তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপধ্যায়ের সঙ্গে কি প্রশান্ত কিশোরের সম্পর্ক এবার ছিন্ন হচ্ছে? দলের ভিতরে আলোচনা তুঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
বিরোধ শুরু হয়েছে জেলায় জেলায় পুরভোটে তৃণমূলের প্রার্থীতালিকা নিয়ে। যে প্রার্থীতালিকা একবার ওয়েবসাইটে উঠে গিয়েছিল, তাতে প্রচুর ভুল রয়েছে বলে পরে জানানো হয়। অভিযোগ, সেই প্রার্থীতালিকা পিকে-র করা। তবে সূত্রের খবর, জেলার পুরভোট নিয়ে পিকে কোনো সমীক্ষা করেননি। প্রার্থীতালিকা করেননি। ওই প্রার্থীতালিকা আসলে অভিষেকের করা। তৃণমূলের অভ্যন্তরে সম্প্রতি অভিষেক বনাম প্রবীণ নেতাদের লড়াই বা বিতর্ক শুরু হয়েছে। কংগ্রেসে রাহুল গান্ধীকে যেমন প্রবীণ নেতাদের বিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে, তেমনই অভিষেকের বিরোধ করছেন তৃণমূলের প্রবীণ নেতারা। আর পিকে-কে যেহেতু অভিষেক তৃণমূলে নিয়ে এসেছিলেন, তাই তাঁকে আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে।
পিকে তৃণমূলের হয়ে ভোটের কৌশল তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন ২০১৯ সালে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পিকে-র গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ভোট কৌশল, প্রার্থী বাছাই, কোন বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে, দলিত, আদিবাসীদের ভোট পেতে কোন কৌশল নিতে হবে থেকে শুরু করে প্রায় সব বিষয়েই তার বা তার সংস্থা আইপ্যাকের মতামত গুরুত্ব পেয়েছে। তারপর মমতাকে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নেতা হিসাবে তুলে ধরার কাজও পিকেই করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে লড়ছেন মমতা
আগামী ২৭ মার্চ থেকে আট পর্বের বিধানসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে। কেমনভাবে লড়ছেন গত দশ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: Prabhakarmani Tewari/DW
মমতাই প্রথম
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমেই ২৯১টি কেন্দ্রে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দিয়েছেন। পাহাড়ের তিনটি আসন ছেড়ে দিয়েছেন শরিক গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে। বিজেপি ও বাম জোট প্রথম দুই দফার প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। এক্ষেত্রে তিনি বাকিদের থেকে এগিয়ে রইলেন।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
বাদ ৬৪ জন বিধায়ক
এবার কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। গতবারের ৬৪ জন বিধায়ককে এবার আর প্রার্থী করেননি তৃণমূল-সুপ্রিমো। তাদের কেউ বিজেপি-তে গেছেন। অন্যরা জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। সবমিলিয়ে গতবারের তুলনায় শতাধিক প্রার্থী বদল করেছেন মমতা। নেতাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ থাকলে তাকে আর প্রার্থী করা হয়নি। ৮০ বছরের বেশি বয়সীরা বাদ পড়েছেন। তাই অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ভোটে লড়ছেন না। উপরের ছবিটি বাজেট পেশ করার সময় অমিত মিত্রর।
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
নতুন কেন্দ্রে মমতা
মুখ্যমন্ত্রী নিজে লড়ছেন নতুন কেন্দ্র নন্দীগ্রামে। তার আগের কেন্দ্র ভবানীপুরে নয়। বিজেপি-তে যোগ দেয়া তার একদা লেফটন্যান্ট শুভেন্দু অধিকারীর চ্যালেঞ্জ ভোঁতা করে দিতে তিনি এই সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১০ মার্চ তিনি মনোনয়নপত্র পেশ করবেন। নন্দীগ্রামে ইতিমধ্যে বড়সড় জনসভা করেছেন মমতা।
ছবি: DW
কম মুসলিম প্রার্থী
গতবারের তুলনায় এবার তৃণমূলে মুসলিম প্রার্থীদের সংখ্যা কম। তৃণমূল এবার ৪৭ জন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছে। গতবার দিয়েছিল ৫৭ জন। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের অভিযোগ, হিন্দুরা ক্ষুব্ধ বুঝে মুসলিম প্রার্থী কমিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। পশ্চিমবঙ্গে ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট আছে।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
প্রচার মমতাময়
তৃণমূলের প্রচার মমতাময়। মুখ্যমন্ত্রী সবকটি কেন্দ্রে প্রচারে যাবেন। জনসভা করবেন। পদযাত্রাও। ইতিমধ্যে কলকাতা ও শিলিগুড়িতে পদযাত্রা করে ফলেছেন। তাই নন্দীগ্রামে তিনি বেশি সময় দিতে পারবেন না, তা আগেই জানিয়ে এসেছেন। সেখানে তার ভোটের দায়িত্বে পূর্ণেন্দু বসু।
ছবি: DW/Sirsho Bandopadhyay
