1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

মন্দা নিয়ে আলোচনা তো শুনছি, প্রস্তুতি বুঝতে পারছি কই

শামীমা নাসরিন
শামীমা নাসরিন
৭ অক্টোবর ২০২২

দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির যাঁতাকলে পড়ে আমার পকেট গড়ের মাঠ, নিত্যপ্রয়োজনই মেটাতে পারছি না। এদিকে অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে আমাকেই ব্যয় বাড়াতে হবে, না হলে হানা দেবে মন্দা।

বাংলাদেশে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশ ছাড়িয়েছেছবি: Abdullah Momin

আমার মতো অবস্থা এখন পুরো বিশ্বের৷ আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ সেরা জার্মানি, বিশ্বের তাবদ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশেগুলোর সরকার এবং অর্থনীতিবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর থেকে গভীরতর করছে ২০২৩ সালের সম্ভাব্য মন্দার শঙ্কা৷

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়েছে বলেছে , ২০২৩ সালে বিশ্বের অনেক দেশ মন্দার মুখোমুখি হতে পারে৷ কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি বিশ্ব অর্থনীতির গতি স্থবির করে দিচ্ছে৷ বিশেষ করে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি অনেক দেশের জন্য অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে৷

‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলছে, ১৯৭০ সালের মন্দার পর বিশ্ব অর্থনীতি এখন সবচেয়ে সংকটে রয়েছে৷ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে৷ পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির উপর যার প্রভাব বেশি পড়বে৷

এমনকি ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুন্ডেসব্যাংক বলেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সামনের বছর জার্মানির অর্থনীতি মন্দার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে৷ বিশেষ করে গ্যাসের সংকটের কারণে দেশটির উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে৷

দীর্ঘসময় ধরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীর গতি বা স্থবিরতা থাকলে তাকে মন্দা বলে বর্ণনা করা হয়৷ অর্থনীতিবিদদের মতে, পরপর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি বা মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) সংকুচিত হলে বা কমে গেল তাকে মন্দা বলে৷

জার্মানির মত শক্তিশালী অর্থনীতির দেশই যেখানে বলছে তারা আগামী বছর মন্দার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে৷ সেখানে পুরো বিশ্ব যে আসন্ন মন্দা নিয়ে উদ্বিগ্ন তা বলাই বাহুল্য৷ বাংলাদেশও তার বাইরে থাকবে না৷ শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের সব দেশেই মন্দার ঢেউ লাগবে৷ কোন দেশ কতটা দক্ষতা ও প্রস্তুতির সঙ্গে মন্দার সেই ঢেউ মোকাবেলা করতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়৷

বাংলাদেশ এজন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে? মন্দার কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে দেশটির ওপর?

অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় করোনাভাইরাস মহামারির সংকট বেশ ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছে বাংলাদেশ৷ কিন্তু এ বছরের শুরু দিকে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার জেরে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি এবং খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ধাক্কা বাংলাদেশও লেগেছে৷

ফলে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে৷ ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের চড়া দাম, খাদ্যপণ্য ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে৷

যে চাপ সামাল দিতে বাংলাদেশ এরইমধ্যে বাধ্যতামূলক লোডশেডিং, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি আর আমদানির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে৷

তারপরও ডলারের দাম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না৷ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গত সাত মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স আসা এবং একই মাসে রপ্তানি আয়ও কমে যাওয়া৷

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সবশেষ তথ্য বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন তিন হাজার ৬০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি, যা দিয়ে মোটামুটি চারমাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব৷

এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব জুড়ে মন্দার আশঙ্কায় চিন্তিত দেশটির অর্থনীতিবিদেরাও৷

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানোম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘বিশ্বে বড় ধরনের মন্দা দেখা দিলে বাংলাদেশও তার বাইরে থাকবে না৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের যে অংশীজনরা রয়েছেন, তারাও এটি নিয়ে ভাবছেন৷ বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা শঙ্কায় রয়েছেন৷

‘‘মন্দার প্রভাব বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই উৎস প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের ওপর বেশি পড়তে পারে৷ বিশ্ব মন্দা দেখা দিলে প্রবাসীদের কাজ কমে যাবে৷ তার প্রভাব পড়বে প্রবাসী আয়ে৷ আর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে৷ ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি তৈরি হলে মানুষ ফ্যাশনে ব্যয় কমাবে৷ যার প্রভাব পড়বে পোশাক রপ্তানির ওপর৷’’

গত কয়েকমাসে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে তৈরি পোশাক বা ফ্যাশন আইটেমের চাহিদা কমে গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ৷

তিনি বলছেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সেসব দেশে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ফলে ভোক্তাদের ফ্যাশনের প্রতি আকর্ষণ কমে গেছে৷

