একাধিক দুর্নীতির মামলার সূত্রে পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় সংস্থার তৎপরতা চোখে পড়ার মতো৷ এই পরিস্থিতিতে বোমা ফাটালেন কেজরিওয়াল৷ জনসভায় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘‘লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি এজেন্সি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত সোরেন, তেজস্বী যাদবের মতো বিরোধীদের নেতাদের গ্রেপ্তার করার ছক এঁটেছে, যাতে কেন্দ্রের শাসক দল নির্বাচনে জিততে পারে৷’’
আবগারি দুর্নীতির মামলায় জেলে রয়েছেন দিল্লির সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী, কেজরিওয়ালের ‘ডান হাত' মণীশ৷ সমনের মুখে পড়া আম আদমি পার্টির শীর্ষ নেতা কেজরিও গ্রেপ্তার হতে পারেন, এমন দুশ্চিন্তা আছে আপ নেতৃত্বের৷ তারই মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তারির আশঙ্কা৷
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল মন্ত্রিসভার দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা৷ এখন জেলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক৷ তৃণমূলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার সিবিআই ও ইডি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েছেন৷
মমতা ও অভিষেক একাধিকবার গ্রেপ্তার নিয়ে কথা বলেছেন৷ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আগেই শোনা গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মুখে৷ জ্যোতিপ্রিয়ের গ্রেপ্তারের পর মমতা বলেন, ‘‘বিজেপির লক্ষ্য হল সব বিরোধী নেতাদের জেলা পোরা৷ যাতে বিরোধীশূন্য দেশে বিনা বাধায় ভোটে জিততে পারে তারা৷’’ অভিষেক বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সংস্থা দিয়ে আমাদের ধমকানো-চমকানো হচ্ছে৷ গ্রেপ্তার করলেও আমরা মাথা উঁচু করে থাকব৷’’
বিরোধী নেতারা বারবার বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছে৷ কেন্দ্রীয় সংস্থা দিয়ে হেনস্থা করার নালিশ জানিয়েছে৷ চলতি মাসেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ ভাই জেলের পথে, দিদিও ভবিষ্যতে সেখানে যাবেন৷''
তৃণমূলের প্রশ্ন, বিজেপি নেতারা কীভাবে ঠিক করে দিচ্ছেন কে জেলে যাবেন? তৃণমূল মুখপাত্র শান্তনু সেনের বক্তব্য, ‘‘বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে কেন তদন্ত হয় না? বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সারদা ও নারদ মামলায় অভিযুক্ত৷ তাকে কেন সিবিআই, ইডি একবারও ডাকে না?'' এই প্রসঙ্গে বারবার মমতা মুখে শোনা গিয়েছে ‘ওয়াশিং মেশিনের' তত্ত্ব৷ তার দাবি, বিজেপিতে যোগ দিলে সব অভিযোগ ধুয়েমুছে যায়!
বিরোধী জোটে প্রশ্ন
বিজেপির বিরুদ্ধে 'ইন্ডিয়া' জোট গড়ে এক জোট হয়েছে কংগ্রেস, তৃণমূল, বাম-সহ অনেকগুলি দল৷ কিন্তু কংগ্রেস বা বাম নেতৃত্ব কি কেজরিওয়ালের দাবির সঙ্গে একমত? পশ্চিমবঙ্গে তো নয়ই৷ দিল্লির প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব কেজরিওয়ালের বিরোধী৷ ফলে আপ সুপ্রিমোর বক্তব্য ঘিরে বিরোধী জোটে ফাটল আবার সামনে এসেছে৷
বিজেপি সব বিরোধী নেতাকে চাপে রাখতে চাইছে: সুমন ভট্টাচার্য
This browser does not support the audio element.
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘আদালতের নির্দেশে তদন্ত চলছে, কারো কথায় নয়৷ যাকে প্রয়োজন মনে হবে, তাকে ডাকতে পারে তদন্তকারী সংস্থা৷ গ্রেপ্তারও করতে পারে৷'' প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায় বলেন, ‘‘এখানে তদন্তের নামে খেলা চলছে৷ তাই মাথাদের ইডি, সিবিআই ধরবে না৷ ছোটখাটো নেতাদের পাকড়াও করবে৷’’
অভিযোগ না নিশানা?
