মশা মারার ব্যয় দুইশ' কোটি টাকা, কচুরিপানায় চার কোটি
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৯ জুলাই ২০২১
ঢাকার মশা মারতে প্রতিবছরই বরাদ্দ বাড়ে৷ আর মশাও বাড়ে৷ দুই সিটিতে বছরে বরাদ্দ প্রায় দুইশ কোটি টাকা৷ বরাদ্দ বাড়ার পরও এবার ডেঙ্গুর যে প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে তাতে প্রশ্ন উঠেছে যে মশা মারার বরাদ্দ কার পেটে যায়?
বিজ্ঞাপন
এর মধ্যে দুই সিটিতে কচুরিপানা খাতে বরাদ্দ প্রায় চার কোটি টাকা৷
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন তাদের চলতি বাজেটে বরাদ্দ রেখেছে ৭২ কোটি টাকা৷ আগের বছর ২০২০-২১ সালে বরাদ্দ ছিলো ৭০ কোটি টাকা৷ আর ২০১৯-২০ সালে বরাদ্দ ছিলো ৫৮ কোটি টাকা৷
উত্তরের ২০২০-২১ অর্থবছরে মশা মারা বাজেটের মধ্যে ওষুধে ব্যয় হয়েছে ৪২ কোটি টাকা৷ কচুরিপানা পরিষ্কারে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা৷ ফগার, হুইল এবং স্প্রে মেশিন পরিবহনে ব্যয় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বিশেষ কর্মসূচি পালনে ব্যয় ৩ কোটি টাকা, অউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যয় ১৫ কোটি টাকা৷
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২০২০-২১ এ মশা মারতে বরাদ্দ ছিলো ৩৫ কোটি টাকা৷ ২০১৯-২০ অর্থবছরে মশা মারতে মোট বরাদ্দ রাখা হয় ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা৷ তবে এবছর বাজেট এখনো পাশ না হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে মশা মারতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে বলে দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ৷
২০১৯-২০ অর্থবছরে মশা মারতে ব্যবহৃত ওষুধ ও কীটনাশক বাবদ ৩৮ কোটি টাকা, কচুরিপানা ও জলাশয় পরিষ্কারে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা, ফগার ও হুইল মেশিন পরিবহনে বরাদ্দ চার কোটি টাকা৷
দুই সিটি মিলিয়ে বছরে মশা মারতে বরাদ্দ ১৭২ কোটি টাকা৷ এরমধ্যে কচুরিপানা পরিষ্কারে বরাদ্দ তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা৷
বছর বছর বরাদ্দ বাড়ার পর মশা কমে উল্টো বাড়ছে৷ এমন কেন হচ্ছে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্বের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন,"সমস্যা মশা মারার ওষুধ বা ফগিং মেশিনে নয়৷ সমস্যা হলো ব্যবস্থাপনায় ৷ কিউলেক্স ও এডিস মশার ধরণ আলাদা৷ ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা জন্মে স্বচ্ছ পানিতে, বাড়িঘরে, কনষ্ট্রাকশন সাইটে৷ লার্ভিসাইটে ওষুধ ছিটিয়ে এডিস মশার প্রজনন বন্ধ করা কঠিন৷ তার জন্মস্থল নষ্ট করতে হবে৷ আর সেটার বড় অংশ যেহেতু মানুষের বাসাবাড়িতে তাই নগরবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে৷ তাদের কাজে লাগাতে হবে৷ সেটা তেমন করা হচ্ছে না। এই কাজটি করতে হয় সারা বছর ধরে৷ কিন্তু আমরা দেখি বর্ষাকালে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়৷ তাই বরাদ্দ বাড়লেও মশা কমে না”
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ বলেন," আমরা নগরবাসীকে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি এখন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি৷ আমাদের ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত এখন কাজ করছে৷ বুধবার আমরা ৫১টি বাড়িতে লার্ভা পেয়েছি৷ আমরা তো বাড়ির একদম ভেতরে ঢুকতে পারি না। আঙিনায় অভিযান চালাই৷”
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন,"মশা কমেছে আবার বেড়েছেও৷ আমরা মারছি আবার জন্ম নিচ্ছে৷ এডিস মশা কমাতে হলে নগরবাসীর সহায়তা লাগবে৷ এজন্য আমরা ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছি৷ চিরুনি অভিযান চালাচ্ছি৷”
তিনি বলেন," আমরা প্রচার চালিয়ে মানুষকে সচেতন করতে বেশ কিছু সুসজ্জিত ভ্যান চালু করেছি৷ স্লোগান তৈরি করেছি৷ কাউন্সিলদের সম্পৃক্ত করেছি৷”
দুই সিটির এই নানা উদ্যোগের মধ্যেই ঢাকায় প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বাড়ছে৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে ২৪ ঘন্টায় আরো ১৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে৷ যা এই বছরে একদিনে সর্বোচ্চ৷ রোগীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগেরই ১৫০ জন৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত চলতি মাসে এক হাজার ৭২৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে৷ আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপর্যন্ত রোগী দুই হাজার ৯৮ জন৷ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গুতে চারজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে৷
সেলিম রেজা
ফরিদ আহমেদ
ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে
করোনা মহামারির মধ্যে প্রতিদিন আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে৷ চলতি বছর এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫৭৪ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জলাধারগুলো মশার অভয়াশ্রম
ঢাকার বাড্ডা-গুলশান লিংক রোডের গুদারাঘাটের লেকের পাড়ে মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায় অসংখ্য মশা দিনের বেলা পানির উপর আশ্রয় নিয়েছে৷ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই মশাগুলোই সন্ধ্যার পর আশেপাশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে৷ মশার উৎপাতে অনেকে এলাকাছাড়া হয়েছেন বলেও জানান তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পুরস্কার ঘোষণা
