শাকিলের মৃত্যু : আত্মহত্যা, না ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড'?
১১ জুন ২০২৫
মঙ্গলবার সকালে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে নিজের বাড়ি থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
‘আমি নাস্তিক নই'- লিখে ফেসবুক পোস্টে শাকিল আরো দাবি করেছিলেন, নাস্তিক না হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের নামে বিচার-সালিশ এবং দলবদ্ধ সন্ত্রাসের শিকার হতে চান না, প্রিয়জনদেরও হতে দিতে চান না৷
সিংগাইর উপজেলার দক্ষিণ জামশা গ্রামের বাড়ি থেকে গলায় ফাঁস দেয়া লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ জানিয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে স্বেচ্ছায় তারুণদীপ্ত জীবনে ইতি টেনেছেন শাকিল।
১০ জুন (মঙ্গলবার) সকালে লাশ উদ্ধার করা হয়৷ সেদিনই জামশা বাজারের ব্যবসায়ী দিদার আলীর সদলবলে শাকিলদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। দিদার আলীর লোকজনের দাবি ছিল শাকিলকে এবং তার পরিবারের সবাইকে প্রকাশ্যে তওবা করে মাফ চাইতে হবে।
সাত-আট মাস আগে একটি ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করেছিলেন শাকিল। সেই মন্তব্য পরে ডিলিটও করে দেন। কিন্তু মুছে দেয়া সেই মন্তব্যের স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে গত কয়েকদিন ধরে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে শাকিল ও তার পরিবারকে হুমকি দেয়া হচ্ছিল। শাকিল বাড়ির বাইরে গেলে তাকে ‘নাস্তিক' বলা হতো। স্থানীয় কিছু লোক ফেসবুকেও প্রচারণা চালাচ্ছিল কয়েকদিন ধরে।
আজ (বুধবার) শাকিলের প্রতিবেশী মিলন হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাত মাস আগে শাকিল একজনের ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট করেছিল। কিন্তু কিছু দিন আগে স্থানীয় কয়েকটি ছেলে তার কমেন্টের স্ক্রিনশট দেখিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলে। তা ভাইরাল হলে পুরো এলাকায় বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনা হয়। তারপর এলাকার মওলানারা শকিলের বাবার সাথে কথা বলেন। সিদ্ধান্ত হয় ১০ তারিখ সকাল ৯টার দিকে বাজারের ব্যবসায়ী দিদার আলীর নেতৃত্বে তাদের বাড়ি গিয়ে এটা নিয়ে সালিশ করে ফয়সালা করবে।”
"এর আগেও এরকম আরেকটি ধর্ম অবমাননার ঘটনায় সবাই মিলে কজনকে তওবা পড়িয়ে মাফ চাওয়ার মাধ্যমে সমাধান করেছিল৷ এবারো সেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সালিশের আগের রাতেই (সোমবার) দুইটার দিকে শাকিল আত্মহত্যা করলো” বলেন তিনি। তিনি জানান,‘‘হত্যার আগে এক ফেসবুক পোস্টে সে বলেছে, সে নাস্তিক নয়।”
মৃত্যুর আগে ফেসবুকে মোট চারটি পোস্ট দিয়েছেন শাকিল৷ সর্বশেষ পোস্টে বলেছেন, "আমি নাস্তিক নই, গ্রামের সবাই আমাকে নাস্তিক বলছে। আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে, আমি নবী মুহাম্মদকে কোনো কটূক্তি করিনি। আমাকে নিয়ে আমার বাবা অনেক গর্ব করতো, গ্রামের সবাই আমাকে অনেক সম্মান করতো। আজ আমি আমার নিজের আপন মানুষের কাছে আমার সম্মান হারিয়েছি।আগামীকাল আমার বাবাকে সবাই গালি দিবে, আমার মাকে সবাই অসম্মান করবে, এই লজ্জা আমি কখনো সহ্য করতে পারবো না। একটা ছেলে হয়ে নিজের বাবা-মায়ের মান-সম্মান আমি এভাবে নষ্ট করে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারবো না। কোনো দিন আমি গ্রামে মাথা তুলে চলতে পারবো না। আত্মহত্যা মহাপাপ- আমি জানি। আমি অনেক পাপ করেছি, আজ আর একটা শেষ পাপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।''
দক্ষিণ জামশা গ্রামের নাসিরউদ্দিন আহমেদের ছেলে শাকিল৷ কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। থাকতেন মহসীন হলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন শাকিল। বড় দুই ভাই দেশের বাইরে থাকেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে শুধু তিনিই বিশ্ববদ্যালয়ে পড়েছেন। তার ভাইয়ের স্ত্রী রিনা বেগম জানান শাকিলের চিরবিদায়ে
