রাজধানীবাসীর কাছে এখন এক মহা-যন্ত্রণার নাম মশা৷ নগরবাসীকে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচানোর বিষয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে : আপনারা এত চেষ্টা করছেন, তারপরও কেন মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না?
ব্যারিস্টারশেখফজলেনূরতাপস : আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরই মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ঢেলে সাজিয়েছি৷ আগের বছরগুলোতে আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত৷ এডিস মশার কারণে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল৷ আগে যেখানে এক ঘণ্টা মশক নিধনের কার্যক্রম চলতো, এখন সেখানে চার ঘণ্টা করা হয়েছে৷ সেভাবেই আমরা জনবল বাড়িয়েছি৷ এখন সকালে যারা কাজ করছেন, তারা শুধু সকালেই করছেন৷ বিকেলে যারা করছেন, তারা শুধু বিকেলেই করছেন৷ পুরো ৭৫টি ওয়ার্ডে সকালে আমরা আট জন করে দিয়েছি৷ বিকেলে প্রথম দফায় ১০ জন করে দেওয়া হয়েছিল, এখন সেটা পাঁচ জন করা হয়েছে৷ নগর ভবনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এটা মনিটরিং করছেন৷ ডেঙ্গু মশার বিরুদ্ধে আমরা যে কার্যক্রম নিয়েছি, তাতে আমরা সফল হয়েছি৷ ডেঙ্গুতে তেমন কোনো প্রাণহানি হয়নি৷
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে,গত বছরের তুলনায় এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মশার ঘনত্ব চার গুণ বেড়েছে৷ এটা কেন?
আমরা সর্বশেষ যে প্রতিবেদন পেয়েছি, সেটা ডেঙ্গুর উপরই হয়েছিল৷ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের বছরগুলোর তুলনায় একেবারেই কম৷ এডিস মশার বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রমটা সফল হয়েছে৷ আমরা সমন্বিতভাবে কার্যক্রমটা নিয়েছি৷ আমাদের বাসা-বাড়ি বা ঘরের আশপাশে যে পানি জমে থাকে, সেখান থেকে এডিস মশা হয়৷ আর কিউলেক্স মশা বদ্ধ বড় জলাশয়ে হয়৷ এখনও ঢাকা শহরেআমাদের অনেক খাল ও জলাশয় রয়েছে৷ গবেষণা থেকে আমাদের বলা হয়েছিল, ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যক্রমটা চলমান রাখতে৷ কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম, শীতকাল চলে গেলেও পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বদ্ধ জলাশয়ে কিউলেক্স মশার ব্যাপক প্রজনন হয়৷ এখন আমরা যে সূচি করবো, সেখানে এপ্রিল থেকে নভেম্বর এবং নভেম্বর থেকে এপ্রিল৷ কারণ, কিউলেক্স মশার প্রজনন হয়ে গেলে সেটার ব্যাপক বিস্তার হয়ে যায়৷ যেটা আমরা দেখেছি, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারিতে ব্যাপক বিস্তার হয়েছে৷ এই মার্চে মশার প্রজনন ও বিস্তার কমে আসছে৷ আমরা আশাবাদী যে, আগামী সপ্তাহ থেকে আরো কমে আসবে৷ অন্য যে কোনো বছরের তুলনায়, আমাদের এখানে মশক এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে৷ আমাদের যেহেতু অনেক খাল বা জলাধার আছে, সেই কারণে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে সুষ্ঠু ব্যাবস্থাপনা ও পরিকল্পনা নিতে হবে৷ খালগুলো পরিস্কার করার কাজ চলছে, এটা শেষ হলে ঢাকাকে পুরোপুরি মশকমুক্ত করা যাবে৷
ঢাকায় মশার উপদ্রব ঠেকাতে অভিযান
মশা নিয়ন্ত্রণে ৮ মার্চ থেকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) মোট পাঁচটি অঞ্চলে দুই সপ্তাহের জরুরি কর্মসূচি শুরু করেছে, যা চলবে ১৬ মার্চ পর্যন্ত৷
ছবি: DNCC
সব জায়গায় মশা
রাজধানীর গুলশান, ধানমন্ডি, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় বসবাসকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মশার কারণে তারা অতিষ্ঠ৷ গুলশান সোসাইটির মহাসচিব শুকলা সারওয়াত বলেন, ‘‘গুলশানের মতো অভিজাত এলাকাতেও মশার এই সাংঘাতিক উপদ্রব থেকে রেহাই পাচ্ছি না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পরিচ্ছন্নতা
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে পরিচ্ছন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ মশা যেসব জায়গায় বংশবিস্তার করতে পারে, সেসব স্থান নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে৷ এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদেরও ভূমিকা অনেক৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
গাছ কাটা কোনো সমাধান?
