বাবরি মসজিদ নিয়ে বিবাদের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বিতর্কিত জমির মালিকানা স্বত্বের নিষ্পত্তি করাই তাঁদের একমাত্র বিচার্য৷ পাশাপাশি চলেছে আদালতের বাইরে দু' পক্ষের আপোষের চেষ্টা৷
বিজ্ঞাপন
সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিবাদের পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন আগামী ১২ই মার্চ৷ তার আগে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বিতর্কিত জমির মালিকানা সংক্রান্ত মামলাটিই আদালতের একমাত্র বিচার্য৷ জমি সংক্রান্ত মামলায় ধর্ম, সংস্কার, রাজনীতি ইত্যাদির কোনো জায়গা নেই৷ জমি বিতর্কে দরকার সংশ্লিষ্ট নথিপত্র৷ আদালতে অনেক নথি জমা পড়েছে, কিন্তু সেসবের প্রাঞ্জল অনুবাদ এখনও বাকি৷ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের জন্য সেই সব অনুবাদ জরুরি৷ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এলাহাবাদ হাইকোর্ট অযোধ্যার ২ দশমিক ৭৭ একর বিবাদিত জমির মালিকানা এক-তৃতীয়াংশ করে ভাগ করে দেন সংশ্লিষ্ট তিন পক্ষ নির্মোহী আখাড়া, রামলালা এবং সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের মধ্যে৷
কিন্তু এই রায়ের বিরুদ্ধে ১৩টি আর্জি পেশ করা হয় সুপ্রিম কোর্টে৷ এর ফলে সুপ্রিম কোর্ট এখন এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে৷ বিষয়টির সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখে অনতিবিলম্বে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে শীর্ষ আদালতকেই৷ যতদিন যাচ্ছে ততই বিষয়টি বিতর্কিত হয়ে উঠছে৷ অতি সক্রিয় হয়ে উঠছে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় সংগঠনগুলি৷ পাশাপাশি আদালতের বাইরে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলি নিজেদের মধ্যে জমি সংক্রান্ত বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে আপোষ মীমাংসা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ তাতেও বাধাবিপত্তি ভুল বোঝাবুঝি দেখা দিচ্ছে৷ আর্ট অফ লিভিং সংগঠনের গুরু শ্রী শ্রী রবিশংকর মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেছেন৷ বৈঠকের পর অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ডের নির্বাহী সদস্য মওলানা সালমান নাদভি এক বিবৃতিতে বলেন, মসজিদের জন্য অন্যত্র জমি দেওয়া হলে আপত্তি নেই৷ বিতর্কিত জমিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে৷ এই বিবৃতির পর অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড (এআইএমপিএলবি)-তে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ৷ গত রবিবার হায়দ্রাবাদে এআইএমপিএলবি-এর ২৬তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের পর নাদভীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়৷ বলা হয়, মুসলিমরা বাবরি মসজিদের অধিকার কখনোই ছেড়ে দিতে পারে না৷
সেই অধিকার কায়েম করতে এবং বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের জন্য সুপ্রিম কোর্টে তাঁদের আইনি লড়াই চলছে, চলবে৷ এর বিপ্রতীপ অবস্থান নিয়ে হাজি মেহবুব বলেন, তিনি নিজেদের সংগঠনের উলেমা ও মুসলিম স্কলারদের সঙ্গে শলা-পরামর্ষ করার পর বলেন, তাঁরা অযোধ্যায় মসজিদ বিবাদের সমাধানসূত্র নিয়ে শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন৷
‘জমি সংক্রান্ত বিবাদে সুপ্রিম কোর্টের রায় আমরা মাথা পেতে নেবো’
উত্তরবঙ্গের নজরুল হাফেজ সবার কাছে ‘হাজি সাহেব' হিসেবে পরিচিত৷ রামমন্দির-বাবরি মসজিদ ইস্যুতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাইলে ডয়চে ভেলেকে তনি বললেন, ‘‘লড়াইটা এখন চলছে সুপ্রিম কোর্টে৷ জমি সংক্রান্ত বিবাদে সুপ্রিম কোর্টের রায় আমরা মাথা পেতে নেবো৷ আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে যদি বিচার না হয়, তাহলে ভারতের সংবিধানে মনে হয় কোথাও চিড় ধরবে৷ জমি সংক্রান্ত বিষয়ে এআইএমপিএলবির অবস্থানকেই আমি সমর্থন করি৷ আদালতের বাইরে যদি গ্রহণযোগ্য সমাধান হয়৷ সেক্ষেত্রে আমাদের দিক থেকে খুব একটা আপত্তির কারণ নেই৷ সালমান নাদভী সাহেবের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত নই৷ উনি হলেন, সেই নাদভী, যিনি ইরাকের আইসিস (আইএসআইএস) শাখার সন্ত্রাসী আবু বকর অল-বাগদাদিকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন৷ তবে হ্যাঁ, ওনার নিজস্ব মত থাকতেই পারে৷ কিন্তু এআইএমপিএলবি একা চলে না৷ সেখানেই তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ এআইএমপিএলবি-এর সকলেই যদি নিজের নিজের মত দিতে থাকেন, তাহলে সংগঠনের গুরুত্বই থাকে না৷ এআইএমপিএলবিতে সব শ্রেণির মুসলিম আছে৷ শিয়া আছে, সুন্নি আছে, বেরিলি আছে, দেওবন্দি আছে৷ মতামতের লড়াইটা ওখানেই হোক, বাইরে নয়৷''
