তৃণমূল কংগ্রেসে একটা চালু কথা আছে, ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে দিশানির্দেশ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার কী দিশানির্দেশ দিলেন তিনি?
বিজ্ঞাপন
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ১৩ জন প্রতিবাদকারী। প্রতি বছর তাদের স্মরণে ২১ জুলাইয়ের জনসভা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শহিদ স্মরণের অনুষ্ঠান। করোনার সময় শহিদ স্মরণের অনুষ্ঠান হয়েছিল অনলাইনে। এবার অবশ্য ধর্মতলায় ২১ জুলাইয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। তৃণমূলের লাখো কর্মী সমর্থক তাতে যোগ দিয়েছেন। তারা পতাকা দুলিয়েছেন। স্লোগানে মুখরিত হয়েছে সভাপ্রাঙ্গন। ধর্মতলায় এই অনুষ্ঠানে ছিল উৎসবের আমেজ। দীর্ঘদিন পর এরকম বড় মাপের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে ঠাসাঠাসি ভিড়ে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল কর্মী, সমর্থকরা।
হাইকোর্টের নির্দেশ
যখন এই অনুষ্ঠান হলো, যখন দেশে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টাতেও ৪৫ জন করোনার কারণে মারা গেছেন। আর এই করোনা আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশের মধ্যে দুই নম্বরে। কলকাতা হাইকোর্টের নর্দেশ ছিল, সমাবেশে কঠোরভাবে করোনা বিধি মানতে হবে।
তারপরেও যেভাবে ঠাসা ভিড়ে জনসভা হয়েছে, তাতে এরপর পশ্চিমবঙ্গে করোনা লাফিয়ে বাড়লেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ভারতে অবশ্য করোনাকালেও দেখা গেছে উৎসব অনুষ্ঠানে ভিড় উপচে পড়ছে। তবলিগ জামাতের অনুষ্ঠান থেকে কুম্ভ মেলা পর্যন্ত তার অনেক উদাহরণ আছে। সেই তালিকায় এবার ২১ জুলাইয়ের সভাও ঢুকে যাবে। প্রশ্ন হলো, এখানে হাইকোর্টের নির্দেশের পরেও করোনাবিধি মানা হলো না কেন?
কিন্তু এর পাশাপাশি যে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা সামনে আসছে, তা মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ নিয়ে। ঠিক কি দিশানির্দেশ দিলেন তিনি? শুধুই কি সেই দায় এড়িয়ে যাওয়ার পুরনো প্রয়াস, নাকি তার থেকেও বেশি কিছু? একবার চোখ ফেরানো যাক মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের দিকে।
আপনি একা সাধুপুরুষ?
সিপিএম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ''কি বিকাশবাবু, আপনি একা সাধুপুরুষ? ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না? আপনার আমলে কাদের বার্থ সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল? বার করব সেই ফাইলগুলো?'' মমতা বলেছেন, ''আমি শুনেছি, সিপিএমের আমলে তাদের মুখপত্রে যে সব মানুষ কাজ করতেন, তাদের স্ত্রীদের অন্য কোথাও চাকরির ব্যবস্থা করে দিত সিপিএম।''
২১ জুলাইয়ের মতো দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে বিকাশরঞ্জনের বিরুদ্ধে কেন বিষোদ্গার করলেন মুখ্যমন্ত্রী? সম্ভবত কারণটা হলো, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে একাধিক মামলা লড়ছেন বিকাশরঞ্জন। যে মামলা নিয়ে রাজ্য সরকার যথেষ্ট বিপাকে পড়েছে। কিন্তু ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী যা করেছেন, তা হলো হুমকি দেয়া। ফাইল প্রকাশ করার হুমকি। ঘটনা হলো, সিপিএম আমলে কোনোরকম দুর্নীতি হয়ে থাকলে তা সামনে আনা তো মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য। তা না করে, তিনি এই ধরনের হুমকি দিচ্ছেন কেন? তাছাড়া সিপিএমের আমলে যদি ক্যাডার বা নেতাদের স্ত্রীরা চাকরি পান, তাহলে তো প্রথমে দেখতে হবে, তারা বেআইনিভাবে চাকরি পেয়েছেন কি না। বেআইনিভাবে না পেলে কাউকে চাকরি দেয়াটা তো ভালো কাজ। সেখানে আপত্তি কোথায় থাকতে পারে? আর বেআইনিভাবে চাকরি দেয়া হলে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না?