পুরো পরিবার শোকস্তব্ধ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন,"আমরা এখন আর কিছু বলতে চাই না। আমরা তো আর তাকে ফেরত পাবো না। তাকে হারিয়ে আমাদের পরিবারের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমার শ্বশুর শাকিলকে নিয়ে খুব গর্ব করতো- তার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে৷ তিনি এখন পাগলের মতো হয়ে গেছেন। শুধু বলছেন, আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম। বিচার একমাত্র আল্লাহই করবেন। মানুষের কাছে আমার কোনো বিচার নাই।”
রিনা বেগম জানান, "শাকিল ঈদের দুইদিন আগে বাড়িতে এসেছিল। বুধবার তার ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু সে চলে গেল। তার মতো শান্ত-শিষ্ট ছেলে এলাকায় কমই ছিল। এলাকার সবাই তাকে নিয়ে গর্ব করতো। কিন্তু কারা ষড়যন্ত্র করলো, কেন করলো জানি না। তার মেবাইল ফোনটিও পাচ্ছি না।”
হুমকি ও সালিশ আয়োজনের ব্যাপারে জানতে চাইলে নিরাপত্তার স্বার্থে সব কথা বলতে চাননি তিনি, শুধু বলেছেন,"আমরা এলাকায় থাকতে চাই। কোনো ঝামেলা চাই না। আমরা আর কিছু বলতে চাই না।”
তবে ওই এলাকার কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, গত কিছুদিন ধরে শাকিলের পরিবারকে হুমকি দেয়া হচ্ছিল। হামলার কথাও বলছিল কেউ কেউ। বাজারে বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছিল। রাতে শাকিলদের বাড়িতে হামলার জন্য একটি গ্রুপ প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলেও জানান তারা।
শাকিলের চাচাতো বোন মুক্তা আক্তার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, "কমেন্টকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ জামশা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোর কয়েক'শ লোক শাকিলদের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন হুমকি দেন। এরপর রাত দুইটার দিকে বাড়িতে নিজের ঘরে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন শাকিল।”
‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের' অভিযোগ
এক বিবৃতিতে শাকিল আহমেদের মৃত্যুকে ‘রাষ্ট্রীয় মদতে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড' বলেছে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর বিবৃতিতে বলা হয়, "এক বছরের পুরোনো একটি ফেসবুক কমেন্টকে কেন্দ্র করে শাকিল আহমেদের নামে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি ফেসবুকে বেশ কয়েকবার ক্ষমা চেয়েও মবের হাত থেকে রক্ষা পাননি। শাকিল মব ভায়োলেন্স এড়ানোর জন্যই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।”
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট শাকিলকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার পেছনে থাকা মব সৃষ্টিকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে।
বিবৃতিতে ছাত্রসংগঠনটির নেতারা আরো বলেন, "মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতার ঘাটতি সুস্পষ্টভাবেই লক্ষ্যণীয়। দেশের সর্বত্র যে-কোনো ভিন্ন মতের ওপর হামলা হচ্ছে, মাজারে হামলা হচ্ছে, নারী নিপীড়ন হচ্ছে, ভিন্ন জাতিসত্তার ওপর নিপীড়ন হচ্ছে। এসব সংঘবদ্ধ সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা, বিচারহীনতাই এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটার প্রেক্ষাপট তৈরি করছে।”
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে দেখে আসছি, ভিন্নমতকে দমন করার জন্য সহিংসতার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। মব তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আগের ঘটনাগুলোর বিচার না হওয়ায় এই মবসন্ত্রাস থামছে না। আমরা শুধু শেখ হাসিনার পতন চাইনি, আমরা পরিবর্তনও চেয়েছি। কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসছে না।”