অন্যদিকে ফের শুরু হচ্ছে অযোধ্যা থেকে রথযাত্রা৷ ঘুরবে ৬টি রাজ্য৷ রাম রাজ্য রথযাত্রা নামে এর সূচনা হবে করসেবকপুরম থেকে৷ একটি স্বয়ংসেবী সংস্থা এর আয়োজন করলেও পেছনে বিশ্বহিন্দু পরিষদ আছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ৷ স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯০ সালে এই ধরনের রথযাত্রা শুরু করেছিলেন বিজেপি শীর্ষ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি৷ পরিণামে করসেবকদের হাতে ধ্বংস হয় বাবরি মসজিদ৷ হিন্দু সংগঠনগুলি মনে করছে, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকার, কেন্দ্রেও বিজেপি সরকার, তাই ২০১৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে রামমন্দির নির্মাণের সুযোগ হাতছাড়া করতে তারা রাজি নয়৷ যেভাবেই হোক, সুযোগ কাজে লাগাতে চায় তারা৷ আসলে ভোটের আগে রাজনৈতিক জল মাপতে চাইছে বিজেপি৷ মুসলিম সংগঠনগুলির আইনজীবী গত ডিসেম্বরের শুনানিতে ২০১৯ সালের আগে আদালতের রায় ঘোষণা না করর আর্জি জানিয়েছিলন সুপ্রিম কোর্টে৷ তাতে নাকি সামাজিক অসন্তোষ বাড়ার আশংকা আছে৷ গভীর সংকট এড়াতে সবাই এখন তাকিয়ে আছে সুপ্রিম কোর্টের দিকে৷
বাবরি মসজিদের প্রতিষ্ঠা থেকে ভাঙচুরের ইতিহাস
হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, রাম মন্দির, নাকি মোগল সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত একটি মসজিদ? বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৩ সাল থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চলেছে, যা চরমে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে৷
ছবি: dpa - Bildarchiv
১৫২৮ সালে নির্মাণ
রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত৷ তারই কাছে রামকোট পর্বত৷ ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান' বলেও পরিচিত ছিল৷
ছবি: DW/S. Waheed
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার৷ অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. E. Curran
সংঘাতের সূত্রপাত
প্রথমবারের মতো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত৷১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
হিন্দুদের দাবি
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি৷ তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি৷
ছবি: AP
বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর – বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷
ছবি: DW/S. Waheed
নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন ‘‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে’’৷
ছবি: Getty Images
মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে৷ ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ৷ অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন৷
ছবি: AP
‘রাম রথযাত্রা'’
১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস'-এর অনুমতি পায়৷ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা'’ শুরু করেন৷
ছবি: AP
১৯৯২
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছান৷ ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়৷ ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
ছবি: AP
শিলালিপি কী বলে
পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল৷ আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী'-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির৷
ছবি: CC-BY-SA-Shaid Khan
বিজেপি দোষী
বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়৷ প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়৷
ছবি: AP
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত৷ এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন৷ রায়ে আরো বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে৷ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই জমিটি ভাগ করতে চান না৷
ছবি: AP
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