মশার যন্ত্রণায় নাকাল রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা৷ উত্তর-দক্ষিণের দুই মেয়র মাঠে নেমে পড়েছেন৷ কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না৷ কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না মশা৷
বিজ্ঞাপন
কেমন আছে নগরবাসী? এ প্রশ্ন সামনে রেখে আজকাল আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই৷ অনলাইনভিত্তিক সমাজমাধ্যমে চোখ রাখলেই অনেকটা আঁচ করা যায় পরিস্থিতি৷ সম্প্রতি ঢাকা শহরে ফেসবুকে মশার যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরছেন অনেকেই৷ নগরের নিকেতনের বাসিন্দা লেখক-গবেষক আফসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘‘নিকেতনে ঘোষণা দিয়ে মশার ওষুধ দেয়া হলো, অনেক বেশি ওষুধ৷ মশা আগের মতোই৷ যে চিনিতে মিষ্টি নাই সেটা এক চামচ আর এক মণ একই৷’’
নগরপিতারা কামান দাগিয়ে মশা মারবেন- এ আশা নিয়ে নগরবাসী একেবারে বসে যে থাকে, তা কিন্তু নয়৷ ঘরের মশা তাড়াতে কেউ ব্যবহার করছে কয়েল, কেউবা অ্যারোসোল৷ এসব সহনীয় মাত্রার কীটনাশকে তৈরি হলেও অনেকেই এগুলোর গন্ধ সহ্য করতে পারে না৷ শুরু হয়ে যায় হাঁচি-কাঁশি৷ আবার বাংলাদেশে যে অনেক ব্র্যান্ডই রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহারের মাত্রা সীমা মানছে না, সেটাও উঠে এসেছে অনেক সময়৷
ঘরে ঘরে মশক নিধনে বর্তমানে কয়েল-অ্যারোসোলের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় রিচার্জেবল ব্যাট৷ বাসায় বসে মশা মারার ব্যাট চালাতেই ব্যস্ত থাকছে কেউ কেউ৷ মশক নিধনের সবরকম উপকরণের চাহিদা যে বেড়েছে, তা জানা যায় রাজধানীর বাজার ঘুরে৷ মিরপুরের বাসিন্দা ডেইজি আখতার জানালেন, তার বাসায় প্রতিদিন অ্যারোসোল দিতে হচ্ছে৷ সন্ধ্যা হলে জ্বালাতে হয় কয়েল৷ মশা মারার ব্যাটও রেখেছেন ঘরে৷ তার অভিযোগ, আগে একটা অ্যারোসোলেই মাস চলে যেতো৷ এখন প্রতি সপ্তাহে কিনতে হচ্ছে৷
চলতি বছর ঢাকা শহরেমশা বেশি- এটা জানা গেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা থেকে৷ তারা জানিয়েছে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার মশার ঘনত্ব চার গুণ বেশি৷ তবে এগুলো এডিস মশা নয়৷ শুধুই কিউলেক্স মশা৷ এ থেকে হতে পারে ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ৷ তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, ঢাকা শহরে যে প্রজাতির কিউলেক্স আছে, সেগুলো থেকে ফাইলেরিয়া হওয়ার ঝুঁকি কম৷ এ তথ্য এসেছে গবেষণা থেকেই৷
কিন্তু মশার কামড়ের চুলকানি কম যন্ত্রণার নয়৷ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যানও অসহনীয়৷ আর এডিস মশা যদি চলে আসে, তবে তো ডেঙ্গু জ্বরের ভয়ে থাকতে হবে নগরবাসীকে৷ করোনাকালে প্রকোপ কম থাকলেও তার আগের বছর কিন্তু এডিসের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে৷ ২০১৯ সালে শুধু ঢাকা শহরেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় অন্তত ৫০ হাজার মানুষ৷ এরমধ্যে মারা যায় শতাধিক৷ সেই সময়ে পরিবারের সদস্য আক্রান্ত হওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)-কে আইনি নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম৷ তিনি অবশ্য জানালেন, এই নোটিশের মূল লক্ষ্য ছিল মশা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ানো৷
