পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে পদ্মা সেতু ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিজ্ঞাপন
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পদ্মা সেতু দেখার আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি শেখ হাসিনা চিঠিতে লিখেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরে তিনি ভারত সফরে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ''সেপ্টেম্বর ২০২২-এ আমার নির্ধারিত নয়াদিল্লি সফরকালে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে বলে আশা রাখি। দুই বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি ও আদর্শগত সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে বর্তমান সম্পর্ককে দৃঢ়তর করতে একযোগে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই।''
হাসিনা পদ্মা সেতু নিয়ে চিঠিতে লিখেছেন, ''এই সেতু বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতের আত্মিক সম্পর্ক দৃঢ় করবে ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।'' তারপরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি বলেছেন, ''সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ রইলো।''
চিঠির পিছনেও কি তিস্তা?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পদ্মা সেতু দেখার আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে কোনো বিতর্ক নেই। নিজস্ব অর্থে তৈরি এই নয়নমনোহর সেতু দেখার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতেই পারেন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসিনার চিঠি শুধু এই আমন্ত্রণেই শেষ হয়ে যায়নি। বরং শেখ হাসিনা আগামী সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে আসছেন এবং সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার দেখা হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি দুই বাংলার সম্পর্ককে দৃঢ় করার জন্য একযোগে কাজ করার কথা বলেছেন। এর পিছনে তিস্তা চুক্তি রয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতীয়রা যা ভাবছেন
শেখ হাসিনা ভারতে এলেও তিস্তা চুক্তি আপাতত হচ্ছে না৷ তারপরেও তিস্তার দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ৷ আশা-আকাঙ্খায় দিন গুনছে বহু মানুষ৷ চলুন জেনে নেওয়া যাক ভারতের কয়েকজন সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে কী ভাবছেন৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
সুস্মিতা সর্বাধিকারী, কবি ও সমাজসেবী
তিস্তা নদী ভারতের যে যে রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে জলবণ্টন চুক্তিতে সেই রাজ্যগুলির স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে আন্তর্জাতিক স্তরে চুক্তিবদ্ধ হওয়া আবশ্যক৷ তা না হলে অন্যান্য জলচুক্তির ক্ষেত্রে ভারত যে শিক্ষা পেয়েছে, এক্ষেত্রেও তা-ই হবে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অবস্থান সাধুবাদের যোগ্য৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
মলয় হালদার, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন প্রশাসনিক কর্তা
নদীর গতিপথ যখন প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো, তখন কোনো দেশের একক সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সহজ হতো না৷ এখন ভাটির দেশকে নির্ভর করতে হয় উজান দেশের মনোভাবের ওপর৷ তিস্তার জল যেমন ভারতের, তেমনি বাংলাদেশেরও৷ শুধু উত্তরবঙ্গের কথা বলে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বকে বলি দেওয়া সমীচীন নয়৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
পাপন মালাকার, বেসরকারি সংস্থার কর্মী
বাংলাদেশের সঙ্গে কোথায় যেন আত্মার টান অনুভব করি৷ আমরা জল অপচয় করব আর প্রতিবেশী দেশের ভাই-বোনেরা জলের অভাবে কষ্ট পাবে এটা মন থেকে মেনে নিতে পারি না৷ তবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
কমলিকা ভট্টাচার্য, চাকুরিজীবী
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী৷ এই ধরনের নদীতে কোনো একটি দেশ বা রাজ্যের একছত্র অধিকার থাকে না৷ সিকিম থেকে গজলডোবা পর্যন্ত তিস্তার ওপর বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের রংপুর-রাজশাহী অঞ্চল মরুর চেহারা নিচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে নদী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শুখা মরশুমে দুই দেশের মধ্যে সমবন্টনের নীতি গ্রহন করা উটিত৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
অসীম দাস, সমাজসেবী
নদীর জল আটকে রাখার চেষ্টা, নিজের অধিকারের এক্তিয়ার বলে মনে করা নেহাৎ মুর্খামি৷ ভারত বা বাংলাদেশ উভয়েই কৃষিপ্রধান দেশ৷ কৃষিকাজ না হলে দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে৷ বাংলাদেশকে তিস্তার জল না দিয়ে ভারত যদি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে ভবিষ্যতে নেপাল যদি ভারতকে ব্রহ্মপুত্র নদীর জল দিতে অস্বীকার করে, কী হবে তখন?