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যে কাউন্সিলরের ওয়ার্ডে সবচেয়ে কম ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাবে, তাকে পুরস্কৃত করা হবে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় সেখানে চারদিন যাবত ভর্তি আছেন সাদ্দাম হোসেন৷ চাকরিপ্রার্থী সাদ্দাম জানান, প্রথমে জ্বর এবং শরীর ব্যথা হলে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন৷ পরে প্লাটিলেট গণনা ৭০ হাজারের নিচে নামলে ডাক্তারের পরামর্শে তিনি এখানে ভর্তি হন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
১০ দিনব্যাপী চিরুনি অভিযান
জুলাই মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ২৭ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত চিরুনি অভিযান চালানোর ঘোষণা দেয়৷ অভিযানের অংশ হিসেবে জনগণকে সচেতন করা, সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করারও বিধান রাখা হয়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জনগণের অসচেতনতা
ঢাকার মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের বেশ কয়েকটি আবাসিক ভবনের পাশে অনেকদিন ধরে জমা হওয়া ময়লা আবর্জনার স্তুপ দেখা যায়৷ এসব জায়গা ডেঙ্গুর উপযুক্ত আবাসস্থল বর্ণনা করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘‘শুধু ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়৷ এ যুদ্ধে জনগণকেও সমানভাবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সচেতনতায় তারকাদের অংশগ্রহণ
মঙ্গলবার মোহাম্মদপুরে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সচেতনতামূলক প্রচারাভিযানে গিয়ে দেখা যায় সেখানে জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম অংশ নিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটি পরিচ্ছন্ন নগরীতে বাস করতে চাই৷ এ জন্য সরকারের পাশাপাশি আমাদের কিছু দায়িত্বও আছে৷ ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন বেড়েছে, এর থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের বাসাবাড়ি আমরা নিজেরাই পরিষ্কার রাখবো৷ এতে যেমন আমরা বাঁচবো, তেমনি আমাদের প্রতিবেশীরাও ভালো থাকবেন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বরাদ্দ বাড়ে, মশাও বাড়ে
২০২০-২১ অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধনে ১০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে৷ অথচ দিনদিন মশা বাড়ছে, বৈ কমছে না৷ বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, এই টাকা কি মশাদের পেটে যাচ্ছে, নাকি সিটি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের পকেটে যাচ্ছে? অবশ্য সিটি কর্পোরেশন থেকে বলা হচ্ছে, বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে মশা বৃদ্ধি বা কমার কোনো সম্পর্ক নেই৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ডেঙ্গু চিকিৎসায় পৃথক হাসপাতাল
করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের জন্য পৃথক হাসপাতাল নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক৷ তিনি বলেন, পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল, মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল, টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা হবে৷
ছবি: bdnews24
তিন দিনে একদিন, জমা পানি ফেলে দিন
ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী প্রকোপ রোধ করতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন মাধ্যমে স্লোগান এবং সচেতনতামূলক প্রচার অব্যাহত রেখেছে৷ এতে বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু মশারা ময়লা পানিতে নয়, বরং স্বচ্ছ এবং জমানো পানিতে বংশবিস্তার করে৷ তাই ফুলের টব, পরিত্যক্ত পাত্র, ডাব-নারকেলের খোসায়, এসি-রেফ্রিজারেটরে জমে থাকা পানি যেন তিনদিন পরপর ব্যক্তি উদ্যোগে পরিষ্কার করা হয়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মশা নিধনের ওষুধ কতটা কার্যকর
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে মশার প্রকোপ বৃদ্ধির সাথে সাথে যে প্রশ্নটি জনমনে দেখা যায়, সেটি হচ্ছে মশা নিধনে যে ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেটি আদৌ কাজ করছে কিনা৷ ঢাকার গুদারাঘাটে গুলশান লেকপাড়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘আমরা যখন ছোট আছিলাম তহন দেখসি একবার ওষুধ মারলে সাতদিন কোনো মশা আছিল না৷ আর এহন কী ওষুধ ছিটায়, মশা তো কমেই না, উলটা বাড়ে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জ্বরে কোভিডের পাশাপাশি ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ডাঃ ফাহিম শাকিল আহমেদ জানান, ‘‘একজন রোগী জ্বর নিয়ে আসলে প্রথমেই আমরা তার হিস্ট্রি শুনি৷ তার জ্বরের মাত্রা, শ্বাসকষ্ট, শরীরে র্যাশ, অক্সিজেনের সঠিক মাত্রা ইত্যাদি আছে কিনা দেখি৷ এরপর রোগীকে রক্তপরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে থাকি৷ সাধারণত ডেঙ্গু হলে রোগীর প্লা্টিলেট কাউন্ট কমে যায় আর করোনা হলে নিউট্রোফিল কাউন্ট বেশি এবং লিম্ফোসাইট কাউন্টটা কম থাকে৷’’