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
তারা রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের তোয়াক্কা করেন না। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত নারী প্রতিদিন বিক্ষোভ দেখান। বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি এক বাবা। এসএসসি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন প্রতিদিন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
তিন দফায় আন্দোলন
মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীতে ২০১৯ সালের প্রথম দফার আন্দোলন ২৯দিনের মাথায় তুলে নেন আন্দোলনকারীরা। আশ্বাস ফলপ্রসূ না হওয়ায় দ্বিতীয়বার আন্দোলনে বসেন চাকরিপ্রার্থীরা। আন্দোলন চলে ১৮৭ দিন। বর্ষণমুখর রাতের অন্ধকারে দ্বিতীয় দফার সেই আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। অবস্থান মঞ্চ থেকে আন্দোলনকারীদের সমস্ত জিনিসপত্র সমেত তুলে দেয়া হয়। এখন চলছে তৃতীয় দফার আন্দোলন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সব বাধা উপেক্ষা করে
তৃতীয় দফায় বিগত সাতমাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই আন্দোলন। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে এই শামিয়ানার নীচে আন্দোলনরত কয়েকশত চাকরিপ্রার্থী নারী পুরুষ। প্রথমদিকে শামিয়ানা টাঙানোর অনুমতিও ছিল না। গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নীচে তীব্র রোদেই অবস্থান করে আসছিলেন একঝাঁক তরুণ তরুণী। পরবর্তীকালে লালবাজার থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে শামিয়ানা টাঙানো হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
নেই পানীয় জলের ব্যবস্থা, বাসটার্মিনাসের শৌচাগার পয়সা দিয়ে ব্যবহার করতে হয়। নারী-পুরুষের জন্য পৃথক কোনো ব্যবস্থা নেই, এমনই অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মাথা গোঁজার ঠাঁই
রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই অবস্থানে প্রতিদিন সামিল হন চাকরিপ্রার্থীরা। কেউ কেউ প্রতিদিন যাতায়াত করেন আবার অনেকে এই আন্দোলনের স্বার্থে বাড়িঘর ছেড়ে দিনের পর দিন এখানেই পড়ে আছেন। কোনোদিন আত্নীয়-স্বজন, কোনোদিন বন্ধুর বাড়িতে রাতটুকু থাকেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও
একসঙ্গে দুইটি লড়াই লড়ছেন বীরভূমের সোমা দাস। এসএসসি দুর্নীতির পাশাপাশি ব্লাড ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও তার লড়াই। দ্বিতীয় দফার কেমোথেরাপি সম্পূর্ণ হলেও তৃতীয় দফার কেমো নিতে হতে পারে। এই আন্দোলন চলাকালীন তার চিকিৎসাও চলেছে। সোমবার তাকে সহকারী শিক্ষিকার চাকরি দেয়ার নির্দেশ দেয় শিক্ষা দফতর, কিন্তু তিনি তার প্রাপ্য সরকারি চাকরিটি নেবেন ঠিকই, সঙ্গে আন্দোলনও চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সন্তান হারানো মইদুল
যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের প্রেসিডেণ্ট মইদুল ইসলাম। আন্দোলন চলাকালীন সন্তান হারিয়েছেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তিনি পুত্রসন্তান লাভ করেন। আন্দোলনের ব্যস্ততায় সদ্যোজাতের শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা করাতে পারেননি। আট দিনের মাথায় মারা যায় শিশুপুত্রটি। মইদুল এখনো বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
হারাতে হলো টিউশন
পিয়ালী সরকারের সামান্য যে কয়টা প্রাইভেট টিউশন ছিল, এই আন্দোলনের ফলে সে সব যেতে বসেছে। বিক্ষোভ দেখানোর জন্য কামাই হয়ে যায় টিউশন। ছাত্রছাত্রীর বাবা-মা রুষ্ট হন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
জুলেখার লড়াই
জুলেখা মণ্ডলের বাড়ি নদিয়ার তেহট্টে। সেখান থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করা সম্ভব হয় না। পরিচিত কারো বাড়িতে রাতটুকু কাটিয়ে আবার ধরণামঞ্চে ফেরেন। বাবা দর্জির কাজ করতেন, পায়ের অবস্থা খারাপ হওয়ায় সে কাজও বন্ধ হয়েছে। জুলেখার একার কাঁধে সংসারের দায়িত্ব। রোটেশন পদ্ধতিতে যখন বাড়ি যান, তখন পড়ান। ছাত্র সংখ্যা কমে গেছে আগের থেকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সাতঘণ্টা ধরে যাতায়াত
