মানুষ অভ্যাসের দাস৷ কিন্তু অভ্যাস ব্যাপারটা না থাকলে আমাদের জীবনযাত্রা অনেক কঠিন হয়ে পড়তো৷ মস্তিষ্কের পক্ষে সব কাজ সামলানো অনেক কঠিন হয়ে উঠতো৷ রুটিন কাজগুলি করতে মানুষকে হিমশিম খেতে হতো৷
বিজ্ঞাপন
প্রতিদিন সকালে একই রুটিন মেনে কাজ করি আমরা৷ পোশাক পরার সময় ভাবি না, কোনটা আগে কোনটা পরে গায়ে দিচ্ছি৷ মাজনের টিউবে কতটা চাপ দিচ্ছি, সেটাও খেয়াল থাকে না৷ সবই অভ্যাসের ফল৷
জীবনটা তখন আরও অনেক কঠিন হয়ে পড়তো৷ কারণ তখন প্রতিটি পদক্ষেপের সময়ে ভুল এড়াতে মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হতো৷ একই সঙ্গে একাধিক কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়তো৷ অভ্যাসের অভাবে সব কাজ নতুন করে করতে অনেক বেশি সময় লাগতো৷
সুস্থ মস্তিষ্ক, সুস্থ মানুষ!
‘কেমন আছেন’ জানতে চাওয়ার মধ্যে সাধারণত শরীরের ভালো-মন্দের কথাই বোঝানো হয়৷ মস্তিষ্ক শরীরেরই একটি অপরিহার্য অঙ্গ, যার সুস্থ থাকাও জরুরি ৷ মস্তিষ্ক এলো-মেলো হলে সবই গেল৷ জেনে নিন মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষকরা কী বলছেন৷
ছবি: Fotolia/Syda Productions
নতুন জায়গায় ঘুম না হওয়ার কারণ কী?
প্রায়ই শোনা যায় ‘নতুন জায়গা, তাই ভালো ঘুম হয়নি৷’ কিন্তু এর আসল কারণ কী? এ সম্পর্কে জাপানের নিউরোলজিস্টরা জানান, অপরিচিত জায়গা বা বিছানায় ঘুমালে মস্তিষ্কের এক পাশ, অন্যপাশের চেয়ে বেশি সতর্ক হয়ে থাকে যে কোনো শব্দের ক্ষেত্রেই৷প্রথমদিন অচেনা পরিবেশে মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিশ্রাম নিতে পারে না৷ তবে পরের দিন দু’পাশই আবার একই রকম শান্ত হয়ে যায়৷ এই তথ্যটি জানা গেছে ‘কারেন্ট বায়োলজি’ নামের একটি ম্যাগাজিন থেকে৷
ছবি: Colourbox/S.Mironov
মস্তিষ্ককে সচল রাখতে টিভি কম দেখুন
আপনি কি সারাদিন সোফায় আরাম করে বসে টিভি দেখেন? বা হাঁচা-চলা করতে একেবারেই পছন্দ করেন না? তাহলে কিন্তু আপনাকে সত্যিই সাবধান হতে হবে৷ ৩,২৫০ জন মানুষকে নিয়ে করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যাঁরা বসে বসে বেশিক্ষণ টিভি দেখেন, তাঁদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা অন্যদের তুলনায় অনেক দুর্বল৷ এই তথ্যটি জানা গেছে অ্যামেরিকার ‘জামা সাইকিয়াট্রি ম্যাগাজিন’ থেকে৷
ছবি: Colourbox
খেলাধুলা মগজকে প্রসারিত করে
খেলাধুলা বা ফিটনেসের সাথে মস্তিষ্কের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক৷ খেলাধুলা বা হাঁটা-চলা কম হলে আপনার মস্তিষ্ক বা মগজ তাড়াতাড়ি সংকুচিত হয়ে যায়৷ এই সমীক্ষাটি করেছেন বস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষকদল, যা প্রকাশ হয়েছে ‘নিউরোলজি’ ম্যাগাজিনে৷ সমীক্ষাটি করা হয়েছে মোট ১,৫৮৩ জন মানুষকে নিয়ে এবং একটি দীর্ঘ সময় ধরে৷ যখন তাঁদের ৪০ বছর বয়স ছিল তখন এবং পরে আবার নতুন করে ৬০ বছর বয়সে৷
ছবি: Colourbox/Dmitry Travnikov
ডিমেনশিয়া বা আলৎসহাইমার ঝুঁকি কমছে
শিল্পোন্নত দেশেগুলোতে মানুষের আয়ু যত বাড়ে, আলৎসহাইমা রোগের ঝুঁকিও ততটাই বাড়ে৷ বিশেষজ্ঞরা এতদিন বলতেন এমনটাই৷ কিন্তু সম্প্রতি ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন’-এ প্রকাশ করে যে, ৮-এর দশকে ডিমেনশিয়ার আক্রান্ত হয়েছেন বিশ্বের শতকরা ৩,৬ ভাগ মানুষ৷ আর ২০১০ সালের হিসেবে সংখ্যাটি হলো ২,২ ভাগ৷ এই সংখ্যা কমার পেছনে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থারও একটা অবদান থাকতে পারে৷
ছবি: Colourbox/I. Jacquemin
সবচেয়ে কঠিন কাজটি সকালেই করুন
