পৃথিবীর বুকে বসে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিশালত্ব সম্পর্কে ধারণা করা সত্যি কঠিন৷ বিশেষ করে বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যে দূরত্ব মাপা বড় চ্যালেঞ্জ৷ বিজ্ঞানীরা সেই লক্ষ্যে কিছু কৌশল প্রয়োগ করেন৷
বিজ্ঞাপন
মহাকাশে দূরত্ব মাপার উপায় কী? মাইল বা কিলোমিটারের মতো পরিচিত মাপকাঠি দিয়ে আমাদের সৌরজগতে মাপজোক করা সম্ভব নয়৷
গত কয়েক দশকে আমরা সৌরজগতের সীমানার বাইরেও মহাকাশযান পাঠিয়েছি৷ এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের মহাজাগতিক বস্তু, অর্থাৎ প্রায় ৪ লক্ষ কিলোমিটার দূরে চাঁদের বুকে মানুষ পা রেখেছে৷ প্রায় দেড়শো কোটি কিলোমিটার দূরে শনিগ্রহের সঙ্গে তুলনা করলে সেই দূরত্ব অবশ্য কিছুই নয়৷
কখনো যদি আমাদের সবচেয়ে কাছের সৌরজগতে যেতে হয়, তার জন্য প্রায় ৪০ লক্ষ কোটি কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে৷ সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর প্রায় ৩ বছর সময় লাগবে৷ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আলো একই গতিতে এগিয়ে যায়৷ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাই সেই সময়কে মানদণ্ড হিসেবে স্থির করেই দূরত্বের বর্ণনা দেন৷
মহাকাশে মাপজোকের নানা মানদণ্ড
02:48
সেইসঙ্গে তথাকথিত ‘প্যারালাক্স' পদ্ধতির মাধ্যমে তাঁরা দূরত্ব মাপেন৷ সে ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো বিশেষ নক্ষত্রের কোণ মাপেন৷ ৬ মাস পর আবার নতুন করে সেই মাপ নেওয়া হয়৷ ত্রিকোণমিতির সাহায্যে তাঁরা অঙ্ক কষে পৃথিবী থেকে সেই নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয় করেন৷ তবে এই প্রক্রিয়া শুধু অপেক্ষাকৃত কাছের অঞ্চলে প্রয়োগ করা সম্ভব৷ অর্থাৎ প্রায় ১৫০ আলোকবর্ষ পর্যন্ত দূরত্বে তা কার্যকর হয়৷
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মিল্কি ওয়ে ছায়াপথের আয়তন অথবা আমাদের প্রতিবেশী ছায়াপথের সঙ্গে দূরত্ব মাপতে চাইলে অন্য মাপকাঠির প্রয়োজন হয়৷ তার পোশাকি নাম ‘সেফাইড' – অর্থাৎ যে সব নক্ষত্রের মিটমিটে আলোর বিকিরণের সঠিক পরিমাণ জানা আছে, সেগুলিই মাপকাঠি হয়ে ওঠে৷ সেগুলিকে মান নির্ণায়ক মোমবাতিও বলা হয়৷ ‘সেফাইড' থেকে যে পরিমাণ আলো টেলিস্কোপে ধরা পড়ে, তা বিচার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূরত্ব মাপতে পারেন৷ নির্দিষ্ট ধরনের বিস্ফোরণরত নক্ষত্র আরও উজ্জ্বল মান নির্ণায়ক মোমবাতি৷
মহাকাশে হাবল টেলিস্কোপে দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ডের প্রান্ত পর্যন্ত আলোর এই সব উৎস ধরা পড়ে৷ একটি ছবিতে এমন সব গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে, যেগুলি পৃথিবী থেকে প্রায় ১,৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে৷ এত দূরের কোনো দৃশ্য সত্যি বিরল৷
মহাকাশে তিন লাখ নতুন ছায়াপথ আবিষ্কার
‘লোফার’ রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে নতুন প্রায় তিন লাখ ছায়াপথ আবিষ্কার করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা৷ বিজ্ঞানীদের আশা, এর মাধ্যমে কৃষ্ণগহ্বর এবং ছায়াপথ কীভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যাবে৷