বিজেপির সমালোচক বলেই বিরোধী নেতারা ‘হেনস্থার' মুখে, এই তত্ত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে৷ পশ্চিমবঙ্গে মন্ত্রী ঘনিষ্ঠের বাড়িতে মিলেছে কোটি কোটি টাকার নগদ৷ কোনো মন্ত্রীকন্যার সম্পত্তি বৃদ্ধি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে৷ এক দাপুটে নেতা নেতা কোটি কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করেছেন ব্যাংকে৷
এমন নানা তথ্য ও দাবি শোনা যাচ্ছে সিবিআই ও ইডি-র তদন্তে৷ কোনো সরকার নয়, আদালত কেন্দ্রীয় সংস্থাকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক দুর্নীতি মামলায়৷ এর পাশাপাশি আপ নেতা সিসোদিয়া বা অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগকেও কি একই চোখে দেখা হবে?
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিজেপি সব বিরোধী নেতাকে চাপে রাখতে চাইছে৷ এই কৌশলে গলদ আছে৷ যদি ধরে নিই, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বিরুদ্ধে রেশন দুর্নীতির অভিযোগ সারবত্তা আছে, কিন্তু অন্যান্য রাজ্যে কেন্দ্রীয় সংস্থার ভূমিকা প্রকৃত অভিযোগের গুরুত্ব লঘু করে দিচ্ছে৷’’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘মহারাষ্ট্রে অভিযুক্ত এনসিপি নেতারা বিজেপির পাশে দাঁড়ালেন, তারপর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভুলে গেল তদন্তকারী সংস্থা! শাসকের পক্ষে থাকলে অসুবিধা হচ্ছে না৷ তাই কে অপরাধী আর কাকে টার্গেট করা হচ্ছে, দুটো এক জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে৷’’
দেখুন সেপ্টেম্বরের ছবিঘরটি...
সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিরোধী জোটের আসন সমঝোতা
ভারতের প্রধান বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার তৃতীয় বৈঠক চলছে মুম্বইতে। ২৮ দলের ৬৩ জন নেতা বৈঠকে উপস্থিত।
ছবি: Indian National Congress
পাটনা, বেঙ্গালুরুর পর মুম্বই
প্রথম বৈঠক হয়েছিল পাটনায়। তারপর বেঙ্গালুরুতে জোটের নাম ঠিক হয়, ইন্ডিয়া। ২৮টি দল একজোট হয়ে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এবার মুম্বইতে জোটের তৃতীয় বৈঠকে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। উপরের ছবিটি বেঙ্গালুরু বৈঠকের।
ছবি: Bihar state Chief Minister's Office/AP/picture alliance
আসন বন্টন নিয়ে সিদ্ধান্ত সেপ্টেম্বরেই
ঠিক হয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই জোট শরিকেরা নিজেদের মধ্যে আসন বন্টনের বিষয়টি চূড়ান্ত করে ফেলবেন। এনিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু কথা হয়েছে পাটনা ও বেঙ্গালুরুর বৈঠকে। বৃহস্পতিবার মুম্বইতে ঠিক হয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তারা আসন বন্টন শেষ করে ফেলবেন।
ছবি: MOHAN KUMAR/AFP
রাহুল-অভিষেক কথা
মুম্বই যাওয়ার আগে দিল্লি এসেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার ভোরে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন অভিষেক। তাদের মধ্যে এক ঘণ্টা ধরে কথা হয়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের বিষয়েই কথা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ও আসন বন্টনের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে।
ছবি: Congress Party/AP Photo/picture alliance
অধীর যা বলেছেন
লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা ও পশ্চিমবঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আগে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ হলো পুকুর, আর দেশের রাজনীতি হলো নদী। কংগ্রেস এখন নদী নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তবে অধীর এখনো রাজ্যে তৃণমূল ও মমতার কড়া সমালোচনা করছেন। দত্তপুকুর বিস্ফোরণ নিয়েও করেছেন।
