1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মনরো ডকট্রিন ও বিপরীতে ইউরোপকে ব্যতিব্যস্ত রাখার কৌশল

কাজী আলিম-উজ-জামান
১৮ মার্চ ২০২২

যুগে যুগে পরাশক্তিগুলো পৃথিবীজুড়ে শক্তিমত্তা দেখিয়েছে নিজেদের নানা মতবাদ ও তত্ত্বের মোড়কে৷ অন্য দেশে কখনো কখনো বিনা প্ররোচনায় সামরিক হামলা চালিয়ে সেই দেশের নারী, শিশুসহ নিরপরাধ মানুষ হত্যা করতে তাদের হাত কখনো কাঁপেনি৷

EU Flaggen
ছবি: Alexey Vitvitsky/SNA/imago images

কেবল মানুষ হত্যা নয়, তারা চেয়েছে ‘শত্রু দেশটি'র ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতিসমেত তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে৷ এরকম বহু একতরফা হামলার সাক্ষী এই বিশ্ব৷

সেসব তত্ত্ব বা মতবাদের অন্তর্নিহিত কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে কেবল আমাদের বিজয় পতাকা উড়বে, তোমাদের নয়৷ আমাদের দিকে চোখ রাঙিয়েছ তো মরেছো৷ তুমি শ্বাস গ্রহণ করতে পারবে, তবে প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হতে হবে আমাদের নাম৷ তোমাকে আমরা করুণা করতে পারি, তবে সমকক্ষ হতে দেবো না৷

মনরো ডকট্রিন বা মনরো মতবাদ নামে একটি তত্ত্বের কথা এখানে উল্লেখ করতে পাারি৷ আজ থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে, ১৮২৩ সালের ২ ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো কংগ্রেসের সপ্তম স্টেট অব ইউনিয়ন ভাষণে এই তত্ত্ব বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছিলেন৷ এর মোদ্দা কথা হচ্ছে, উত্তর বা দক্ষিণ অ্যামেরিকার সব দেশই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবলয়ের অন্তর্গত৷ কেউ যদি এই গোলার্ধের কোনো দেশের ওপর নজর দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে এক হাত দেখে নেওয়ার সব আইনগত অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের থাকবে৷

ইতিহাস বলে, মনরো ডকট্রিনে মূলত ইউরোপের দেশগুলোর দিকেই আঙুল তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ লাতিন আমেরিকার অনেক দেশই ছিল ইউরোপের কলোনি৷ প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের আগ্রাসন থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করতেই ওই তত্ত্ব খাড়া করেন প্রেসিডেন্ট মনরো৷ এই তত্ত্ব প্রয়োগ করে ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে মার্কিন প্রশাসন অন্তত ৪১ বার লাতিন আমেরিকায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অযাচিত হস্তক্ষেপ চালায়৷

বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কতৃর্ত্ববাদী শাসকেরা বলার চেষ্টা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তার নিজের জন্য নয়, সারা ‘মুক্ত বিশ্বের' স্বার্থেই দরকার৷ ২০০৩ সালে ইরাক হামলার আগে সেই তত্ত্বের পুরিয়া বিশ্ববাসীকে গুলে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন বুশ জুনিয়র ও টনি ব্লেয়ার জুটি৷

কখনো কখনো এই তত্ত্বের পক্ষে সমর্থনও পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ ১৯০২ সালে ক্যানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইলফ্রিড লরিয়ার স্বীকার করেন, মনরো ডকট্রিন তার দেশের নিরাপত্তার জন্য দরকার৷ পক্ষে–বিপক্ষে এরকম বহু উদাহরণ আছে৷

বারাক ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরি একবার বলেছিলেন, মনরো ডকট্রিনের আর প্রয়োজন নেই৷ কিন্তু পরবর্তী সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার এই মতবাদ ফিরিয়ে আনেন৷ রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আবার যেন ফিরে এসেছে এই তত্ত্ব৷ সেটা কিভাবে?

২.