ছবি: LOFAR/Maya Horton
লাল আলোকচ্ছটা
‘হেটডেক্স’ এলাকার এই ‘মোন্টাজ’ এ অনেকগুলো ছায়াপথ দেখা যাচ্ছে৷ ১৮টি দেশের ২০০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী এই লাখো ছায়াপথ আবিষ্কার করেছেন, যা আগে অন্য কেউ কখনও দেখেনি৷ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রেডিও টেলিস্কোপ নেটওয়ার্ক ‘লো ফ্রিকোয়েন্সি অ্যারে’ বা ‘লোফার’ এর মাধ্যমে উত্তর আকাশে একটি নতুন মানচিত্র তৈরি করেছেন৷
ছবি: LOFAR/Judith Croston
জ্যোতির্ময় পাখা
রেডিও উৎস ‘বিথ্রি জিরো ওয়ান ফাইভ সেভেন প্লাস ফোর জিরো সিক্স’ উৎসের চৌম্বকক্ষেত্র সম্পর্কে বিশাল আকারের আলোড়নের উপস্থিতি নির্দেশ করে৷ অনেকেই এটাকে পাখার আকৃতি হিসেবে দেখতে পায়৷
ছবি: LOFAR/Maya Horton
সর্পিল ছায়াপথ
এই উজ্জ্বল বর্ণিল লেজটি সর্পিল ছায়াপথ ‘এম ওয়ানজিরোসিক্স’ এর৷ গবেষকদের বিশ্বাস, অগ্নিশিখার মতো দেখতে এই কাঠামো ছায়াপথের কেন্দ্রীয় বিশাল আকারের কৃষ্ণগহ্বরের কর্মকাণ্ডের ফলাফল৷ হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ মারকুস ব্রুগেন বলেন, ‘‘লোফারের মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করছি, ছায়াপথের যেখানে কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে, সেখানে এটা থাকার কারণ কি?’’
ছবি: LOFAR/Cyril Tasse
‘ঘূর্ণাবর্ত ছায়াপথ’
এমফিফটিওয়ান ‘ঘূর্ণাবর্ত ছায়াপথ’ নামে পরিচিত বলে জানিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা৷ এর অবস্থান পৃথিবী থেকে দেড় থেকে সাড়ে তিন কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে৷ এর কেন্দ্রে রয়েছে বেশ বড় আকারের কৃষ্ণগহ্বর৷
ছবি: LOFAR/Sean Mooney
রক্তচক্ষু
‘সিআইজেডএ জেটুটুফোরটু পয়েন্ট এইট প্লাস ফাইভ থ্রি জিরো ওয়ান’ ছায়াপথ গুচ্ছের এই নাম দেয়া হয়েছে৷ গবেষকদের আশা, লোফারের নতুন তথ্য ছায়াপথ গুচ্ছ কীভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কেও ধারণা দেবে৷
ছবি: LOFAR/Duy Hoang
মহাকাশে বিস্ফোরণ
ছায়াপথ ‘আইসি থ্রিফোরটু’ এর সর্পিল বাহুতে সুপারনোভার বিস্ফোরণের ছবি আপনারা দেখছেন এখানে৷ নতুন আবিষ্কৃত ছায়াপথগুলো সম্পর্কে জ্যোতির্বিজ্ঞানী সাইরিল টাসে জানালেন, ‘‘এর মাধ্যমে মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন দিক উন্মোচিত হলো৷’’
ছবি: LOFAR/Maya Horton
চমকপ্রদ তারকাপুঞ্জ
লোফারের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অপূর্ব কিছু ছবির জন্য মাঝে মাঝে কৌশলের আশ্রয় নেন৷
ছবি: LOFAR/Cyril Tasse
এক কোটি ডিভিডি
ছায়াপথ গুচ্ছ ‘অ্যাবেল ওয়ানথ্রিওয়ানফোর’ পৃথিবী থেকে অন্তত ৪৬ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত৷ লোফারের গবেষকরা এটি সহ অন্তত তিন লাখ নতুন ছায়াপথের অনেক তথ্য সংগ্রহ করছেন৷ জার্মানির বিলেফেল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডোমিনিক সোয়ার্ৎস জানালেন, ‘‘আমরা এত তথ্য পেয়েছি যা অন্তত এক কোটি ডিভিডিতে ধারণ করা যায়৷ আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছি৷’’