ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে তত শঙ্কা বাড়ছে৷ ভোটার থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ সবার মনেই প্রশ্ন ভোট দিতে পারবেন কীনা৷ নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলছেন, মানুষের মনের ভয় দূর করার মেকানিজম তাদের কাছে নেই৷
বিজ্ঞাপন
সপ্তাহ পেরুলেই ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন৷ চলছে প্রার্থীদের প্রচার৷ পেস্টার আর নানা প্রতীকে ছেয়ে গেছে নগরী৷ তারপরও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা কাটেনি৷ অনেকেরই মনে প্রশ্ন ‘ভোট দিতে পারবেনতো'? জবাবে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে৷ যে ভয়ের কথা বলা হচ্ছে তা মনের ভয়৷
শুক্রাবাদের দোকানদার জামাল হোসেন ওই এলাকারই ভোটার৷ তিনি ভোট দিতে চান৷ দক্ষিণ সিটিতে তার পছন্দের মেয়র প্রার্থী আছেন, আছেন কাউন্সিলর প্রার্থী৷ তাদের জয়ের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী৷ তারপরও তার প্রশ্ন, ‘‘ভোট কি দিতে পারব?''
জামাল হোসেন
কেন এই শঙ্কা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আগেতো ভোট দিতে পারি নাই৷ ঘুমিয়ে ভোট দিয়েছি৷ ভোট দিতে গিয়ে শুনি আগেই আমার ভোট দেয়া হয়ে গেছে৷ এরকম ঘটনা একবার নয়, দুইবার হয়েছে৷ এবার এখন পর্যন্ত প্রচার প্রচারণা ভালোই হচ্ছে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটের একই অবস্থা হবে বলে মনে হয়৷''একই রকম শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আরো অনেকে৷
গাবতলীতে প্রচার কার্যক্রমের সময় ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ওপর হামলার ঘটনা ছাড়া এখন পর্যন্ত বড় ধরনের সংঘাতের অভিযোগ পাওয়া যায়নি৷ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর প্রার্থীদের পোস্টার আছে৷ যদিও শুরুর দিকে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে পোস্টার লাগাতে না দেয়া ও ছিড়ে ফেলার অভিযোগ ছিল৷ তবে এই সহাবস্থান কতদিন বজায় থাকবে তা নিয়েও সন্দেহ আছে৷
সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘‘প্রচার প্রচারণা চলছে৷ সবাই মাঠে আছে৷ কিন্তু তার মধ্যেইওতো তাবিথ আউয়ালের ওপর হামলা হয়েছে৷ নির্বাচন কমিশনকেতো কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখছি না৷ আচরণবিধিও লঙ্ঘন হচ্ছে৷ কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷''
হাফিজউদ্দিন খান
তবে নির্বাচন কমিশন বলছে নির্বাচনের মাঠ থেকে তারা এখনো বড় কোনো অভিযোগ পায়নি৷ মাঠে প্রার্থীদেরও অবশ্য প্রচারে আগ্রহের কমতি নেই৷ এই সুযোগে ঢাকায় বিএনপি ও তাদের অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীরাও এখন প্রকাশ্যে আসতে পারছেন৷ ডেমরা এলাকায় এমন কয়েকজনকে দেখা গেছে যারা দীর্ঘদিন গ্রেপ্তার হয়রানির ভয়ে এলাকায় আসার সুযোগ পাননি৷ উত্তর বাড্ডায় ঘুরেও এমন নেতা-কর্মীদের পাওয়া গেছে৷ শুরুতে তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক থাকলেও আপাতত তা অনেকটাই কেটে গেছে৷ ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে নির্বাচন কমিশন৷
তবে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে তত শংকা বাড়ছে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান৷ তিনি বলেন, ‘‘যতই দিন যাচ্ছে নির্বাচনে উদ্বেগের উপাদানগুলো বাড়ছে৷ প্রতিনিয়ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সংকুচিত হচ্ছে৷ তাই নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক হওয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ বাড়ছে৷''
তাঁর মতে, ‘‘নির্বাচন কমিশন ব্যর্থতা ও অবৈধতার অনেক নজির রেখেছে৷ আর কমিশনের মধ্যেই নানা মত আছে৷ তারপরও আমি আশা করব এবার তারা যদি ভালো কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারে তাহলে কিছুটা হলেও তাদের ইমেজ পুনরুদ্ধার হবে৷''