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
কংগ্রেস যেখানে প্রধান বিরোধী
মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, গুজরাট, কেরালা, হরিয়ানা, ত্রিপুরা, গোয়ার মতো কিছু রাজ্যে লড়াইটা সরাসরি বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে। কংগ্রেস এখানে মূল বিরোধী দল। সেখানে অন্য বিরোধী দলের শক্তি খুব বেশি নয়। ফলে সেখানে সামান্য কিছু আসন তাদের ছাড়তে হতে পারে কংগ্রেসকে। কিন্তু দিল্লি নিয়ে সমস্যা আছে। দিল্লিতে আপ ও কংগ্রেস জোট করে লড়বে কি না, তা নির্ভর করছে, কেজরিওয়াল ও রাহুল গান্ধীর উপর।
ছবি: Pradeep Gaur/SOPA/Zuma/picture alliance
কংগ্রেস যেখানে ক্ষমতায়
ছত্তিশগড়, রাজস্থান, কর্ণাটক, হিমাচলে কংগ্রেস এককভাবে ক্ষমতায় আছে। এর মধ্যে রাজস্থান, কর্ণাটকে আপ আসন চাইতে পারে। তবে দুই রাজ্যেই তাদের শক্তি খুবই কম। এনসিপি কিছু আসনের দাবিদার। ফলে এখানেও খুব বেশি আসন ছাড়তে হবে না কংগ্রেসকে। উপরের ছবিটি কর্ণাটকে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার।
ছবি: IANS
মহাজোটের রাজ্যে
মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ুতে মহাজোট আছে। কংগ্রেস তার শরিক। এই রাজ্যগুলিতেও আসন বন্টন নিয়ে খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উপরের ছবিতে বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ ও রাবড়ি দেবী। বিহারের মহাজোটে আছে কংগ্রেসও।
ছবি: Santosh Kumar/Hindustan Times/IMAGO
উত্তরপ্রদেশ নিয়ে
উত্তরপ্রদেশ নিয়ে সমস্যা আছে। সেখানে সমাজবাদী পার্টি প্রধান বিরোধী দল। তারা এখনো পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাতে চায় না। সেক্ষেত্রে আসন সমঝোতা হবে নাকি দুই দল কৌশলগত সমঝোতা করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
ছবি: Samiratmaj Mishra/DW
বামেরা কী করবে?
সিপিএম জানিয়ে দিয়েছে, তারা পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালায় কোনো জোটে যাবে না। তারা জাতীয় স্তরে জোটে থাকবে। এই অবস্থান বদলের সম্ভাবনা কম। পশ্চিমবঙ্গে তারা আইএসএফের সঙ্গে সমঝোতায় আছে। কংগ্রেসের সঙ্গেও তাদের অঘোষিত সমঝোতা রয়েছে। কেরলে তারা ক্ষমতায়। সেখানে তারা বা কংগ্রেস কেউই জোটে যেতে রাজি নয়।
ছবি: Sandip Saha/Pacific Press/picture alliance
অন্য রাজ্যে
তেলেঙ্গানায় লড়াইটা হবে টিআরএসের সঙ্গে কংগ্রেসের। তবে অন্ধ্রে লড়াই হওয়ার কথা ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সঙ্গে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশমের। নাইডু বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির পরিস্থিতি আলাদা। সেখানে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দল। দু-একটা রাজ্যে তৃণমূল আছে। আছে কিছু আঞ্চলিক দলও। উপরের ছবিতে তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও।
ছবি: Ians
জোটের মুখ
জোটের মুখ হিসাবে আগে থেকে কাউকে তুলে ধরা হবে না। তাহলে লড়াইটা মোদী বনাম তার বিরুদ্ধে হবে। বিরোধী নেতারা চাইছেন, লড়াইটা এনডিএ বনাম ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে হোক। তবে জোটের আহ্বায়ক হিসাবে নীতীশ কুমার ও মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম শোনা যাচ্ছে।
ছবি: Bihar Chief Ministers Office/AP/picture
কংগ্রেস চাইছে
সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী এবার এই জোট নিয়ে চলতে চান। তাই খুব ভেবেচিন্তে প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে, বিরোধের জায়গাগুলিকে সরিয়ে রেখে যে সব বিষয়ে মতৈক্য হতে পারে, সেই জায়গাগুলি বেছে নিতে।