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ নগর প্রশাসনের তৎপরতা থাকলেও মশা কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না৷ এ বিষয়ে তানজিম আল ইসলাম বলেন, শুধু ঋতুভিত্তিক কাজ করলে হবে না৷ মশক নিধন কার্যক্রমে সারা বছর ধারাবাহিক প্রক্রিয়া থাকতে হবে৷
মশক নিধন ধারাবাহিক প্রক্রিয়া রাখতে হবে: তানজিম আল ইসলাম
অন্যদিকে ঢাকা শহরে এবার কিউলেক্স মশা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অনাবৃষ্টিও একটি কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বৃষ্টি হলেই এ জাতীয় মশা কমে আসবে৷ তার আগে পর্যন্ত নর্দমা সচল রাখতে হবে৷ ডোবানালা রাখতে হবে পরিচ্ছন্ন৷ কারণ, নোংরা ও আবদ্ধ পানি কিউলেক্স মশা প্রজননের প্রধান স্থান৷ তাই পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে মেয়র-কাউন্সিলরদের নজরদারি অনেক বেশি প্রয়োজন৷ তারা অবশ্য নগরবাসীকেও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন৷ কখনো কখনো নাগরিক দায়িত্বশীলতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন কঠোর কায়দায়৷ সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম রাস্তায় পড়ে থাকা বাসাবাড়ির বর্জ্য সংশ্লিষ্ট ভবনে ফেরত পাঠান৷ তারপর বলেন, যারা রাস্তায় ময়লা ফেলে দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে, উত্তর সিটি সেই ময়লা তাদের বাড়িতে ফেলে আসবে৷
নগর পরিচ্ছন্ন হলে, বৃষ্টি এলে কমে আসবে কিউলেক্স মশা৷ কিন্তু সেই সময়ে আবার ডেঙ্গুজ্বরের বাহক এডিস মশার ঝুঁকি বেড়ে যায়৷ কারণ, জমে থাকা পরিচ্ছন্ন পানি হচ্ছে এডিস মশার প্রজননস্থল৷ সেই মৌসুম থেকে খুব বেশি দূরে নেই ঢাকা শহর৷ তাই ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে হবে এখনি৷ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এডিস মশা৷ এর উপায় জানিয়ে দিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার৷ তার মতে, এডিস মশা জন্মায় পাত্রে জমে থাকা পানিতে৷ এই মশা নিয়ন্ত্রনে বৃষ্টির পূর্বেই অকেজো পাত্র সরানোর তাগিদ দিলেন তিনি৷
ঢাকায় মশার উপদ্রব ঠেকাতে অভিযান
মশা নিয়ন্ত্রণে ৮ মার্চ থেকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) মোট পাঁচটি অঞ্চলে দুই সপ্তাহের জরুরি কর্মসূচি শুরু করেছে, যা চলবে ১৬ মার্চ পর্যন্ত৷
ছবি: DNCC
সব জায়গায় মশা
রাজধানীর গুলশান, ধানমন্ডি, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় বসবাসকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মশার কারণে তারা অতিষ্ঠ৷ গুলশান সোসাইটির মহাসচিব শুকলা সারওয়াত বলেন, ‘‘গুলশানের মতো অভিজাত এলাকাতেও মশার এই সাংঘাতিক উপদ্রব থেকে রেহাই পাচ্ছি না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পরিচ্ছন্নতা
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে পরিচ্ছন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ মশা যেসব জায়গায় বংশবিস্তার করতে পারে, সেসব স্থান নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে৷ এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদেরও ভূমিকা অনেক৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
গাছ কাটা কোনো সমাধান?
