পুরনো ঢাকার ইসলামপুরের জব্বু খানম জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন বিল্লাল হোসেন (৫১)৷ সোমবার মসজিদের ভিতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়৷ তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে – এ কথা জানালেও, হত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ পায়নি পুলিশ৷
বিজ্ঞাপন
নিহত বিল্লাল হোসেন তিনতলা মসজিদ ভবনেরই একটি কক্ষে বসবাস করতেন৷ মসজিদটি প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো এবং তার নীচে মসজিদের মালিকানায় একটি মার্কেটও আছে৷ জানা গেছে, ভোর ৫টার দিকে নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদের সিঁড়িতে রক্ত দেখতে পান স্থানীয়রা৷ এরপর রক্তের ধারা অনুসরণ করে ভেতরে গিয়ে মুয়াজ্জিনের লাশ পান তারা৷ খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠায়৷ তাঁর শরীরে পাঁচটি গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল৷
পুলিশ জানায়, তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে৷ ধারণা করা হচ্ছে, মধ্যরাতের পর যে কোনো সময় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ এ কারণে মসজিদে ফজরের আজানও হয়নি৷ এমনকি নিরাপত্তার কারণে আপাতত মসজিদটি বন্ধ রাখা হয়েছে বলে ও খবর৷
আব্দুল আউয়াল
এ ব্যাপারে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে কোতয়ালী থানায় মামলা হয়েছে ইতিমধ্যেই৷ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঠিক কী কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা এখনো নিশ্চিত নই৷ আমরা মসজিদ থেকে কোনো টাকা বা অন্যকিছু খোয়া যাওয়ার প্রমাণও পাইনি৷ তবে মসজদিরে পাশে খ্রিষ্টানদের ‘মিশনারিজ অফ চ্যারেটিজ' ও বিপরীত দিকে ‘জিন্দা পীরের মাজার' নামে একটি মাজার আছে৷ এ দু'টির সঙ্গে নিহত মুয়াজ্জিনের কোনো যোগাযোগ ছিল কিনা, তা আমরা খতিয়ে দেখছি৷''
মসজিদের নীচতলার মার্কেটের কেয়ারটেকার আব্দুল আউয়াল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘বিল্লাল হোসেন ২৭ বছর ধরে এই মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন৷ মসজিদের আয়ের একটি অংশ তাঁর কাছেই থাকতো৷ মার্কেট থেকে মাসে ৪০ হাজার ঢাকার মতো আয় হয়৷ গত বছর রোজার মাসে তাঁকে একবার মারধোর করে দুর্বৃত্তরা দুই লাখ টাকা নিয়ে গিয়েছিল৷ সে সময় তাঁর কাছে রোজার মাসের দানের বাড়তি টাকা ছিল৷''
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
তিনি বলেন, ‘‘তিনতলার একটি কক্ষে বিল্লাল থাকতেন৷ কিন্তু রাতে নামাজের পর মসজিদ তালা মারা থাকতো৷ তাই তাঁকে কেন হত্যা করা হলো বুঝতে পারছি না৷ আমার জানামতে তাঁর কোনো শত্রু ছিল না৷''
স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন আরো জানান, ‘‘আমরাও প্রাথমিকভাবে হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে পারিনি৷ তবে কয়েকটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত শুরু করেছি৷ এরমধ্যে উগ্রপন্থিদেরও সন্দেহের বাইরে রাখছি না৷ মাজার এবং মিশনারিজ অফ চ্যারেটিজ-এর সঙ্গে এ ঘটনার কোনো যোগাযোগ আছে কিনা – সেটাও আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি৷ তার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব শত্রুতা বা ডাকাতির বিষয়টিও দেখছি৷ তবে ডাকাতির কোনো আলামত এখনো পাইনি৷''
নিহত বিল্লালের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ৷ তিনি ‘কোরানে হাফেজ' ছিলেন৷ মাদ্রাসা ও কলেজ পড়ুয়া দুই সন্তান রেখে গেছেন তিনি৷
প্রসঙ্গত, গত ছ'মাসে বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্মীয় চিন্তার মানুষ, পুরোহিত এবং সংখ্যালঘু ধর্মগুরুরা হামলা ও হত্যার শিকার হলেও কোনো মুয়াজ্জিমকে মসজিদের ভেতরে হত্যার ঘটনা এই প্রথম৷