অর্পিতা হাজরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় বাড়ি। ধরণামঞ্চে উপস্থিত থাকার জন্য প্রতিদিন সাতঘণ্টা ধরে যাতায়াত করতে হয়। ভোর পাঁচটায় উঠে রান্না করে তারপর আসেন, আবার বাড়ি ফিরে ১০ বছরের মেয়েকে নিয়ে পড়তে বসেন। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে লড়াই করে পড়াশুনো চালিয়েছেন। সারাদিনের কাজকর্ম সেরে সারারাত পড়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন। এখন প্রতিবেশীদের কটাক্ষ শুনতে হয়, সত্যি যদি পাশ করতো নিশ্চয়ই চাকরি পেত”
ছবি: Subrata Goswami/DW
পড়ানো সেরে বিক্ষোভে
হাবড়ার জয়া খাঁ। বাবা মা আর মেয়ে এই তিনজনের পরিবার। বাবা মা দুইজনেই অসুস্থ। সকালে ছাত্র পড়িয়ে বিক্ষোভে যোগ দেন। পাঁচটা পর্যন্ত থাকেন, আবার বাড়ি ফিরে টিউশনি করাতে চলে যান। একটু ভালো খবরের অপেক্ষায় বসে থাকেন বাবা মা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
স্বামী-সন্তান নিয়ে
নাজমুন নাহার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। উত্তর চব্বিশ পরগণায় বাড়ি হলেও স্কুল বাঁকুড়ায়। ইনিও এসএসসির মেধাতালিকায় রয়েছেন। গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছেন তাই প্রতিদিন বিক্ষোভে যোগ দেন। স্বামী মাহসুজার রহমান চাকরিপ্রার্থী না হলেও স্ত্রীর লড়াইতে তিনিও সামিল। সন্তান নিয়ে অবস্থান বিক্ষোভে উপস্থিত থাকছেন প্রতিদিন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
চাষ অবহেলা করে
তপন কুমার মাহাতো জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রাম সিমলাপাল থেকে ধরণায় এসেছেন। প্রতিদিন যাতায়াত সম্ভব নয় বলে বারুইপুরে অনেকের সঙ্গে থাকেন। গ্রামের বাড়িতে সামান্য কিছু জমি রয়েছে, তাতে চাষবাস চললেও এই আন্দোলনের ফলে তাতে ব্যাঘাত ঘটেছে। বন্ধুদের থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তপন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আয়ুষির ক্ষোভ
দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা আয়ুষি দাসের ক্ষোভ, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছের মানুষ হয়ে ফেল করা প্রার্থীরা, এমনকি পরীক্ষা না দেওয়া লোকজনও চাকরি করছে, আর তারা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন”
ছবি: Subrata Goswami/DW
অভিযোগ ও বিক্ষোভ
ইংরাজি বিষয়ের চাকরিপ্রার্থী পলাশ মণ্ডল। বললেন, যারা ওয়েটিং লিস্টে থাকল আর যারা এমপ্যানেলড হলো, কেউ জানেনা আসল রহস্যটা কী। পুরোটাই ধোঁয়াশা। যারা পাশ করেছে তারাও জানেনা কত নম্বর পেয়েছে আর যারা ফেল করেও চাকরি করছে তারা জানেনা কত তাদের নম্বর”
ছবি: Subrata Goswami/DW
14 ছবি1 | 14
আপত্তি তখনই ওঠে, যখন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, আত্মীয়, অনুগামীদের সব নিয়ম ভেঙে চাকরি দেয়া হয়। যে অভিযোগটা এসএসসি কেলেঙ্কারিতে উঠেছে। হাইকোর্টের বিচারপতি মন্তব্য করেছেন। তৃণমূল মন্ত্রীর মেয়েকে যে সব নিয়ম ভেঙে চাকরি দেয়া হয়েছিল, সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে। আদালতের হস্তক্ষেপে তার চাকরি গেছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নিই যে, বামেদের আমলে সিপিএমের মুখপত্রের সঙ্গে জড়িত কর্মীর স্ত্রীদের বেআইনিভাবে চাকরি দেয়া হয়েছিল, তাহলেও কি বর্তমান সরকারের আমলে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি ঢাকা যায়? আমরা তো ছোটবেলা থেকে এটাই শিখে আসছি, একটা ভুল দিয়ে অন্য ভুলকে ঢাকা যায় না। কোনো কাজ অন্যায় হলে রাম করলেও অন্যায়, শ্যাম করলেও অন্যায়। সেই অন্যায় বন্ধ না করে শুধুই অভিযোগ করলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে বলে তো মনে হয় না।
শিল্প কোথায়?
