এরকম মনে হয়। ফোন তুলি। কথা বলি। লেখক, প্রাক্তন আমলা এবং বাংলা বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক অমিতাভ রায় বললেন, তারও মনে হচ্ছে সৃজনশীল সাহিত্য হচ্ছে না। তার মনে হয়, যবে থেকে সাহিত্য একটা প্রোডাক্ট হয়ে গেছে, তবে থেকে সৃজনশীলতা পিছনের পঙতিতে চলে গেছে। আর এখন সামাজিক মাধ্যমের রমরমার যুগে সকলেই লেখক। সকলেই কবি। সকলেই না কি ভালো লেখেন। ওই চার লাইনের লেখারই এখন দাপট।
বাংলার অধ্যাপক আশিস চক্রবর্তীও মনে করেন, সৃজনশীলতা কমছে। বিশেষ করে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে। আগে জীবনের বৃহত্তর ক্যানভাসকে ধরার চেষ্টা হতো। সেটা এখন আর নেই। মনে হয়, এখন যেন সব সিরিয়ালের জন্য ভেবে লেখা হচ্ছে। বৃহত্তর জীবনকে ধরার চেষ্টা নেই। তাই গণদেবতা আর লেখা হয় না। সব ছোট হয়ে আসছে। মেধার অভাব বা শ্রম দেয়ার ইচ্ছে কমে গেছে সেটাও হতে পারে।
ঠিকই। এখন তো মধ্যমেধার রাজত্ব। সেখানে রাজা-প্রজা-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদ-শিক্ষাবিদ সকলেই মধ্যমেধার। তাই সবকিছুই এখন ছোট্ট হয়েই থাকে। সাহিত্যের সৃজনশীলতাও।