রফিকুল ইসলাম
তবে নির্বাচন কমিশন সেই দায়িত্ব পালন করবে এমনটা আশা করেন না হাফিজউদ্দিন খান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার নিজেরও এই নির্বাচন কমিশনের ওপর কোনো আস্থা নাই৷ তাদের দক্ষতা, নিরপেক্ষতার ওপর আমার কোনো আস্থা নাই৷ তাই আমিও নির্বাচন নিয়ে ভয়ের মধ্যে আছি৷ তারা অতীতে তাদের দায়িত্ব পালন করে নাই৷ হঠাৎ করে তারা ভালো হয়ে যাাবে এটা আশা করা যায় না৷'
এর জবাবে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘ঢাকা শহরে বা বাংলাদেশে সবাই নির্ভয়ে চলাফেরা করছেন৷ অফিস আদালত কাজকর্ম সমানে করছেন৷ বাজারে যাচ্ছেন, ব্যবসা করছেন৷ কিন্তু ভোট দেয়ার ব্যাপারে বলছেন আমি ইনসিকিউরড ফিল করছি৷ এখন আমরা কী করতে পারি৷ আমরা কী করলে সিকিউওরড ফিল করবেন৷ সেই ক্ষমতা আমাদের আছে কিনা৷ ওই সামর্থ্য আমাদের আছে কিনা৷ এটা নিশ্চিত তাহলে মনের ভয়৷ এখন মনের ভয় দূর করার কোনো মেকানিজম আমাদের কাছে নাই৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি৷ ফিজিক্যালি যাতে কিছু না হয় তার নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছি৷ আপনাদেরকে বলব আপনারা নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যান৷ আপনি নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন৷ এই নিশ্চয়তা আমরা দিচ্ছি৷''
ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষা
আগামী এক ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন৷ সংসদ নির্বাচন ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কে এটিকে নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন অনেকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
তারিখ নিয়ে নাটক
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের জন্য ২২ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন৷ নির্বাচনের তারিখ ছিল ৩০ জানুয়ারি৷ কিন্তু সেদিন সরস্বতী পূজা থাকায় আপত্তি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে৷ শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও৷ প্রথমে অনড় থাকলেও শেষ পর্যন্ত গত ২১ জানুয়ারি নতুন তারিখ ঘোষণা করে কমিশন৷ পরিবর্তীত তারিখ অনুযায়ী নির্বাচন হবে এক ফেব্রুয়ারি৷
ছবি: DW/A. Mahmud Ove
উত্তরে ভোট
উত্তরে সাধারণ ওয়ার্ড সংখ্যা মোট ৫৪টি৷ সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৮টি৷ মোট ভোটকেন্দ্র রয়েছে এক হাজার ৩১৮টি, যাতে রয়েছে সাত হাজার ৮৪৬ টি কক্ষ৷ মোট ভোটার রয়েছেন ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন৷ এর মধ্যে ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৬৭ জন পুরুষ আর ১৪ লাখ ৬০ হাজার ৭০৬ জন নারী৷
ছবি: bdnews24.com
দক্ষিণে ভোট
দক্ষিণে মোট সাধারণ ওয়ার্ড রয়েছে ৭৫টি৷ আছে ২৫টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড৷ এক হাজার ১৫০ টি ভোটকেন্দ্রে মোট কক্ষ ছয় হাজার ৫৮৮টি৷ পুরুষ ভোটার রয়েছেন ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪১ জন আর নারী ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৩ জন৷ মোট ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন৷
ছবি: bdnews24.com
আচরণবিধি
মনোনয়নপত্র জমার দিন থেকে প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে৷ রিটার্নিং কর্মকর্তারা কড়াকড়ির কথা বললও অনেকটা ‘নির্বিকার’ ছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
ইভিএম বিতর্ক
প্রধান নির্বাচন কমিশন শুরুতে বলেছিলেন, যদি সব দল না চায় তাহলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে না৷ তবে পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেয়, সব কেন্দ্রেই ভোট হবে ইভিএমে৷ যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন প্রার্থী আপত্তি জানিয়ে আসছে৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