ইউক্রেনে রুশ হামলা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়৷

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে আরেকটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন৷ ‘শত্রু' রাশিয়ার পাশেই ‘ইউক্রেন বন্ধু' পেয়ে গেছে পশ্চিমারা৷ একইভাবে চীনের পাশে পেয়েছে তাইওয়ানকে৷ আবার ‘শত্রু' যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রাশিয়া ও চীনের আছে ‘কিউবা বন্ধু'৷ তবে চীন ও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিউবাকে কম ব্যবহার করে৷ বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো যেন প্রতিনিয়তই তাইওয়ান ও ইউক্রেনকে দিয়ে চীন ও রাশিয়াকে প্ররোচিত করতে থাকে৷ কারণ যুদ্ধ শুরু হলেই তাদের সুবিধা৷ বিপুল ব্যয়ে তৈরি অস্ত্রগুলো বিক্রি করা যায়৷ রাজস্ব আয় ফুলেফেঁপে ওঠে৷ এর মধ্য দিয়ে কিছু মানুষ হয়ত মরলো, কিছু স্থাপনা ধংস হলো, এর বেশি কিছু তো নয়!

অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা মোটাদাগে পশ্চিমাদের সেই ইচ্ছারই প্রতিফলন৷

এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের আছে ন্যাটো সামরিক জোট৷ পশ্চিমারা নিঃসন্দেহে রাশিয়াকে হুমকি মনে করে৷ অনেকেই রাশিয়াকে ‘খাঁটি ইউরোপীয়' দেশ বলেও স্বীকার করতে চান না৷ 

অপরদিকে রাশিয়া মনে করে, আটলান্টিকের দুই পারের দেশগুলোই তার প্রকৃত শত্রু, তার অস্তিত্বের পক্ষে ক্ষতিকারক৷ যে কোনোভাবে এদের ঠেকিয়ে রাখতে হবে৷ ন্যাটো এদেরই সামরিক জোট৷ তার প্রতিবেশী ইউক্রেন এই ন্যাটোরই সদস্যপদ পেতে চায়৷ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পেলে সীমান্তে রাশিয়ার দিকে তাক করে ক্ষেপনাস্ত্র বসাতে পারবে৷ অর্থাৎ, রাশিয়া মনে করে, ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য পদ প্রাপ্তির অর্থ  হচ্ছে, শত্রুকে পথ দেখিয়ে বাড়িতে ডেকে আনা৷ সুতরাং এটা কোনোভাবেই করতে দেওয়া যাবে না৷ ইউক্রেনের সাবেক কৌতুক অভিনেতা প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কিকে থামাতে হবে, একটা চরম শিক্ষাও দিতে হবে৷ অতএব চালাও হামলা৷

এভাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষে তিন দিক থেকে ইউক্রেনে অভিযান শুরু করেন ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন৷ যে যুদ্ধ এখন চলছে৷ নারী, শিশুসহ অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয়েছে৷ নেটফ্লিক্স দেখা, ব্লন্ড চুলের ইউক্রেনীয়রা আগুনে পুড়তে থাকা আপন গৃহকোণের দৃশ্য বুকে চেপে রেখে পোল্যান্ডগামী ট্রেনে চড়ে বসছেন৷ জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে জুটেছে তাদের আশ্রয়৷ ভাগ্য ভালো, সিরীয় শরণার্থীদের মতো সীমান্তে কাঁটাতারে তীব্র শীতের মধ্যে দিনের পর দিন আটকে থাকতে হয়নি, পানির গভীরে তলিয়ে যেতে হয়নি ৫ বছরের আয়লান কুর্দির মতো কোনো শিশুকে৷ তারা আশ্রয় পেয়েছেন কিছুটা সম্মানের সঙ্গে, কেউ কেউ তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে গোলাপও৷

৩.