ছবি: DW/R. Chakraborty
বনশ্রী কোনার, হোম মেকার
দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ‘ইগো’ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এমনটা কখনওই কাম্য নয়৷ দেশ তথা সার্বিক স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
অভিজিৎ চ্যাটার্জি, প্রকাশনী সংস্থার কর্মী
তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি হোক বা না হোক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের রাজ্যে রাজনীতি করতেই হবে৷ তাই তাঁকে রাজ্যবাসীর স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে কাজ করতে হয়৷ নদীর জলে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ না রেখে উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে জল দেওয়ার মধ্যে কোনও মহত্ব নেই৷ বরং সবার আগে রাজ্যবাসীর দিকে তাকানো উচিত৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
মানবেন্দু সরকার, কলেজ শিক্ষক
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আসছেন৷ তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করে প্রাথমিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এটাই উপযুক্ত সময়৷ হাসিনা চাইছেন, নরেন্দ্র মোদী চাইছেন৷ সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীও চাইছেন৷ বেঁকে বসেছেন মমতা ব্যানার্জি৷ এটা সৌহার্দ্যের ছবি নয়৷ ভুল বার্তা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
রাখী বিশ্বাস, কলেজ ছাত্রী
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তাচুক্তি নিয়ে আলোচনা চললেও তা ফলপ্রসূ হয়নি৷ ফলে তিস্তার জলের দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ৷ মমতা ব্যানার্জিকেই ঠিক করতে হবে, উনি রাজনীতি করবেন, নাকি দেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াবেন৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
9 ছবি1 | 9
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''আমার মনে হচ্ছে, এই চিঠির পিছনে তিস্তা উঁকি দিচ্ছে। বাংলাদেশে ভোট আসছে। ফলে তিস্তা চুক্তি করা শেখ হাসিনার পক্ষে খুবই জরুরি। সেপ্টেম্বরের ভারত সফর ও একযোগে কাজ করার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করার মধ্য দিয়েই তা স্পষ্ট।'' শুভাশিসের মতে, ''এই চুক্তির ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা হলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মতো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তিস্তা চুক্তি করতে রাজি। সেজন্যই মমতাকে এই প্রচ্ছন্ন অনুরোধ করেছেন হাাসিনা।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ প্রবীণ সাংবাদিক মিলন দত্তও জানিয়েছেন, ''বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই চিঠির পিছনে তিস্তা প্রকট বলে তার মনে হয়েছে। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আবেগের বিষয়। তাই শেখ হাসিনা এই চুক্তি করতে এতটা তৎপর।''
মিলন মনে করেন, ''তিস্তাতে আর আগের মতো জল নেই। এখন সারা বছর তিস্তার জল বাংলাদেশে যেতে দিলে ভারতের কোনও ক্ষতি নেই। গাজোলডোবায় যে বাঁধ দেয়া হয়েছে, সেখানে অল্প জল ধরে রেখে বাকি জল সারাবছর বাংলাদেশের দিকে যেতে দেয়া উচিত। আর নদী বাঁচানোটাও ভারতের কর্তব্য।''
প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্ক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক খুবই ভালো। মমতা বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পর শেখ হাসিনা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তার জবাবও দিয়েছিলেন মমতা। বাংলাদেশ থেকে তিনি মমতার জন্য আমও পাঠিয়েছিলেন। তার জবাবে মমতা লিখেছিলেন, তিনি ওই আম খেয়েছেন এবং প্রচুর মানুষকে খাইয়েছেন। ফলে শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে পত্রালাপ নতুন কোনো ঘটনা নয়।
শুভাশিস জানাচ্ছেন, এর আগে রাশিয়ার নেতা ক্রুশ্চেভ, বুলগানিনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সুসম্পর্ক ছিল। সাধারণত, ভারতের কোনো মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতাদের এরকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে না।