বৃহস্পতিবার গুলশান-বাড্ডা লেকপাড়ে ডিএনসিসির পরিছন্নতা অভিযান চলাকালে কিছু ফলজ গাছ কেটে ফেলা হয়৷ স্থানীয়রা ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘‘উনারা গাছের গোড়ায় ওষুধ ছিটাতে পারতেন, কিন্তু গাছ কাটবেন কেন? এরকম হলে তো দেশে সব গাছই কেটে ফেলা উচিত৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মশার রাজ্য
রাজধানীর গুলশান-বাড্ডা সংযোগ সড়কের গুদারাঘাটে লেকের পানিতে অসংখ্য মশা দেখা গেল৷ স্থানীয়রা জানালেন, দিনের বেলা মশাগুলো এখানে থাকলেও সন্ধ্যা হতে না হতেই বাসাবাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে৷ তাদের দাবি, আশপাশের এলাকাগুলোর খাল এবং লেকেরও একই দশা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কিউলেক্স মশা বেড়েছে ৪ গুণ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশারের (ছবি) নেতৃত্বে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এই বছর কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে ৪ গুন৷ রাজধানীর খিলগাঁও, উত্তরা, শাঁখারিবাজারসহ মোট ছয়টি এলাকার তথ্য নিয়ে এ ফলাফল পাওয়া যায়৷
ছবি: Privat
শুধু কেরোসিনের গন্ধ
রাজধানীর গুদারাঘাট এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম অভিযান চলাকালে বলেন, ‘‘ছোটবেলায় আমরা দেখতাম ফগার মেশিন দিয়ে একবার ওষুধ ছিটালে আর কোনো মশা থাকত না৷ আর এখন শুধু কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যায়৷”
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মনিটরিং বড় চ্যালেঞ্জ
বৃহস্পতিবার গুলশান-বাড্ডা সংযোগ সড়কে সমন্বিত অভিযান পরিদর্শনকালে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘মশক নিধনে মনিটরিং কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এজন্য ১২০০ মশক নিধন কর্মীকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরা নিশ্চিতকরণ ও ট্র্যাকিং করা হবে৷ চতুর্থ প্রজন্মের এই যুগে মশকনিধনেও চালু করা হবে আধুনিক প্রযুক্তি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দাঁড়ানো যায় না একদণ্ড
দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সন্ধ্যা না হতেই ঘিরে ধরে হাজার হাজার মশা৷ একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে এ চিত্র কীভাবে থাকতে পারে তা ভাবতেই পারছেন না বিদেশ ফেরত এবং বিদেশি গমনেচ্ছুদের অনেকে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কীটতত্ত্ববিদদের মতামত
একটানা ৫ বছর কোনো কীটের বিরুদ্ধে একই ওষুধ প্রয়োগ করলে প্রাকৃতিকভাবেই তা প্রতিরোধী হয়ে পড়ে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুর্শিদা বেগম জানান, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে কীটনাশকের সাথে সাইনারজিস্ট ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে৷ সুতরাং আমার মনে হয় মশক নিধনে বাংলাদেশেও এ ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘কিউলেক্স মশায় নেই ভয়’
গত ৩ মার্চ এলজিআরডি মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘এনোফিলিস ও কিউলেক্স মশা বিপদজনক নয়, এ মশা নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই৷’’ এ কথার প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় অধিবাসী লিটন সরকার মশার কামড়ের কারণে তার চর্মরোগ দেখিয়ে বলেন, ‘‘তাহলে কি আমরা এভাবে মশার কামড় খেতেই থাকবো?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মশা মারতে ড্রোন
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, যেসব জায়গায় মানুষ পৌঁছাতে পারবে না, সেসব জায়গায় আমরা অত্যন্ত অল্প সময়ে ড্রোনের মাধ্যমে মশার ওষুধ ছিটাতে পারবো৷ ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এই কার্যক্রম চলেছে৷ তবে এ ব্যাপারে আরো বিস্তর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আদৌ এ পদ্ধতি কার্যকর হবে কিনা সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরাম,র্শ নেওয়া হবে৷
ছবি: Private
সমন্বিত কার্যক্রম
ডিএনসিসি কর্তৃক পরিচালিত দুই সপ্তাহব্যাপী ক্র্যাশ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে মশক নিধনের পাশাপাশি অবৈধ দখল উচ্ছেদেরও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ৷ এরই অংশ হিসেবে মোহাম্মদপুর এলাকার রামচন্দ্রপুর খালে জনৈক বেলায়েত হোসেনের অবৈধভাবে দখলকৃত জায়গা মেয়রের নির্দেশে পুনরুদ্ধার করা হয়৷
ছবি: DNCC
12 ছবি1 | 12
আপনি তো গত জুন মাসে রমনা লেক, খিলগাঁওয়ের বটতলা ঝিলসহ তিনটি জলাশয়ে মশা মারতে তেলাপিয়া মাছ ও হাঁস ছেড়েছিলেন৷ রমনা লেকের কিছু হাঁস এরই মধ্যে মরে গেছে৷ ফলে মশা মারার এই উদ্যোগ কতটা কাজে এসেছে?