একটু আগে মনরো ডকট্রিনের কথা বলছিলাম৷ ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আবারো যেন ফিরে এসেছে কথিত এই তত্ত্ব৷ শুরুতে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোনো কিছু না বলার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন৷ আস্তে আস্তে খুলে পড়ছে ঝানু এই রাজনীতিকের টিকি৷ পুতিনকে বলেছেন যুদ্ধাপরাধী৷ ঠান্ডা মাথার পুতিনও পাল্টা তীর ছুঁড়েছেন৷ একদিকে কিয়েভ, খারকিভ, মারিউপোলের মতো রোমান্টিক সব নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে, অন্যদিকে চলছে উত্তেজনা আরো বাড়ানোর সব আয়োজন৷

সেগুলো কি কি একটু দেখে নেওয়া যাক৷

ক. ইউক্রেনকে ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ দেওয়া হবে স্টিংগার নামে ৮০০টি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা৷ ভূমি থেকে আকাশে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম দুই হাজার জ্যাভলিন ক্ষেপনাস্ত্র৷ আরো অন্যসব ভারী অস্ত্র তো আছেই৷

খ.যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু যুক্তরাজ্য ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইউক্রেনের বন্ধু রাষ্ট্র পোল্যান্ডে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘স্কাই সেভার' মোতায়েন করবে৷ পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ন্যাটো যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার অংশ হিসেবেই স্কাই সেভার মোতায়েন করা হচ্ছে৷

গ. যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ছাড়াও ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশ৷

কাজী আলিম-উজ-জামান, গবেষকছবি: privat

ঘ. পুরোপুরি অস্ত্রের খোঁজে নেমে গেছে ইউরোপের দেশগুলো৷ ৩৫টি এফ ৩৫ যুদ্ধবিমান কিনতে যুক্তরাষ্ট্রের লকহেড মার্টিন কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে জার্মা৷নি৷ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে রিপার ড্রোন কিনতে চাচ্ছে পোল্যান্ড৷

এসব তথ্য দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না লাভের গুড় কোন পিঁপড়া খাওয়ার জন্য ওঁত পেতে আছে৷ ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইউরোপকে ব্যতিব্যস্ত রেখে অস্ত্র বিক্রি করে বিপুল পরিমাণে ডলার কামানোর এক অতি চমৎকার কৌশল বের করেছেন জো বাইডেন৷ এ যুদ্ধে রাশিয়া হারলে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান, জিতলেও তার ক্ষতি নেই৷ আসছে পরমাণু অস্ত্র হামলার আশঙ্কার কথা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা৷ সম্ভবত, করোনা– উত্তর বিশ্বে এ যুদ্ধে মানুষ ছাড়া আর কারো পরাজয় হবে না৷

৪.

কিন্তু এ যুদ্ধের একটা বড় প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে পড়া শুরু হয়েছে, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে৷ সামনে আরো দীর্ঘস্থায়ী ছায়া ফেলবে এই যুদ্ধ৷ রাশিয়া ও ইউক্রেনের গমের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো সংকটে পড়ে যাবে৷ বেড়ে যাবে খাদ্যপণ্যের দাম৷ আফ্রিকার অনেক পরিবারে চুলা জ্বলবে না হয়ত৷ জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে৷ সামনে আরো শোচনীয় অবস্থার জন্য তৈরি থাকতে হবে৷

অস্ত্র ক্রয়ে বেশি টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় ধনী দেশগুলোর সহায়তা কমে যাবে৷ আরো অপুষ্ট হবে জাতির ভবিষ্যত শিশুরা৷ দুর্বল হয়ে পড়বে টিকা কার্যক্রম৷ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনে যে বাজেট বরাদ্দ থাকে, তা আরো সীমিত হয়ে পড়বে৷ বাড়তে থাকবে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা৷ সার্বিকভাবে গবেষণায় মনোযোগ কমে যাবে৷

সমস্ত বিকল্পের জন্য আগামী দিনগুলোতে প্রস্তুত থাকতে হবে বিশ্বকে৷ এক সময় হয়ত বিকল্পও সীমিত হয়ে পড়বে৷ তখন আসবে বিকল্পেরও বিকল্প৷

এই মুহূর্তে কবীর সুমনের একটা গানের কথা খুব মনে আসছে৷ গানটি মনে মনে যেন আওড়াচ্ছি, ‘বাহবা সাবাস বড়দের দল এই তো চাই /ছোটরা খেলবে আসুন আমরা বোমা বানাই৷'

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