‘‘ইউরোপ আর আমেরিকায় যারা আমাদের কাছ থেকে পোশাক কেনেন, প্রথমে তারা যেরকম গার্মেন্টস পণ্যের অর্ডার দিয়েছিলেন, সেগুলোর বিক্রি সেরকম হয়নি৷ ওয়ালমার্টের কথাই ধরুন, তারা যে পরিমাণে ফ্যাশন আইটেমের অর্ডার দিয়েছিল, বিক্রি তার চেয়ে কম হয়েছে৷ তারা দেখেছে, এখন দরকারি পণ্যের বিক্রিই বেশি৷ তাই তারা সেগুলোর ওপর জোর দিয়েছে৷ ফলে নতুন করে গার্মেন্টস পণ্য নেয়ার ক্ষেত্রে তারা কিছুটা ধীর গতির নীতি নিয়েছে৷ এটার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের রপ্তানি আয়ে৷৷''

মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ায় লাগাম দিতে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে৷ বিশ্বব্যাংক মনে করছে, এর জেরেই বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ বিশ্বব্যাংক বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে একযোগে নীতি সুদ হার বাড়াচ্ছে, তা গত পাঁচ দশকে আর দেখা যায়নি৷ এ প্রবণতা আগামী বছরও থাকবে৷

এদিকে, নীত সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না৷ বরং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিনের এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে৷ ব্যয় কমাতে মূদ্রাবাজারে অর্থের যোগান কমে যাওয়ায় চোখ রাঙাচ্ছে মন্দা৷

বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তি মূলত যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল৷ এই তিন শক্তির অর্থনীতির চাকা দ্রুত গতি হারাচ্ছে৷ ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির উপর মাঝারি মাত্রার কোনো আঘাত আসলেই তা গড়াতে পারে মন্দায়৷ আর মন্দার মারাত্মক প্রভাব ভোগ করতে হবে বাংলাদেশের মত উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে৷

মন্দায় এসব দেশের প্রচুর মানুষ চাকরি বা ব্যবসা হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়বে৷ শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থা না থাকায় তাদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থাও থাকবে না৷

সম্ভাব্য মন্দা নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলে এরইমধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে৷ খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন৷ ৪ অক্টোবর একটি অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, ২০২৩ সালে বিশ্বমন্দা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে৷ বিষয়টি মাথায় রেখে নিজেদের রক্ষায় সবাইকে প্রস্তুতি নিতে হবে৷ এজন্য সবাইকে তিনি সঞ্চয়ী এবং সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷

আগামী বছর যে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে তা মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা রয়েছে৷ এ বিষয়ে সানোমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বের অর্থনীতি যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে, তাতে কোন দেশের পক্ষেই মন্দা মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া কঠিন৷

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘‘মন্দার বিষয়টি তো বাংলাদেশের হাতে নেই, এটা অনেকটাই বাহ্যিক৷ কিন্তু আগেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে হয়তো সেটার প্রভাব কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে৷ আমি মনে করি, সেই প্রস্তুতি এখনি নেয়া উচিত৷”

সম্ভাব্য মন্দা নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত সুসংগঠিত কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি৷

যদিও বাংলাদেশ সরকার থেকে বা সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় বলছেন, মন্দা মোকাবেলায় সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ উদাহরণ হিসেবে তারা দেশে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ট্যারিফ কমিয়ে আনা, রপ্তানি বাড়ানোর জন্য প্রণোদনা প্রদাণ, প্রবাসী আয় বাড়াতে সরকার থেকে নানা ভাতা দিয়ে উৎসাহ প্রদাণের কথা বলছেন৷

সামনে আসছে ক্রিসমাস৷ ওই সময়ে সারা বিশ্বেই কেনাবেচা বেড়ে যাবে৷ যেটিকে আশা হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা৷

শামীমা নাসরিন, সাংবাদিকছবি: privat

তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ আশা প্রকাশ করে বলেন, আরো দুইমাস রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকতে পারে৷ তবে ক্রিসমাসের সময় এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আমি আশা করছি৷”

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মন্দা মোকাবেলায় চাই বড় বিনিয়োগ৷ বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে৷ তাতে মানুষের আয় বাড়বে, সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে৷ এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকবে৷

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের মন্দা মোকাবেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যখন ক্ষমতায় আগে তখন বিশ্বজুড়ে মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছি৷

যদিও সেবারের মন্দার কারণ ছিল অর্থনৈতিক৷ এবারের মন্দার কারণ মূলত রাজনৈতিক৷ কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন জোরোসোরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে বিশ্বের উপর ইউক্রেন যুদ্ধের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়৷

কে এই বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে সে আলোচনায় আর না যাই৷ কিন্তু এই যু্দ্ধের চাপেই বিশ্ব অর্থনীতি আজ খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে৷

বিশ্ব মোড়লদের বোধোদয় হোক, থেমে যাক যুদ্ধ, কেটে যাক মন্দা৷ পৃথিবী আবার প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠুক৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