বিশ্বব্যাপীই শুধুমাত্র কীটনাশকের উপর নির্ভর করে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম হয় না৷ এর জন্য সমন্বিত উদ্যোগের দরকার হয়৷ সে কারণে আমরা বছরব্যাপী সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে সাজিয়েছি৷ আমি জানি না, কেন বিশেষজ্ঞরা বিষয়টা তুলে ধরছেন না৷ সেটা হলো, আমাদের জীববৈচিত্রের যে ভারসাম্য, সেটা ঢাকা শহরে একদম ভেঙে পড়েছে৷ ৩০ বছর আগেও যেখানে লার্ভা ধ্বংসের মতো জীববৈচিত্র্য ছিল, এখন তা নেই৷ এজন্য জীব বৈচিত্রের ভারসাম্যটা বৃদ্ধি করতে হবে৷ শুধুমাত্র কীটনাশক দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না, এটা শারীরিকভাবে ও স্বাস্থ্যগতভাবে খুবই ঝুঁকির সৃষ্টি করে৷ এই কারণে আমরা হাঁস ও মাছ চাষ করছি৷ ১০টি জলাশয়কে আমরা ঠিক করেছি, সেখানে ভবিষ্যতে আমরা হাঁস ও মাছের পাশাপাশি ব্যাঙও চাষ করবো, যাতে জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়৷
আপনার কী মনে আছে, শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আপনাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, মশা আপনাদের ভোট যেন খেয়ে না ফেলে?
প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তব্যকেই আমরা শিরোধার্য হিসেবে নিয়েছি৷ করোনা মহামারির মাঝেও আমরা মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিয়েছি৷ এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো, কীটনাশক যখন দীর্ঘদিন প্রয়োগ করা হয়, তখন তাদের সহনশীলতাও বৃদ্ধি পায়৷ এজন্য আমরা কীটনাশকটা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছি৷ আশা করছি, আগামী সপ্তাহ থেকেই নতুন কীটনাশক ব্যবহার করতে পারবো৷ এর মাধ্যমে মশক আরো নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আমরা আশাবাদী৷
ভয়াবহ সব মশাবাহিত রোগ
ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা আমাদের কাছে খুব পরিচিত৷ কিন্তু এমন অনেক রোগ রয়েছে, যার নামও হয়ত আমরা জানি না৷ মশাবাহিত নানা ধরনের রোগ নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: CC/somaskanda
লাইশম্যানিয়াসিস
গর্ভবতী নারী মশাদের কামড়ে এই রোগ ছড়ায়৷ ৩০ ধরনের ভিন্ন প্রজাতির লাইশম্যানিয়াসিস জীবাণু রয়েছে৷ এর মধ্যে ১০টি মানবদেহে রোগ ছড়ায়৷ প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর ও মাথা ব্যাথা দেখা দেয়৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্কিন আলসার হয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়৷ তবে দ্রুত ডাক্তার না দেখালে যকৃত, বৃক্কসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে লাইশম্যানিয়াসিস৷
ছবি: WHO/C.Black
সিন্ডবিস
কুলেক্স নামের নিশাচর মশা এই রোগের ভাইরাস বহন করে৷ মূলত আফ্রিকায় পাওয়া গেলেও সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে মানবশরীরে এই জীবাণুর অস্তিত্ব পেয়েছেন৷ এই মশার কামড়ে তীব্র জ্বর ও মস্তিষ্কে প্রদাহ দেখা দেয়৷ আরো ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন হাড়ের সংযোগেও প্রদাহের সৃষ্টি হয়৷ কয়েক সপ্তাহ পর এ রোগ এমনিতেই সেরে যায়৷ এর কোনো ওষুধ নেই৷
ছবি: Imago
ইয়েলো ফিভার
টাইগার মশা এবং এডিস প্রজাতির আরো কিছু মশার মাধ্যমে ইয়েলো ফিভার ছড়ায়৷ সাধারণভাবে একে ফ্লাভিবাইরাসও বলা হয়ে থাকে৷ আফ্রিকার ৩৪টি এবং দক্ষিণ ও মধ্য অ্যামেরিকার ১৩টি দেশে ইয়েলো ফিভারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি৷ শুরুতে জ্বর এলেও পরে তা বমি, এবং একসময় মেনিনজাইটিসে রূপ নেয়৷ গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়া, এমনকিসম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/P. Whitaker