আক্রমণাত্মক প্রচার
বিজেপি-র প্রধান দুই নেতা নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ যে অভিযোগ করবেন, তার জবাব দেয়ার কৌশল নিয়েছেন মমতা ও তার ভোট-কৌশলী প্রশান্ত কিশোর। বিজেপি এবার প্রচারে অভিষেককে টার্গেট করেছে। মমতা তার জবাব দিয়েছেন। পাল্টা টেনে এনেছেন অমিত শাহের ছেলে জয় শাহের প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রীকেও আক্রমণ করেছেন।
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
প্রচারের ভাষা
আক্রমণ করতে গিয়ে অনেক সময়ই ভাষার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকছে না তৃণমূল নেতাদের। মোদী-শাহকে হোঁদলকুতকুত ও কিম্ভূতকিমাকার বলেছেন তৃণমূল নেত্রী। এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা নিয়ে আপত্তিও উঠেছে।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
আমল দিচ্ছে না তৃণমূল
অনেকে প্রার্থী হতে পারেননি। অনেকে বাদ পড়েছেন। তা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তুঙ্গে। আরাবুল ইসলাম, সোনালি গুহরা প্রকাশ্যেই মুখ খুলেছেন। তবে এই ক্ষোভ আমল দিতে চাইছেন না মমতা। তিনি এখন নেমে পড়েছেন ভোটের ময়দানে। শুধু একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আবার জিতলে তিনি বিধান পরিষদ বানাবেন। বেশ কিছু নেতাকে বিধান পরিষদের সদস্য করা হবে।
ছবি: Getty Images/D. Sarkar
পিকে-র কৌশল
তৃণমূলের ভোট কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে প্রশান্ত কিশোর বা পিকে-র। তিনি একদিকে সামাজিক মাধ্যমে তৃণমূলকে খুবই সক্রিয় করেছেন। অন্যদিকে কীভাবে বিজেপি-র প্রচারের জবাব দিতে হবে, তার পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রার্থীদের বিষয়ে একের পর এক সমীক্ষা করেছেন। দুর্নীতি ও অন্য অভিযোগ নিয়ে মানুষের ক্ষোভ কমানোর জন্য একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
ছবি: Hindustan Times/Imago Images
কঠিন লড়াই
এবার কঠিন লড়াইয়ের মুখে মমতা। তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বিজেপি। ফলে পশ্চিমবঙ্গের এবারের ভোট খুবই চিত্তাকর্ষক হবে। মমতার সামনেও লড়াই রীতিমতো কঠিন।
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
10 ছবি1 | 10
পিকে বলেছিলেন, ভোটের পর তিনি আইপ্যাক ছেড়ে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। এখনো আইপ্যাকই তৃণমূলের মিডিয়ার দেখভাল করে। ত্রিপুরা, গোয়ায় ভোট কৌশল তৈরির কাজ তারাই দেখছে। কিন্তু ১০৭টি পুরসভায় ভোট নিয়ে তৃণমূলের ওয়েবসাইটে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হওয়া, তারপর তাতে ভুল আছে বলে দল জানিয়ে দেয়া, জেলার জেলায় বিক্ষোভ শুরু হওয়ার মতো ঘটনা নিয়ে উত্তাল তৃণমূল কংগ্রেস। সূত্র জানাচ্ছে, এরই জেরে পিকে তৃণমূলের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান। মমতাও তা মেনে নেন। দলনেত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, সংগঠনের সবকিছু এখন তিনিই দেখবেন।
ঘটনা হলো, এখানে পিকে-র থেকেও তৃণমূলে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, তাহলে অভিষেকের কী হবে? অভিষেক সম্প্রতি জি-বাংলায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ''যারা দল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তারা আবার সুসময়ে দলে ফিরবেন, আর যারা ঘাম-রক্ত ঝড়ালেন, তাদের মাথার উপর বসে যাবেন, এটা আমি হতে দেব না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদারতার কারণে সব্যসাচী দত্ত ঢুকতে পেরেছেন। দলের সিদ্ধান্ত আমাকে মানতে হবে। কিন্তু যারা এভাবে ফিরে আসছেন, তাদের তিন থেকে পাঁচ বছর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।''
পিকে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ''মোদীর হয়েও আইপ্যাক কাজ করেছে। পলিটিক্যাল ম্যানেজমেন্ট বদলেছে। ফলে ২০১৬ সালের পরিস্থিতি আর নেই। এটা বুঝতে হবে।'' ফলে পিকে-কে যে তৃণমূলের দরকার সেটা অভিষেক পরিষ্কার করে দিয়েছেন। প্রার্থীতালিকা নিয়েও অভিষেক বলেছেন, পরের তালিকাতেও ভুল আছে। অভিষেকের কথা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''শেষপর্যন্ত পিকে থাকবেন কি না, সেই প্রশ্নের জবাব পরে পাওয়া যাবে। কিন্তু আপাতত একটি বিষয় স্পষ্ট, তৃণমূলে অভিষেক বনাম প্রবীণ নেতাদের লড়াই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। মমতা এই লড়াই মেটানোর চেষ্টা করছেন ঠিকই, কিন্তু এখনো তা মেটেনি। তার মধ্যে জড়িয়ে গেছে পিকে-র নাম।''