২১ জুলাইয়ের সভাতে মমতা শিল্প ও উন্নয়নপ্রকল্প নিয়ে অনেক ভালোভালো কতা শুনিয়েছেন। কিছুদিন আগে বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলন হয়েছে। সারা দেশের ও বিদেশের শিল্পপতিরা এসেছেন। প্রচুর সমঝোতাপত্র সই হয়েছে। এতদিন ধরে শিল্পসম্মেলনে যত সমঝোতাপত্র সই হয়েছে, তা রূপায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পে ভেসে যেত। কিন্তু গলির মোড়ের চপ ও ঝালমুড়ি শিল্প ছাড়া, আর কোনো শিল্পেরই তো রমরমা নেই।
চাকরি রেডি
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ১৭ হাজার শিক্ষকের চাকরি রেডি। আদালত বললেই তিনি চাকরি দিয়ে দেবেন। তিনি চাকরি দেন, বিজেপি চাকরি নিয়ে নেয়।
ঘটনা হলো, গত কয়েক বছর ধরে চাকরিপ্রার্থীরা পশ্চিমবঙ্গে কম আন্দোলন করছেন না। শিক্ষকদের আন্দোলন তো আছেই, তার পাশাপাশি নার্স, পুলিশের কনস্টেবল সহ অনেকেই বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। পূর্ণ সময়ের চাকরি বন্ধ রেখে সিভিক ভলেন্টিয়ার্স, পার্ট টাইম শিক্ষক ও অধ্য়াপকের মতো কম খরচের নিয়োগে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে রাজ্য। আর নিয়োগ নিয়ে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। ধরে নিলাম, আদালতে মামলা চলছে বলে ১৭ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি দেয়া যাচ্ছে না, কিন্তু বাকিদের চাকরি দিতে তো কোনো অসুবিধা নেই। সেখানে কেন চাকরি দেয়া হচ্ছে না? সরকারি নিয়োগে কড়াকড়ির কারণ, আর্থিক সংকট। ভোটে জেতার জন্য দুই হাতে বিনা পরিশ্রমে মানুষকে সামান্য টাকা দিচ্ছেন মমতা। ফলে লক্ষ্মীর ভান্ডারে নারীরা পাঁচশ টাকা পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সরকারের ভান্ডার খালি হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রের বিমা প্রকল্প আছে, কিন্তু মমতা জেদ করে রাজ্যের বিমা প্রকল্প চালু করেছেন। কৃষকদের কেন্দ্রের টাকা না দিতে দিয়ে, নিজে কিছু সুবিধা দিচ্ছেন। এরফলে নতুন করে সরকারি নিয়োগ প্রায় বন্ধ রাখতে হয়েছে।
মুড়িতে জিএসটি
সম্প্রতি জিএসটি কাউন্সিল প্যাকেটের মুড়ি সহ একাধিক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের উপর জিএসটি বসিয়েছে। সেই মুড়িতে জিএসটির প্রসঙ্গ তুলে মমতা প্রশ্ন করেছেন, ''মানুষ খাবে কি?'' তিনি স্লোগান দিয়েছেন, ''আমাদের মুড়ি ফিরিয়ে দাও, নইলে বিজেপি বিদায় নাও।'' রাজনৈতিক স্লোগান তিনি দিতেই পারেন, ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে প্রয়ুর স্লোগান তিনি দিয়েছেনও। কিন্তু চণ্ডীগড়ে জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে যেখানে একগুচ্ছ জিনিসের উপর জিএসটি বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেথানে কি পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি ছিলেন না? বৈঠক শেষ হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন স্পষ্ট দাবি করেছিলেন, সব রাজ্যের সম্মতিতে জিএসটি বাড়ানো হয়েছে। সেই সব রাজ্যের মধ্যে তো পশ্চিমবঙ্গও থাকবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দাবিমতো, সকলেরই জিএসটি বাড়ানোর প্রস্তাবে সম্মত ছিল। তাহলে?