ডেঙ্গু
এডিস ইজিপ্টাই নামের মশার কামড়ে আক্রান্ত হলে শরীরে ব্যাথা হয়, লাল গুটি দেখা দেয়, মাংসপেশী ও হাড়ের জোড়াতেও ব্যাথা হয়৷ চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে রক্তক্ষরণে মৃত্যুও হতে পারে৷ প্রথমবারের ধাক্কা সামলে উঠলেই যে মুক্তি তা কিন্তু নয়৷ ডেঙ্গু রোগে কেউ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তা প্রথমবারের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে৷
ছবি: R. Richter
জিকা
এডিস ইজিপ্টাই, টাইগার মস্কিউটো এবং এডিস আলবোপিকটাস জিকা ভাইরাস ছড়ায়৷ ২০১৫ সালে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ৷ জিকার আক্রমণে ব্রাজিলে অসংখ্য শিশু মাইক্রোসিফেলি নামের ভয়াবহ প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে জন্মায়৷ এর ফলে শিশুদের মাথার আকৃতি বিকৃত হয়ে যায়৷ বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েরা জিকায় আক্রান্ত হলে শিশুদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Lacerda
ওয়েস্ট নাইল ফিভার
বয়স্ক লোক বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগ ভয়াবহ ক্ষতি বয়ে আনতে পারে৷ এর ফলে মেনিনজাইটিস ও মায়োকার্ডিটিস হতে পারে৷ অন্যান্য মশাবাহী রোগের মতো কাঁপুনি, ঠান্ডা লাগা, জ্বর, মাথা ব্যাথা, ঝিমুনি এবং ব়্যাশ দেখা দিতে পারে৷ এর কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Pleul
চিকুনগুনিয়া
চিকুনগুনিয়ার প্রভাবে জ্বর কাটিয়ে উঠতে তিন-চার দিন লাগে৷ কিন্তু এর পর হাড়ের জোড়ায় ভয়াবহ ব্যথা কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে চামড়ায় ক্ষত দেখা দিতে পারে৷ তবে আশার কথা, একবার চিকুনগুনিয়া হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই কমে যায়৷
ছবি: Imago
ম্যালেরিয়া
মশাবাহী রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়া সবচেয়ে বেশি পরিচিত৷ অ্যানোফিলিস নামের মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়৷ এই রোগে আক্রান্ত হলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে৷ ম্যালেরিয়ার কার্যকর ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি৷ তবে আগে থেকে সতর্ক থাকলে এতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা কমানো যেতে পারে৷
ছবি: Cécilia Conan
8 ছবি1 | 8
গত চার বছরে মশার পেছনে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ব্যয় হয়েছে ৭৬ কোটি টাকা৷ তারপরও কেন মশার উপদ্রব কমছে না?
আমি ঢাকাবাসীর কাছেও এ বিষয়টি তুলে ধরতে চাই যে, আমরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করি মশক নিধনে, প্রচুর অর্থ ব্যয় করি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়৷ এটা সকলের নজরে আসা উচিত৷ মশক নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রায় এক হাজারের মতো জনবল প্রতিদিন কাজ করে৷ এর জন্য আমাদের ব্যাপক বেতনও দিতে হয়৷ আমাদের বেতনের একটা বড় অংশ কিন্তু এই মশক নিয়ন্ত্রণে চলে যায়৷ আমাদের খরচের একটা বড় অংশও মশক নিয়ন্ত্রণে চলে যায়৷ সবাই যদি আমরা সচেতন হই যে, আশপাশ পরিস্কার রাখি, যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলি, জলাশয়গুলো যদি পরিস্কার রাখি তাহলে কিন্তু এত খরচ করতে হয় না৷ এখানে আমি ঢাকাবাসীকে এগিয়ে আসতে বলবো৷
যারা মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন, তাদের কীভাবে মনিটর করা হয়?
