দেশি এবং অভিবাসী উভয় প্রজাতির রোগ সংক্রমণকারী মশা মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠার কথা জানান জার্মানির লাইবনিজ সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচারাল ল্যান্ডস্কেপ রিসার্চের জীববিজ্ঞানী ডোরিন ভের্নার৷ গবেষক ডোরিন ভের্নারের তথ্যের ভিত্তিতে ফ্রিডরিশ ল্যোফলার ইনস্টিটিউট (এফএলআই) এর গবেষক জানান, আফ্রিকান নীল জ্বরের ভাইরাস স্থানীয় মশার শরীরে শনাক্ত করা হয়েছে৷ এই ভাইরাসটি মূলত পাখিদের মধ্যে দেখা যায়৷ জার্মানির সরকারি রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা রবার্ট কখ ইনস্টিটিউট-এর মতে এই রোগটি পাখিদের মাধ্যমে ইউরোপে এসেছে৷ রোগটি ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের শরীরে রোগ বহু বছর ধরে গ্রীষ্মকালে সংক্রামিত হচ্ছে৷
ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা আমাদের কাছে খুব পরিচিত৷ কিন্তু এমন অনেক রোগ রয়েছে, যার নামও হয়ত আমরা জানি না৷ মশাবাহিত নানা ধরনের রোগ নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: CC/somaskandaগর্ভবতী নারী মশাদের কামড়ে এই রোগ ছড়ায়৷ ৩০ ধরনের ভিন্ন প্রজাতির লাইশম্যানিয়াসিস জীবাণু রয়েছে৷ এর মধ্যে ১০টি মানবদেহে রোগ ছড়ায়৷ প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর ও মাথা ব্যাথা দেখা দেয়৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্কিন আলসার হয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়৷ তবে দ্রুত ডাক্তার না দেখালে যকৃত, বৃক্কসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে লাইশম্যানিয়াসিস৷
ছবি: WHO/C.Blackকুলেক্স নামের নিশাচর মশা এই রোগের ভাইরাস বহন করে৷ মূলত আফ্রিকায় পাওয়া গেলেও সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে মানবশরীরে এই জীবাণুর অস্তিত্ব পেয়েছেন৷ এই মশার কামড়ে তীব্র জ্বর ও মস্তিষ্কে প্রদাহ দেখা দেয়৷ আরো ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন হাড়ের সংযোগেও প্রদাহের সৃষ্টি হয়৷ কয়েক সপ্তাহ পর এ রোগ এমনিতেই সেরে যায়৷ এর কোনো ওষুধ নেই৷
ছবি: Imagoটাইগার মশা এবং এডিস প্রজাতির আরো কিছু মশার মাধ্যমে ইয়েলো ফিভার ছড়ায়৷ সাধারণভাবে একে ফ্লাভিবাইরাসও বলা হয়ে থাকে৷ আফ্রিকার ৩৪টি এবং দক্ষিণ ও মধ্য অ্যামেরিকার ১৩টি দেশে ইয়েলো ফিভারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি৷ শুরুতে জ্বর এলেও পরে তা বমি, এবং একসময় মেনিনজাইটিসে রূপ নেয়৷ গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়া, এমনকিসম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/P. Whitakerএডিস ইজিপ্টাই নামের মশার কামড়ে আক্রান্ত হলে শরীরে ব্যাথা হয়, লাল গুটি দেখা দেয়, মাংসপেশী ও হাড়ের জোড়াতেও ব্যাথা হয়৷ চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে রক্তক্ষরণে মৃত্যুও হতে পারে৷ প্রথমবারের ধাক্কা সামলে উঠলেই যে মুক্তি তা কিন্তু নয়৷ ডেঙ্গু রোগে কেউ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তা প্রথমবারের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে৷
ছবি: R. Richterএডিস ইজিপ্টাই, টাইগার মস্কিউটো এবং এডিস আলবোপিকটাস জিকা ভাইরাস ছড়ায়৷ ২০১৫ সালে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ৷ জিকার আক্রমণে ব্রাজিলে অসংখ্য শিশু মাইক্রোসিফেলি নামের ভয়াবহ প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে জন্মায়৷ এর ফলে শিশুদের মাথার আকৃতি বিকৃত হয়ে যায়৷ বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েরা জিকায় আক্রান্ত হলে শিশুদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Lacerdaবয়স্ক লোক বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগ ভয়াবহ ক্ষতি বয়ে আনতে পারে৷ এর ফলে মেনিনজাইটিস ও মায়োকার্ডিটিস হতে পারে৷ অন্যান্য মশাবাহী রোগের মতো কাঁপুনি, ঠান্ডা লাগা, জ্বর, মাথা ব্যাথা, ঝিমুনি এবং ব়্যাশ দেখা দিতে পারে৷ এর কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Pleulচিকুনগুনিয়ার প্রভাবে জ্বর কাটিয়ে উঠতে তিন-চার দিন লাগে৷ কিন্তু এর পর হাড়ের জোড়ায় ভয়াবহ ব্যথা কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে চামড়ায় ক্ষত দেখা দিতে পারে৷ তবে আশার কথা, একবার চিকুনগুনিয়া হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই কমে যায়৷
ছবি: Imagoমশাবাহী রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়া সবচেয়ে বেশি পরিচিত৷ অ্যানোফিলিস নামের মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়৷ এই রোগে আক্রান্ত হলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে৷ ম্যালেরিয়ার কার্যকর ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি৷ তবে আগে থেকে সতর্ক থাকলে এতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা কমানো যেতে পারে৷
ছবি: Cécilia Conan ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো জার্মানিতেও পাঁচজন মানুষের শরীরে এর সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা নিশ্চিত করেছেন রবার্ট কখ ইন্সটিটিউটের মহামারী বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিনা ফ্র্যাঙ্ক৷তিনি জানান, গত বছর নীল জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০টি এবং তাদের মধ্যে একজন মারা গেছেন৷ তাছাড়াও স্যাক্সনি, বার্লিন এবং স্যাক্সনি-আনহাল্টেও এই রোগের প্রকোপ দেখা গেছে৷ তবে আরো বেশি মানুষের শরীরে এই রোগের জীবাণু রয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা৷
মানুষের মধ্যে প্রাথমিকভাবে যেহেতু মশাবাহিত এই রোগের সুস্পষ্ট কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, শুধু গুরুতর ক্ষেত্রেই তা বুঝতে পারা যায়৷ তবে মশাবাহিত আফ্রিকান নীল ভাইরাস জ্বর আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অস্বীকার করা যায় না বলে মনে করেন গবেষক ফ্রাঙ্ক৷ জার্মানিতে ইতিমধ্যে এশিয়ান টাইগার মশা, জংলি বা পাহাড়ি মশা এবং এডিস মশা বেশ ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছে বলে জানান বায়োলজিস্ট ভের্নার৷ জার্মানিতে বিদেশি প্রজাতির মশাবাহিত জিকা, চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুর মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের সংক্রমণ যেমন ছড়িয়ে পড়েছে তা ঠেকানো কঠিন৷ এসব রোগের আরো বিস্তার ঘটবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
এনএস/কেএম (ডিপিএ)