অন্যদিকে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তাকে (শাকিল) নানা ধরনের ট্যাগ দিয়ে হুমকি দেয়া হলো। তার পরিবারকে হুমকি দেয়া হলো। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নিলো না। দেশে যে অব্যাহত মব-সহিংসতা চলছে, তারই ধারাবাহিতা এটা। এটা একটি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। এটাকে আমরা আত্মহত্যা বলতে পারছি না।”
শাকিলের সহপাঠী প্রিতম আদিত্য রায় বলেন, "আমরা এটা মেনে নিতে পারছি না। এভাবে মব ক্রিয়েট করে আত্মহত্যায় বাধ্য করা হবে আর রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেবে না! কার কাছে বলবো? দেশ তো এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তার মৃত্যুর খবরের পোস্টে কেউ কেউ গিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ' কমেন্ট করছে। ভাবা যায়! এই যখন অবস্থা, তখন আমরা প্রতিবাদ করে কী করবো তা-ও জানি না। তারপরও আমরা প্রতিবাদ করছি।”
পুলিশ যা বলছে
শাকিল আহমেদের মৃত্যুর জন্য প্রধানত ব্যবসায়ী দিদার আলীকে দায়ী মনে করা হচ্ছে৷ কারণ, সালিশ বসানোর মূল উদ্যোক্তা তিনি৷
তবে তার দাবি, "দীর্ঘদিন আগে মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে শাকিল কটূক্তিমূলক মন্তব্য করেন। তবে ভুল বুঝতে পেরে কিছুদিন পর তা মুছে ফেলেন। পরে ফেসবুকে তার এক বন্ধু ওই মন্তব্য আবার ভাইরাল করে দেন। এতে লোকজন তাদের হুমকি দিচ্ছিল। আমি সেটা সমাধানের জন্য একটি সালিশের আয়োজন করেছিলাম স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মওলানাদের সঙ্গে কথা বলে। আমার আর কোনো দায় নেই।”
শাকিলের আত্মহত্যার ঘটনায় সিংগাইর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। কাউকে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তৌফিক আজম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মরদেহের ময়না তদন্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত যে, সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তবে তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত বা বাধ্য করা হয়েছে এমন কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। তার পরিবারের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়নি। এরকম অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে দেখবো।”
তিনি আরো বলেন, "আত্মহত্যার পর আমরা ফেসবুক পোস্ট, ধর্ম অবমাননার বিষয়গুলো জানতে পারি। তার পরিবার যে হুমকির মুখে ছিল তা-ও আমরা জানতাম না। তার পরিবারও কোনো অভিযোগ করেনি।”
এখন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, " তার পরিবার তো কোনো অভিযোগ করেনি।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই ধরনের ফৌজদারী অপরাধের ব্যাপারে কেউ অভিযোগ না করলেও পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে, তদন্ত করতে পারে। পুলিশ এখানে ঘটনাটিকে ধামাচাপ দেয়ার চেষ্টা করছে।”
তিনি মনে করেন, " শাকিলের আত্মহত্যাকে আসলে আত্মহত্যা হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। সে আসলে মবোক্রেসির শিকার। একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের ইচ্ছেমতো যে কাউকে লেবেলিং করে দিচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে এটা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি একটি ছেলেকে বিচার করে তাকে হত্যার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সত্য-মিথ্যা জানি না। এভাবে চলতে থাকলে দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!”
নূর খানের মতে, "আইন-শৃঙ্খলার এতটা অবনতি হয়েছে যে, কোনো কিছুর ওপর আস্থা রাখার অবস্থা আর নেই৷”