আনিস থেকে হাঁসখালি, তদন্ত কোথায় দাঁড়িয়ে
ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যু থেকে শুরু করে বগটুই, হাঁসখালি পর্যন্ত একের পর এক ঘটনার তদন্ত এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আনিস নিয়ে রিপোর্ট পেশ
গত মঙ্গলবার আনিস খানের মৃত্যু নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে প্রোগ্রেস রিপোর্ট পেশ করেছে পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল(সিট)। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একজন হোমগার্ড ও একজন সিভিক ভল্যান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে তারা। দুইজন এখন বিচারবিভাগীয় হেফাজতে আছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কী জানিয়েছে সিট
সিট ৮২ পাতার রিপোর্ট পেশ করেছে। সেখানে তারা তদন্তের বিবরণ দিয়ে জানিয়েছে, এখন তাদের তদন্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে। হাইকোর্টে আগামী ২৫ এপ্রিল আবার মামলার শুনানি হবে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন বাবা
আনিসের বাবা সালেম খান বলেছেন, রাজ্য পুলিশের উপর তার কোনো ভরসা নেই। তার অভিযোগ, পুলিশই তার ছেলেকে মেরেছে। তাই তিনি সিবিআই তদন্ত চান। যদি দরকার হয়, তার জন্য তিনি সুপ্রিম কোর্টে যাবেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ক্ষমা চাইতে হবে
বিচারপতি রাজশেখর মান্থা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সালেম খান নানা ধরনের কথা বলছেন। তার মধ্যে বেশ কিছু কথা আপত্তিকর। সালেম খানকে হলফনামা দিয়ে ক্ষমা চাইতে বলেছেন তিনি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বগটুই নিয়ে সিবিআই
রামপুরহাটের বগটুই-কাণ্ডের তদন্ত করছে সিবিআই। দুইটি ঘটনার আলাদা তদন্ত হচ্ছে। একটা ভাদু শেখের হত্যার এবং অন্যটি গ্রামে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারার। এখনো পর্যন্ত মোট ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে সিবিআই করেছে জনা সাতেককে। বাকিদের পুলিশ আগে করেছিল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মুম্বই থেকে গ্রেপ্তার
গত ৭ এপ্রিল মুম্বই থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করে সিবিআই। অভিযোগ, এই চারজন মূল অভিযুক্ত লালন শেখের ঘনিষ্ঠ ও বগটুই-কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া সমীর শেখ নামে একজনকে প্রথমে দীর্ঘ জেরা করার পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উপরের ছবিতে বগটুইতে তদন্তরত সিবিআই অফিসাররা ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হাঁসখালির তদন্ত
হাঁসখালিতে তৃণমূল নেতার বাড়িতে তার ছেলের ঘরে গিয়ে বিছানার চাদর ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছে সিবিআই। সূত্র জানাচ্ছে, যেহেতু মেয়েটির দেহ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তাই এখানে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে অসুবিধা হচ্ছে। এই অবস্থায় বিছানার চাদর ও রক্তের নমুনা খুবই কাজে লাগবে বলে সিবিআই মনে করছে। উপরের ছবিতে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতার ছেলেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কতদিন লাগবে?
