1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মশাবাহিত পাঁচ রোগ

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩১ জুলাই ২০১৭

বাংলাদেশে এখন আলোচনার প্রধান বিষয় চিকুনগুনিয়া৷ একটি দৈনিকের জরিপ বলছে, ঢাকায় প্রতি ১০ জনে একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত৷ তবে বাংলাদেশে মশাবাহিত আরেক রোগ ডেঙ্গুও বাড়ছে৷ মশাবাহিত পাঁচটি রোগ এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশে৷

Brutplätze von Mücken Moskitos
ছবি: DW/M.M.Rahman

মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে এক সময় বাংলাদেশে ম্যালেরিয়াই বেশি পরিচিত ছিল৷ তখন এই ম্যালেরিয়া আতঙ্ক ছিল ঘরে ঘরে৷ এখনো বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় ম্যালেরিয়ায়ার প্রাদুর্ভাবের কথা শোনা যায়৷ সেখান থেকে মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়৷ তারপর আসে ডেঙ্গু৷ এই ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী হলো এডিস মশা৷ ডেঙ্গুর পরে এখন চলছে চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রাদুর্ভাব৷ এই জ্বরে বাংলাদেশে কেউ মারা গেছে বলে চিকিৎসকরা স্বীকার না করলেও, এ রোগ ভোগাচ্ছে মানুষকে৷ হাড়সহ শরীরের গাঁটে গাঁটে ব্যাথায় কাতর হচ্ছেন আক্রান্তরা৷ ‘চিকুনগুনিয়া' নাকি আফ্রিকান ভাষা৷ আর এর অর্থ হচ্ছে, ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যাওয়া৷ আসলেই ব্যাথায় ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যাচ্ছেন রোগীরা৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকুনগুনিয়াসহ তিন ধরনের রোগের জন্য দায়ী এডিস মশা৷ এই মশার প্রজনন ঘরবাড়িতে৷ তারা কামড়ায় দিনের আলোতে৷

মশাবাহিত প্রধান প্রাণঘাতী ১০টি রোগের মধ্যে অন্যতম হলো: ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, এনসেফেলাইটিস এবং লিমফেটিক ফাইলেরিয়াসিস৷ এরমধ্যে এডিস মশা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা – এই যে তিনটি রোগ ছড়ায় তার সবগুলোই বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে৷ ডেঙ্গু ১৯৯৯ সালে প্রথম সনাক্ত হয় ঢাকায়৷ ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া সনাক্ত হয় রাজশাহীর পবায়৷ এবং ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে জিকা শনাক্ত হয়৷

A S M Alamgir - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তবে ম্যালেরিয়া বাংলাদেশে বহু পুরনো রোগ৷ অ্যানোফিলিস মশা এই রোগের বাহক৷ লিমফেটিক ফাইলেরিয়াসিস বা ফাইলেরিয়াও বাংলাদেশে পুরনো রোগ৷ কিউলেক্স প্রজাতির স্ত্রী মশাই প্রধানত এই রোগের জীবানু বহন করে৷

বাংলাদেশে ৯৮ ভাগ ম্যালেরিয়া রোগীই চার পার্বত্য জেলায়৷ বর্তমানে ১৩টি জেলার প্রায় এক কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন৷ সাম্প্রতিক কালের মধ্যে ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৪৫ জন ম্যালেরিয়ায় মারা যান৷ এরপরে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কমেছে৷ ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে৷

দেশে ফাইলেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দেড়লাখের মতো৷ পুরনো এই রোগটি বাংলাদেশের ২৯টি জেলায় বেশি দেখা যায়৷ সরকার এই ২৯ জেলার মধ্যে পাঁচ জেলাকে ফাইলেরিয়ামুক্ত ঘোষণা করেছে৷ ফাইলেরিয়া রোগে আক্রান্তদের একটি অংশ শেষ পর্যন্ত বিকলাঙ্গ হয়ে যায়৷

২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে অন্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে ১০ জন বাংলাদেশি নাগরিকও জিকায় আক্রান্ত হন৷ এরপর থেকে বিমানবন্দরে ওইসব দেশ থেকে আসা যাত্রীদেরও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ গত বছরের মার্চে চট্টগ্রামে জিকায় আক্রান্ত একজন রোগী পাওয়া যায়৷ পরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন৷

বাংলাদেশে এখন চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব চললেও ডেঙ্গু জ্বরও বাড়ছে৷ চিকুনগুনিয়ায় মারা যাওয়ার এখনো কোনো রেকর্ড না থাকলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর নজীর আগে থেকেই আছে৷ 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট থেকে ডেঙ্গু জ্বরের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হয়৷ তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৮১, ফেব্রুয়ারিতে ৫৫, মার্চে ১৮, এপ্রিলে ৫৪, মে মাসে ৯৬, জুনে ১৩৪ জনসহ ৪৩৮ ডেঙ্গু রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে৷ জানা গেছে, ২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় চার হাজার ৭৬ জন, মারা যায় ১৪ জন; ২০১৫ সালে আক্রান্ত তিন হাজার ১৬২, মৃত্যু হয় ছয় জনের৷ এছাড়া ২০১৪ সালে ৩৭৩ জন, ২০১৩ সালে এক হাজার ৪৭৮ জন, ২০১২ সালে এক হাজার ২৮৬ জন, ২০১১ সালে এক হাজার ৩৬২ এবং ২০১০ সালে ৪০৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন৷ গত ছয় বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ও মারা যান৷