আমাদের যে সাংগঠনিক কাঠামো আছে, সেই অনুযায়ী তদারিক করা হয়৷ যে কর্মীরা ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন, তাদের দেখভালের জন্য একজন সুপারভাইজার আছে৷ তার উপরে একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আছেন৷ তার উপরে কাউন্সিলররা এটা তদারকি করে থাকেন৷ এর উপরে আমাদের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা আছেন৷ তার উপরে আমাদের প্রধান কার্যালয়ে উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আছেন৷ তাকে আমরা এটার দায়িত্ব দিয়েছি৷ তাছাড়া আমরা যারা কর্মকর্তা আছি, আমরা তো তদারকি করছিই৷ আমরা চেষ্টা করছি নিবিড়ভাবে তদারকি করার৷ তারপরও গাফিলতি থাকতে পারে৷ যখন যেগুলো নজরে আসে, তখনই ব্যবস্থা নিই৷
মশা ও পোকামাকড় থেকে দূরে থাকার উপায়
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার প্রকোপের পর মশা বা বিভিন্ন পোকামাকড়ের নাম শুনলেই কেমন যেন ভয় করে, তাই না? মশা, মৌমাছি বা এ জাতীয় পোকা থেকে নিজেকে দূরে রাখার কিছু সহজ উপায় থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Gathany
মিষ্টি খাবার দূরে রাখুন
‘মিষ্টি’ যে কোনো পোকামকড়কে কাছে টানে৷ বিশেষ করে মৌমাছিকে৷ তাই খাবার টেবিল থেকে মৌমাছিসহ অন্যান্য পোকাকে দূরে রাখতে এক গ্লাস মিষ্টি কোকাকোলা, ফান্টা বা মিষ্টি পানীয় দূরে কোথাও রেখে দিন৷ দেখবেন, পোকামাকড়ের অত্যাচার বা ঝামেলা ছাড়াই নিশ্চিন্তে খেতে পারছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Weihrauch
শান্ত থাকুন
মৌমাছি বা ভিমরুল আপনার কাছাকাছি ঘুরলে বা আপনাকে বিরক্ত করলে একদম চুপ বা শান্ত থাকুন৷ ওদের মারতে গেলে ওরা তখন আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে৷ কাজেই সাবধান!
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/McPHOTO
মশার পছন্দ কালো পোশাক
মশার পছন্দ কালো বা গাঢ় রঙের পোশাক৷ তাই যেখানে মশা আছে, সেখানে হালকা রঙের পোশাক পরাই শ্রেয়৷ বিশেষ করে রাতের বেলায়৷ বাগানে বা বাইরে গরম হলেও ফুলপ্যান্ট এবং লম্বা হাতের জামা পরা উচিত৷ আর খোলা মাঠে ঘাসের ওপর বড় ছোট কেউ-ই খালি পায়ে একদম হাঁটবেন না৷
ছবি: Getty Images/S. Gosatti
পারফিউম মশাকে কাছে টানে
পারফিউম, হেয়ার স্প্রে বা সুগন্ধী প্রসাধনী ব্যবহার না করাই ভালো৷ কারণ, মানুষের মতো সুগন্ধী যে মশারও প্রিয়!