সিবিআইয়ের হাতে প্রচুর মামলা রয়েছে। ফলে হাঁসখালির তদন্ত কবে শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে সূত্র জানাচ্ছে, হাঁসখালি হলো ওপেন অ্যান্ড শাট কেস। ফলে খুব বেশিদিন লাগার কথা নয়। উপরের ছবিতে হাঁসখালি গ্রাম।
ছবি: Subrata Goswami/DW
তপন কান্দু হত্যার তদন্ত
পুরুলিয়ায় কংগ্রেস পুরসভা সদস্য তপন কান্দু হত্যা নিয়েও সিবিআই তদন্ত করছে। এই মামলায় এক প্রত্যক্ষদর্শীকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখা গেছে। তার মোবাইল পাওয়া যাচ্ছিল না। পুলিশ বৃহস্পতিবার তা উদ্ধার করেছে। কল-লিস্ট খতিয়ে দেখে বেশ কিছু সূত্র পাওয়ার ব্যাপারে তারা আশাবাদী। এই ঘটনায় কর্তব্যে গাফিলতির দায়ে চারজন পুলিশ কর্মীকে ক্লোজ করেছে রাজ্য সরকার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
এসএসসি দুর্নীতি
এই মামলায় চারজনকে জেরা করেছে সিবিআই। সবে তারা তদন্ত শুরু করেছে। এখনো পর্যন্ত এই মামলায় তারা খুব একটা এগোতে পারেনি বলে সূত্র জানাচ্ছে।
ছবি: Central Bureau of Investigation
অনুব্রত মণ্ডল
সিবিআই গরুপাচার ও কয়লাকাণ্ড নিয়ে অনুব্রতকে জেরা করার জন্য ডেকেছিল। কিন্তু বীরভূমের তৃণমূল নেতা কলকাতা এসে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অনুব্রত চিকিৎসাধীন। সিবিআই তারপর আর এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
11 ছবি1 | 11
'টাকা তুললে পুলিশকে জানান'
তৃণমূলের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তৃণমূল বৈভব দেখানোর জায়গা নয়। দু-একটা অভিযোগ তিনি পেয়েছেন। তার হুঁশিয়ারি, তৃণমূলের নাম করে কেউ টাকা তুলবেন না। টাকা তুলতে দেখলে সোজা থানায় জানাবেন। তাকে ধরে থানায় নিয়ে যাবেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশমন্ত্রীও। তিনি তোলাবাজির কয়েকটা অভিযোগ পেয়েছেন। তারপর কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? একটু কান পাতলেই তো মুখ্যমন্ত্রী শুনতে পেতেন, সিন্ডিকেটরাজ নিয়ে, তোলাবাজি নিয়ে, গুণ্ডামি নিয়ে মানুষের মতটা কি ? সবকিছুই যে বিরোধীদের প্রচার বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না, সেটা তো তিনি স্বীকারই করে নিলেন, টাকা তোলার কথা বলে। এখন টাকা তুলতে দেখলে, তোলাবাজি করতে দেখলে কে থানায় অভিযোগ করবে? মানুষের প্রাণের ভয় নেই না কি? উপর থেকে নির্দেশ না এলে থানা কি একজন তৃণমূল কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে? এককথায় জবাবটা হলো না, পারে না। আর তৃণমূল নেতাদের বৈভবের ছবিটাও যে মাঝেমধ্য়ে সামনে এসে যাচ্ছে। রামপুরহাটকাণ্ডের পর এক তৃণমূল নেতার প্রাসাদোপম বাড়ির ছবি সামনে এসেছে। এসব থেকে কী বোঝা যাচ্ছে? এভাবে সব দায় মানুষের উপর চাপিয়ে না দিয়ে, মুখ্যমন্ত্রীরও তো উচিত কিছু ব্যবস্থা নেয়া।
'এক ছাতার তলায়'
মমতা বলেছেন, ২০২৪-এর নির্বাচনে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তারপর অন্যান্য দল এক ছাতার তলায় আসবে। তার মানে, ভোটের আগে বিরোধী জোট হবে না? অর্থাৎ, বিরোধীদের একজোট করার জন্য মমতা যে চেষ্টা করছিলেন, দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ঠিক করার জন্য বৈঠক পর্যন্ত ডাকলেন, সে সবই ব্যর্থ হলো। না কি, উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূল যে ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেসব ঢাকার জন্য এই কথা। কারণ, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরেোধী দলের প্রার্থী মার্গারেট আলভাকে ভোট না দেয়ার অর্থ হলো, বিরোধীদের সঙ্গে না থাকা। এমনকি বিরোধীরা এই সমালোচনাও শুরু করেছেন, মমতা ধনখড়ের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন না বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তাহলে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে কি মমতা শুধুই দায় এড়ানোর চেষ্টা করে গেলেন?