রোগের নাম চিকুনগুনিয়া

বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় ২০০৮ সালে, রাজশাহীর পবায়৷ এরপর ২০০৯ থেকে ১২ সাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে কয়েকটি এলাকায় পর্যায়ক্রমে চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যায়৷ ঢাকার কলাবাগান এলাকায় গত বছরের আগস্টে রাজধানীর প্রথম চিকুনগুানিয়া রোগী পাওয়া যায়৷ ডিসেম্বর থেকে আক্রান্ত রোগী বাড়তে থাকে৷

বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়  এ পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ায় কতজন আক্রান্ত হয়েছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ সেই হিসাব রাখার কোনো কেন্দ্রীয় পদ্ধতিও বাংলাদেশে গড়ে উঠেনি৷ তবে আইইডিসিআর এ পর্যন্ত জ্বরের ৮০০টি নমুনা পরীক্ষা করে দেখেছে এবং তার মধ্যে ৬০৫ জনের চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে৷ আর মোবাইল ফোনে সাধারণভাবে ৪,৭৭৫ জনের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের মধ্যে ৩৫৭ জন চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া গেছে৷

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যত রোগী আসেন, তাঁদের ১১ জনের মধ্যে ১ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত৷ আর জ্বরে আক্রান্ত যাঁরা ঢাকা মেডিক্যালে আসেন, তাঁদের প্রতি ৩ জনে ১ জন চিকুনগুনিয়ার রোগী৷ তবে দৈনিক প্রথম আলো সম্প্রতি এক জরিপের ফলাফলের আলোকে দাবি করেছে, ঢাকায় প্রতি ১০ জনে একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত৷ সেই হিসেবে এখানে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কমপক্ষে ১৮ লাখ৷

A B M Abdullah - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর জানান, ‘‘এই অঞ্চলের ট্রপিক্যাল কান্ট্রিগুলোতে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি৷ আর সে কারণে বাংলাদেশও তার বাইরে নয়৷ ম্যালেরিয়া এবং ফাইলেরিয়া এখন আর সারা দেশে নেই৷ ফাইলেরিয়া উত্তরাঞ্চল এবং ম্যালেরিয়া পাহাড়ি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে৷ আর ডেঙ্গুর পর এখন চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বিশেষ করে ঢাকাতেই  দেখা যাচ্ছে৷''

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি দরকার সচেতনতা৷ যে মশা ঘর-বাড়িতে হয়, সেটা তো বাসিন্দাদেরই খেয়াল রাখতে হবে৷''

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন, অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মশাবাহিত রোগের চিকিৎসার কোনো সমস্যা নাই৷ বাংলাদেশে মশাবাহিত সব ধরনের রোগেরই চিকিৎসা আছে৷ কিন্তু চিকিৎসার চেয়ে জরুরি হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ৷ সেটা সবাই মিলে করতে হবে৷ মশা মারতে হবে, দূর করতে হবে৷ মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বন্ধ করতে হবে৷ এ জন্য ঢাকায় সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকার বাইরে পৌরসভা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হবে৷ আমাদের নিজেদেরও দায়িত্ব আছে৷''

তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘আমরা মশা মারার নামে যেসব কেমিক্যাল, স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করছি, তা জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন ক্ষতি ডেকে আনতে পারে৷ তাই আমাদের উচিত হবে প্রাকৃতিক উপায়ে মশার জন্মরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে আনা৷ ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা৷ পানি জমতে না দেয়া৷ ডোবা, নালা, ড্রেন পরিষ্কার রাখা৷''

চিকুনগুনিয়া নিয়ে ঢাকায় রীতিমতো তোলপাড় চলছে৷ হাইকোর্ট এরইমধ্যে চিকুনগুানিয়ায় আক্রান্তদের কেন সরকার ক্ষতিপুরণ দেবে না – তা জানতে চেয়েছে৷ আর সিটি কর্পোরেশ মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত জুমার নামাজের সময় মসজিদে মসজিদে মোনাজাত ও সচেতনতামূলক বয়ানের ব্যবস্থা করেছে৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, তারা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন৷ কিন্তু মশা তো আর তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না৷ এটা সিটি কর্পোরেশনকেই করতে হবে৷

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, সারা বিশ্বে বছরে ১০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে৷ ২০১৬ সালে ম্যালেরিয়াতেই মারা গেছে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ৷ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে আছে ১০০টি দেশের প্রায় ২৫০ কোটি মানুষ৷ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম৷ আর এখন চিকুনগুনিয়া বাংলাদেশের জন্য এই ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