সরকারের মন্ত্রিসভার ৫২ সদস্য একযোগে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পর তাঁদের সাংবিধানিক অবস্থান কী, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক৷ আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, মন্ত্রীদের পদত্যাগ সাংবিধানিক নয়, আনুষ্ঠানিক৷
বিজ্ঞাপন
মন্ত্রিসভার ৫২ জন সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একযোগে পদত্যাগপত্র জমা দেন সোমবার৷ নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্যই এই প্রক্রিয়া৷ কিন্তু মন্ত্রীরা এখানো তাঁদের পদে বহাল আছেন৷ গাড়িতে ব্যবহার করছেন জাতীয় পতাকা৷ তাঁরা মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত অফিসও করছেন৷ এই নিয়ে এখন বিতর্ক দেখা দিয়েছে, যে মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পরও তাঁরা মন্ত্রী পদে আছেন কি নেই৷
এই প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, মন্ত্রীদের এই পদত্যাগ সাংবিধানিক নয়, আনুষ্ঠানিক৷ তিনি জানান, তাঁরা যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয়া হয়নি৷ তবে রাষ্ট্রপতির কাছে এই পদত্যাগপত্র জমা দেয়া হলে তা কার্যকর হয়ে যাবে৷ তিনি আরও বলেন, তাঁদের এই পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয়ার জন্য দেয়া হয়নি৷ একটি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন৷ তাই তাঁরা যেটা জমা দিয়েছেন, তা সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগপত্র নয়, আনুষ্ঠানিকতা মাত্র৷ তাই তাঁরা স্বপদেই বহাল আছেন এবং দায়িত্ব পালন করছেন৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
এদিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, তাঁরা সংবিধান মেনেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন৷ এই পদত্যাগপত্র যখন রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হবে এবং তিনি তাতে সই করবেন তখন তা কার্যকর হবে, তার আগে নয়৷ তাই তার আগ পর্যন্ত মন্ত্রীরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই স্বাভাবিক৷ তিনি এ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি না করে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন৷ তিনি জানান, নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্যই এই প্রক্রিয়া৷
তবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা কার্যকর হয়ে যায়৷ এখানে পদত্যাগপত্র গ্রহণের কোনো বিষয় নেই৷ তিনি আরও বলেন, মন্ত্রীদের পদত্যাগ ইতিমধ্যেই কার্যকর হয়ে গেছে৷ এরপরও যদি মন্ত্রীরা দায়িত্ব পালন করেন, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমতুল্য হবে বলে তিনি দাবি করেন৷
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকও মনে করেন, মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা কার্যকর হয়৷ তিনি বলেন, কোনো মন্ত্রী যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন, তখনই তাঁর পদ শূন্য হয়ে যায়৷ তাই এখন মন্ত্রীদের পদ শূন্য বলেই ধরে নিতে হবে৷
জানা গেছে, মন্ত্রীরা তাঁদের পদত্যাগপত্রে কোনো তারিখ না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগের অভিপ্রায় জানিয়েছেন৷ আর প্রধানমন্ত্রী এখন থেকে যে সব মন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারে থাকবেন, তা বাদ দিয়ে বাকি পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন৷ আর সেই প্রক্রিয়া চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে হতে পারে৷ তখনই সর্বদলীয় সরকার গঠনের কথা৷