কর্মক্ষেত্রে বা স্কুলের সবচেয়ে কঠিন কাজটি সকালে করার পরামর্শ দিয়েছেন ডেনমার্কের এক গবেষকদল৷ তাঁরা মোট ৫৭০, ০০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে একটি গবেষণা করে দেখিয়েছে যে, পরীক্ষা যত সকালে হয় তার ফলাফলও তত ইতিবাচক হয়৷ এমনকি পরীক্ষার আগে যারা আধঘণ্টার বিশ্রাম নেয়, তাদের মধ্যেও মনোযোগ বেশি হয়৷ অর্থাৎ সকালেই মানুষ থাকে তার সেরা ফর্মে৷
ছবি: Fotolia/Syda Productions
5 ছবি1 | 5
কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক দৈনন্দিন রুটিন কাজগুলিকে অভ্যাসে পরিণত করে৷ আমরা সফলভাবে যে সব কাজ করি, মস্তিষ্ক তা মনে রাখে৷ তারপর কাজের তারিফ করে সংকেত পাঠিয়ে আমাদের বাহবা দেয়৷
প্রথমবার কোনো মুভমেন্ট বা সঞ্চালনের সময় পূর্ণ মনোযোগ দিতে হয়৷ মস্তিষ্কের সামনের অংশ, অর্থাৎ সচেতনতার অংশে তা ঘটে৷ কিন্তু একই কাজ বেশ কয়েকবার করলে তার নিয়ন্ত্রণ মস্তিষ্কের গভীর অংশ, অর্থাৎ অবেচতনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷
মস্তিষ্ক বেশ চাতুর্যের সঙ্গে কাজটা করে৷ এভাবে অনেক নতুন ও জরুরি বিষয়ের জন্য মস্তিষ্কে নতুন ক্ষমতা সৃষ্টি হয়৷ তাকে অনেক তথ্য ছেঁকে নিতে হয়, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং শরীরকে চালনা করতে হয়৷
অভ্যাস না থাকলে আমাদের মস্তিষ্ক তার কর্মক্ষমতার সীমায় পৌঁছে যেত৷ নিয়মিত রুটিনমাফিক কাজগুলি অবচেতন মনে চলে বলেই আমরা দৈনন্দিন জীবন সামলে নিতে পারি৷
ফলে আমাদের আর সবসময়ে মৌলিক আচরণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হয় না৷ তখন জরুরি বিষয়গুলির প্রতি মনোযোগ দিতে পারি৷ একইসঙ্গে নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়৷
স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ১২ উপায়
আপনি কি কাজের চাপে প্রায়ই এটা-সেটা ভুলে যাচ্ছেন বা আপনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে? এর পরিণাম কিন্তু হতে পারে ভয়ংকর৷ তাই বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জেনে নিন সতর্কতা এবং স্মৃতিশক্তিকে মজবুত করার কিছু উপায়৷
ছবি: jorgophotography - Fotolia.com
পর্যাপ্ত ঘুম
রাতে ৬ ঘণ্টার কম ঘুম হলে তা বার্ধক্য প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে মস্তিষ্কে বাঁধার সৃষ্টি করে, জানান রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মাইকেন নেডেরগার্ড৷ তিনি জানান, এর জন্য জরুরি হচ্ছে গভীর ঘুম৷ এটা না হলে মস্তিষ্ক প্রায় সাত বছর বেশি বুড়িয়ে যেতে পারে৷
ছবি: Colourbox
মস্তিষ্কের জন্য ঠান্ডা ঘরই ভালো
গরমের চেয়ে ঠান্ডায় স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগ তিনগুণ বেশি থাকে৷ এ কথা জানান নিউ সাউথ ওয়েল্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রেলিয়ান মনোবিজ্ঞানী প্রফেসার ইয়োসেফ ফোরগাস৷ এছাড়া ঠান্ডা ঘর মাথাকেও ঠান্ডা রাখে, তাই ঘরের তাপমাত্রা কখনো ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি রাখা ঠিক নয়, জানান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
গল্প শেষ থেকে শুরু করুন
একটি গল্প পড়ে পুরো গল্পটা মনে রাখুন৷ এবার শুরু থেকে না বলে শেষ বা পেছন থেকে গল্পটা মনে করতে থাকুন৷ এই পন্থা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে সচল তো রাখবেই, করবে আরো শক্তিশালী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Endig
সঠিক জুতো পরে বেরিয়ে পড়ুন