সিইসির আশ্বাস
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘‘নির্বাচনের কালচারটা অনেকদিন ধরেই এরকম নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল৷ নির্বাচনের কালচার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি৷ ইভিএম যদি দাঁড় করাতে পারি, তাহলে কারো ভোট কেউ দিতে পারবে না৷’’
ছবি: DW/M. M. Rahman
পোস্টার
নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকাকে এখন পোস্টারের নগরী বলা যায়৷ কিন্তু এসব পোস্টারের অধিকাংশই মোড়ানো ক্ষতিকর পলিথিনে৷ যা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট৷ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় হাই কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বুধবার ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় লেমিনেটেড পোস্টার ছাপা ও প্রদর্শন বন্ধের এ নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করে৷
ছবি: Imago/MD Mehedi Hasan
প্রচারে হামলা
বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথের প্রচারে হামলার ঘটনা ঘটে৷ গাবতলীর পর্বতার কলাবাজার এলাকায় মঙ্গলবার জনসংযোগে নামলে তিনি ও তার কর্মীরা হামলার শিকার হন৷ তাবিথ অভিযোগ করেছেন প্রতিপক্ষ আতিকুলের লোকজনই হামলায় জড়িত৷ জবাবে আতিকুল তার এই মন্তব্যকে ছেলেখেলা হিসেবে অভিহিত করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
তথ্য গোপনের অভিযোগ
উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের বিরুদ্ধে হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ ওঠে৷ সুইডেনভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদনে তাবিথ সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি এনএফএম এনার্জি (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেডের মালিকানায় রয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে৷ হলফনামায় ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার দেখালেও এই প্রতিষ্ঠানের নাম তিনি উল্লেখ করেননি৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
নৌকা এগিয়ে চলবে: আতিক
ঢাকা উত্তরে আতিকুল ইসলাম মেয়র প্রার্থী হিসেবে বলেন, ‘‘আমরা আশা করছি, এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে৷ … নৌকার কোনো ব্যাক গিয়ার নাই৷ নৌকা এগিয়ে চলবে৷’’
ছবি: Sazzad Hossain
ঢাকাবাসীর জন্য নবসূচনা: তাপস
আওয়ামী লীগ প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘‘আমি আশা করি, ঢাকাবাসীর জন্য একটি নবসূচনা করতে পারব৷ … আমরা সব সময় চেষ্টা করব নির্বাচন যেন সুষ্ঠু এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়৷ ঢাকাবাসী যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই নির্বাচনে ভোট দেয়৷’’
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকব: তাবিথ
উত্তরে বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘‘একটা বিতর্কিত নির্বাচন অতীতে হয়েছে৷ আর বিতর্ক না বাড়িয়ে ইভিএমে নির্বাচন করা যাবে না৷ … আমরা অত্যন্ত সিরিয়াস৷ নির্বাচনে যত সমস্যাই আসুক, আমরা সবগুলোকে অতিক্রম করে চেষ্টা করব, এগিয়ে যেতে৷ শেষ পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকব৷’’
ছবি: bdnews24.com
নির্বাচন কমিশনের দ্বিতীয় সুযোগ: ইশরাক
দক্ষিণের বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন বলেন, ‘‘এই নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকাবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছে৷ ক্রান্তিকাল চলছে, কোনো গণতন্ত্র নেই, ভোটের অধিকার নেই৷ সবাইকে নিয়ে আমরা এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করব৷ …আস্থা অর্জনে নির্বাচন কমিশনের কাছে এটি দ্বিতীয় সুযোগ৷’’