মমতার শর্ত, তিস্তা নিয়ে আলোচনা নয়!
৬ জুন ২০১৫আগেরবার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার কথা থাকলেও, একেবারে শেষ মুহূর্তে মমতা নাকি বেঁকে বসেছিলেন৷ যদিও পরে মমতা বলেছেন অন্য কথা৷ দিল্লি থেকেই তাঁকে নাকি বলা হয়েছিল, যেতে হবে না৷ গুছিয়ে রাখা সুটকেস খুলে ফেলতে হয়েছিল, দুঃখে চোখে জল এসে গিয়েছিল, ইত্যাদি৷
কিন্তু তখনই যেটা জানা গিয়েছিল, ভারত চাইছে, ছিটমহল বিনিময়, তিস্তার জলবণ্টন, বাণিজ্য করিডোর, ইত্যাদি বাংলাদেশের সঙ্গে বকেয়া সবকটি দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে৷ একমাত্র সেই কারণেই একজন রাষ্ট্রপ্রধানের বিদেশ সফরে একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নেওয়ার সিদ্ধান্ত৷ যেহেতু বিষয়গুলি দুই দেশের মধ্যে হলেও পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সীমান্তের এক বড় অংশের লাগোয়া৷ সীমান্ত চুক্তি হোক বা জলবণ্টন, তার প্রথম ও প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গে৷
কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ে সায় থাকলেও তিস্তার জল বা পানি ভাগ করে নেওয়ার প্রশ্নে একেবারে বেঁকে বসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং শর্ত দেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হতে চান একমাত্র তখনই, যখন প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশে কোনো আলোচনা হবে না৷ সেই শর্ত মানতে নারাজ ছিলেন মনমোহন সিং, ফলে ভেস্তে যায় মমতার যাওয়া৷
এবারও নাকি একই শর্ত দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে তিস্তার জল নিয়ে আলোচনা নয়৷ বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সাত তাড়াতাড়ি বলেছেন, না না, তিস্তা নিয়ে কোনো কথাই হবে না৷ মমতাও বিবৃতি দিয়ে রেখেছেন, তিস্তা নিয়ে আলোচনা করবেন না৷ এবং পাছে তাঁকে কোনো আলোচনার টেবিলে ডেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়, সেইজন্যে ঢাকায় ঠিক আধবেলা থাকবেন মমতা, যাতে কেবল স্থলসীমান্ত চুক্তি সইয়ের সময় তিনি হাজির থাকতে পারেন৷
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, তা হলে যাচ্ছেন কেন মমতা? ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই বা কেন একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিতে এত আগ্রহী? কারণ স্থলসীমান্ত চুক্তি দুটি দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ের নিষ্পত্তি৷ সেই চুক্তির খুঁটিনাটি দিকগুলিও দু'দেশের বিদেশ মন্ত্রকের সচিব স্তরের বৈঠকে আগেই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে৷ দুই রাষ্ট্রপ্রধান আনুষ্ঠানিকভাবে সেই চুক্তিতে সই করবেন মাত্র৷ সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো ভূমিকাই নেই৷
তবু কেন মমতা বাংলাদেশ যাচ্ছেন, মোদীর সফরসঙ্গী না হয়েও, আলাদাভাবে কিন্তু একই সময়ে কেন যাচ্ছেন, সেই ধোঁয়াশায় একটি ক্ষীণ সম্ভাবনার আলোকরেখাই কেবল দেখা যাচ্ছে৷ নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার চায়, যদি তিস্তা জলবণ্টনের পুরনো সমস্যা এখনই মেটানো নাও যায়, সীমান্তপার জঙ্গি যাতায়াত এবং সন্ত্রাসকে দমন করাটা অত্যন্ত জরুরি৷ শুধু স্থলসীমান্ত চুক্তি করলেই হবে না, সেই সীমান্তের মান্যতা রক্ষা করে জঙ্গি উপদ্রবও রুখে দিতে হবে৷ কারণ ভারত – বাংলাদেশ, দু'দিকেই শোনা যাচ্ছে স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় উগ্রপন্থাকে জিইয়ে রাখা, প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ৷
আর এখানেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷ উগ্রবাদকে প্রশ্রয় না দেওয়াটা পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহযোগিতার ব্যাপার, কোনো চুক্তি করে সেটা সম্ভব নয়৷ কিন্তু বারবারই অভিযোগ উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু ভোটব্যাংকের দিকে তাকিয়ে এমন কিছু লোক, কিছু কাজের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকছেন, প্রকারান্তরে প্রশ্রয়ই দিচ্ছেন, যা সেই বোঝাপড়া তৈরি হতে দিচ্ছে না৷ বাংলাদেশে মৌলবাদবিরোধী শক্তি সরাসরি অভিযোগ করেছে, সেদেশে যখন জঙ্গিপনার বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার, ধরপাকড় শুরু হচ্ছে, তখন অপরাধীরা সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে ঘাঁটি গাড়ছে৷ এই রাজ্যে তারা নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে৷
যদি খেয়াল করে দেখেন, সম্প্রতি ত্রিপুরা সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তৈরি করেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার৷ ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বিচক্ষণ এবং অতি দায়িত্বশীল প্রশাসক৷ সীমান্তপার সন্ত্রাস রুখতে তাঁর সহযোগিতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের কোনো সংশয় বা উদ্বেগ থাকার কথা নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন আছে যাঁর ভূমিকা নিয়ে, তাঁকে এবার প্রক্রিয়াটার সঙ্গে যুক্ত করতে চায় সরকার৷ স্থলসীমান্ত চুক্তি মজবুত এবং নিশ্ছিদ্র করাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সামনে এখন পাখির চোখ৷ তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে তিনি সম্ভবত ভাবছেন না৷