নিয়মিত হাঁটাচলা বা জগিং শরীরকে ভালো রাখে – এ কথা কম-বেশি আমরা সকলেই জানি৷ সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী মার্ক ম্যাকডানিয়েল জানান, শুধু শরীর নয় হাঁটাচলা এবং জগিং ব্রেনকেও ফিট রাখে৷ তবে সবচেয়ে ভালো হয় সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন অন্তত ২০ মিনিট করে হাঁটলে বা জগিং করলে৷
ছবি: Fotolia/ruigsantos
বিপরীত হাত ব্যবহারের অভ্যাস
যাঁরা ডান হাতে সব কিছু করেন, তাঁরা বাঁ হাতে আর যাঁরা বাঁ হাতে সব কিছু করেন, তাঁরা ডান হাতে সপ্তাহে অন্তত একবার সব কাজ করার চেষ্টা করুন৷ অর্থাৎ উল্টো হাতে খাওয়া-দাওয়া, দাঁতব্রাশ করা বা অন্যান্য টুকটাক ঘরের কাজ করার অভ্যাস করতে পারেন৷ এতেও ব্রেন সচল থাকে৷
ছবি: Fotolia/Photo_Ma
বন্ধুত্ব লালন করুন
মানুষের সাথে কথাবার্তা বলা বা টেলিফোনে যোগাযোগ মস্তিষ্ককে তরুণ রাখে৷ এই তথ্যটি জানিয়েছেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজিস্ট ড. স্টুয়ার্ট রিচি৷ তিনি বলেন, দিনে মাত্র ১০ মিনিটের যোগাযোগই নাকি মানুষের স্মৃতিশক্তিকে বেশ জোড়ালোভাবে জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করে৷
ছবি: Fotolia/szeyuen
প্রতিদিনের নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসুন
ব্রেনকে সব সময় নতুন কিছু শিখতে হয়৷ তা না হলে মস্তিষ্ক নির্জীব হয়ে যায়৷ তাই প্রতিদিনের রুটিন ভেঙে অন্যকিছু করুন৷ মাঝে মাঝে অন্য রাস্তা দিয়ে কর্মস্থলে বা কলেজে যান৷ নতুন কোনো ভাষা বা যন্ত্র বাজানো শিখুন৷ এতে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি শতকরা ৭৫ ভাগ কমে যায়৷ নিউ ইয়র্কের আলবার্ট আইনস্টাইন মেডিকেল কলেজের করা এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে এ তথ্য৷
ছবি: Fotolia/Peter Atkins
পায়ের আঙুলের ম্যাসাজ
প্রতিদিন পাঁচ মিনিট করে পায়ের আঙুল ম্যাসাজ করুন৷ প্রথমে আঙুলের ওপর থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে টিপে টিপে নীচের দিকে যান৷ এই ম্যাসাজ মস্তিষ্কের কোষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে৷
ছবি: Elenathewise - Fotolia.com
শপিং লিস্ট
বাজারে বা দোকানে যাওয়ার আগে কী কী কিনবেন তার একটি লিস্ট তৈরি করে নিন এবং ইচ্ছে করেই সেটা বাড়িতে রেখে শপিংয়ে চলে যান৷ ফিরে এসে দেখুন ক’টা ভুলে গেছেন আর ক’টা মনে রাখতে পেরেছেন৷ এই নিয়ম যত বেশি করা হবে, ব্রেন তত দীর্ঘ সময় মস্তিষ্কে ‘সেভ’ করে রাখতে পারবে তথ্যগুলো৷
ছবি: imago/blickwinkel
দুই কাপ কফিই যথেষ্ট
দিনে দুই কাপ কফি পান করলে আলৎসহাইমার ঝুঁকি কমে শতকরা ২০ ভাগ৷ একটি সমীক্ষার ফলাফল থেকে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন ডিমেনশিয়ার পর্তুগিজ গবেষক ড. কাটারিনা সান্তোস৷ কারণ কফি পান তিরিশের বেশি বয়সিদের মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যাওয়া থেকে অনেকটাই রোধ করে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে৷
ছবি: Fotolia/Kim Schneider
রুটিন চেকআপ
হৃদপিণ্ডের নানারকম অসুখের ঝুঁকির কারণেও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যেতে পারে৷ তাই বছরে একবার রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কোলেস্টোরলের মাত্রা পরীক্ষা করানো উচিত৷
ছবি: Fotolia/Andrei Tsalko
মস্তিষ্কের খাবার
আখরোটের ‘পলিফেনল’ ব্রেনের স্মৃতি শক্তি বাড়িয়ে দেয়৷ তাছাড়াও সামুদ্রিক মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, পালং শাক, ডার্ক চকলেট, গ্রিন টি, অলিভ অয়েল, শাক-সবজি ইত্যাদি মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষায় খুবই জরুরি৷