ছবি: picture-alliance/dpa/Ernesto Mastrascusa
দরজা-জানালায় নেট
দরজা-জানালায় নেট লাগিয়ে নিন৷ বিশেষকরে যেগুলো প্রায়ই খোলা থাকে সেসব দরজা-জানালায় নেট লাগাতে আর দেরি না করাই ভালো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
টমেটো ও লেবু গাছ
দরজা বা জানালার কাছে সম্ভব হলে টমেটো গাছ ও লেবু গাছ লাগাতে পারেন, কারণ, এই গাছগুলো পোকামাকড়কে দূরে রাখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Gebert
লবঙ্গ, ল্যাভেন্ডার
লবঙ্গ, ল্যাভেন্ডার বা লেবুযুক্ত তেল গায়ে মাখতে পারেন৷ যদিও এসবের স্থায়ীত্ব বেশিক্ষণ নয়, তারপরও কিছুটা কাজে লাগে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Tomas
যদি কামড় দিয়েই ফেলে
যদি মশা, মৌমাছি বা পোকামাকড় কামড় দেয় তাহলে সাথেসাথেই ভেজাকাপড় দিয়ে কামড়ের জায়গাটি মুছে নিয়ে সেখানে আয়োডিন লাগিয়ে নিন৷ ভালো হয় যদি একটি পেঁয়াজকে অর্ধেক করে তার একটি অংশ কামড়ের জায়গায় ভালো করে ঘষে দেন৷
ছবি: Fotolia/Africa Studio
মুখের ভেতর বা ঠোঁটে কামড়ালে
মশা বা পোকা যদি মুখের ভেতর বা ঠোঁটে কামড় দেয়, তাহলে তা ভয়ংকর আকার নিতে পারে৷ তাই এ সব জায়গায় কামড় দিলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে৷ তবে তার আগে বরফ শীতল পানি দিয়ে গার্গল করা এবং এক টুকরো বরফ মুখে পুরে লজেন্সের মতো চোষার পরামর্শও দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Gathany
চুলকাবেন না!
ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ এড়াতে কোনোভাবেই ক্ষতে চুলকাবেন না৷ কারণ, শুধুমাত্র চুলকানোর কারণেই হয়ত ক্ষতস্থান আরো ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে৷
ছবি: Colourbox/A. Gravante
10 ছবি1 | 10
দীর্ঘদিন ধরেই মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ এখন যে ওষুধ আনতে চাচ্ছেন সেটার কার্যকারিতা কতটুকু পরীক্ষিত?
এটা তো সাধারণ কোনো কীটনাশক না৷ সরকারি কিছু নিয়মনীতি আছে, সেগুলো পরিপালন করেই ওষুধ আনতে হয়৷ কতটুকু ওষুধ প্রয়োগ করা যাবে সেটার সীমাও কিন্তু নির্ধারণ করা আছে৷ একটা নির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনেই এটার প্রয়োগ করতে হয়৷ বিশেষজ্ঞরা আমাদের সুপারিশ করেন, কখন কোন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে৷ তাদের মতামতের ভিত্তিতেই আমরা কীটনাশক আমদানি এবং প্রয়োগ করে থাকি৷ একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, আমরা কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই বাৎসরিক কীটনাশক একবারে এনে থাকি৷ কিন্তু দেশে আনার পর যদি দেখা যায়, সেই কীটনাশকে কাজ হচ্ছে না, তাখন কিন্তু আমরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হই৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকার কারণে মশার উপদ্রব কমছে না৷ আপনি কী মনে করেন?
আমাদের এখন যেভাবে কাজ হচ্ছে তাতে আমি মনে করি না যে, ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে৷ বিশেষজ্ঞরা আমাদের যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর কার্যক্রম পরিচালনা করা৷ আমার মনে হয়, সেখানে একটু ভুল হয়েছে৷ বরং আমাদের সূচি অনুযায়ী যদি আমরা নভেম্বর থেকে কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতাম, তাহলে এ পর্যায়ে মশক এত বৃদ্ধি পেতো না৷ ভবিষ্যতে আমরা এই বিষয়টা অবশ্যই দেখবো৷
মাছ ও হাঁসের পর এবার আপনারা জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়তে যাচ্ছেন, এসব করে কী নগরবাসীর জন্য কোন সুখবর আপনি দিতে পারবেন?
আমি তো আগেই বলেছি৷ ঢাকায় জীব বৈচিত্র একেবারেই ভেঙে পড়েছে৷ জীববৈচিত্র রক্ষা পেলে আজকে মশক এ পর্যায়ে বৃদ্ধি পেত না৷ আমরা নিজেরাও ছোট বেলায় এগুলো উপলব্ধি করেছি৷ তখন কিন্তু মশকের পেছনে এত টাকা ব্যয় করতে হতো না৷ ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়াটা সমন্বিত রূপ পাবে তখন আমরা ফল পাবো৷ আজকেই কিন্তু এর ফল পাওয়া যাবে না৷ বহির্বিশ্বে যেহেতু এটা একটা পরীক্ষিত প্রক্রিয়া, তাই ভবিষ্যতে নিশ্চয় আমরা এটার ফল পাবো৷