বৃহস্পতিবার গুলশান-বাড্ডা লেকপাড়ে ডিএনসিসির পরিছন্নতা অভিযান চলাকালে কিছু ফলজ গাছ কেটে ফেলা হয়৷ স্থানীয়রা ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘‘উনারা গাছের গোড়ায় ওষুধ ছিটাতে পারতেন, কিন্তু গাছ কাটবেন কেন? এরকম হলে তো দেশে সব গাছই কেটে ফেলা উচিত৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মশার রাজ্য
রাজধানীর গুলশান-বাড্ডা সংযোগ সড়কের গুদারাঘাটে লেকের পানিতে অসংখ্য মশা দেখা গেল৷ স্থানীয়রা জানালেন, দিনের বেলা মশাগুলো এখানে থাকলেও সন্ধ্যা হতে না হতেই বাসাবাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে৷ তাদের দাবি, আশপাশের এলাকাগুলোর খাল এবং লেকেরও একই দশা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কিউলেক্স মশা বেড়েছে ৪ গুণ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশারের (ছবি) নেতৃত্বে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এই বছর কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে ৪ গুন৷ রাজধানীর খিলগাঁও, উত্তরা, শাঁখারিবাজারসহ মোট ছয়টি এলাকার তথ্য নিয়ে এ ফলাফল পাওয়া যায়৷
ছবি: Privat
শুধু কেরোসিনের গন্ধ
রাজধানীর গুদারাঘাট এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম অভিযান চলাকালে বলেন, ‘‘ছোটবেলায় আমরা দেখতাম ফগার মেশিন দিয়ে একবার ওষুধ ছিটালে আর কোনো মশা থাকত না৷ আর এখন শুধু কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যায়৷”
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মনিটরিং বড় চ্যালেঞ্জ
বৃহস্পতিবার গুলশান-বাড্ডা সংযোগ সড়কে সমন্বিত অভিযান পরিদর্শনকালে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘মশক নিধনে মনিটরিং কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এজন্য ১২০০ মশক নিধন কর্মীকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরা নিশ্চিতকরণ ও ট্র্যাকিং করা হবে৷ চতুর্থ প্রজন্মের এই যুগে মশকনিধনেও চালু করা হবে আধুনিক প্রযুক্তি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দাঁড়ানো যায় না একদণ্ড
দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সন্ধ্যা না হতেই ঘিরে ধরে হাজার হাজার মশা৷ একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে এ চিত্র কীভাবে থাকতে পারে তা ভাবতেই পারছেন না বিদেশ ফেরত এবং বিদেশি গমনেচ্ছুদের অনেকে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কীটতত্ত্ববিদদের মতামত
একটানা ৫ বছর কোনো কীটের বিরুদ্ধে একই ওষুধ প্রয়োগ করলে প্রাকৃতিকভাবেই তা প্রতিরোধী হয়ে পড়ে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুর্শিদা বেগম জানান, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে কীটনাশকের সাথে সাইনারজিস্ট ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে৷ সুতরাং আমার মনে হয় মশক নিধনে বাংলাদেশেও এ ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘কিউলেক্স মশায় নেই ভয়’
গত ৩ মার্চ এলজিআরডি মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘এনোফিলিস ও কিউলেক্স মশা বিপদজনক নয়, এ মশা নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই৷’’ এ কথার প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় অধিবাসী লিটন সরকার মশার কামড়ের কারণে তার চর্মরোগ দেখিয়ে বলেন, ‘‘তাহলে কি আমরা এভাবে মশার কামড় খেতেই থাকবো?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মশা মারতে ড্রোন
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, যেসব জায়গায় মানুষ পৌঁছাতে পারবে না, সেসব জায়গায় আমরা অত্যন্ত অল্প সময়ে ড্রোনের মাধ্যমে মশার ওষুধ ছিটাতে পারবো৷ ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এই কার্যক্রম চলেছে৷ তবে এ ব্যাপারে আরো বিস্তর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আদৌ এ পদ্ধতি কার্যকর হবে কিনা সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরাম,র্শ নেওয়া হবে৷
ছবি: Private
সমন্বিত কার্যক্রম
ডিএনসিসি কর্তৃক পরিচালিত দুই সপ্তাহব্যাপী ক্র্যাশ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে মশক নিধনের পাশাপাশি অবৈধ দখল উচ্ছেদেরও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ৷ এরই অংশ হিসেবে মোহাম্মদপুর এলাকার রামচন্দ্রপুর খালে জনৈক বেলায়েত হোসেনের অবৈধভাবে দখলকৃত জায়গা মেয়রের নির্দেশে পুনরুদ্ধার করা হয়৷