মহাকাশের রহস্য জানতে কে না চায়? আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নিত্য-নতুন তথ্য পেলেও তা সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে তার নাগাল পেতে হিমশিম খেতে হয় তাঁদের৷ এক জার্মান বিজ্ঞানী সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন৷
বিজ্ঞাপন
তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের মধ্যে সৃজনশীলভাবে সমন্বয় সাধন করতে হাইডেলব্যার্গ ইন্সটিটিউট ফর থিওরেটিকাল স্টাজিস বা ‘হিটস' গড়ে তোলা হয়েছিল৷ সেখানকার গবেষক কাই পলস্টারার নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পছন্দমতো কাজ করার, নিজের প্রকল্পের পরিকল্পনা করার যে স্বাধীনতা রয়েছে, তা সত্যি অনবদ্য৷ অন্য কোথাও এমন সুযোগ পাওয়া কঠিন৷ নিজের আগ্রহ, গবেষণার বিষয়, তার পরিকল্পনা – সবই নিজের হাতে৷''
মহাশূন্যে হাত বাড়াচ্ছে ইউরোপ
চালকযুক্ত স্পেস ক্যাপসুলটির নাম ওরিয়ন৷ এসা এবং নাসা ২০১৭ সালে যৌথভাবে এই ক্যাপসুলটিকে মহাশূন্য প্রেরণ করবে৷ এসা দেবে মুখ্য মডিউলটি৷
ছবি: ESA/Foster + Partners
তারা থেকে তারায়
চালকযুক্ত স্পেস ক্যাপসুলটির নাম ওরিয়ন৷ এসা এবং নাসা ২০১৭ সালে যৌথভাবে এই ক্যাপসুলটিকে মহাশূন্য প্রেরণ করবে৷ এসা দেবে মুখ্য মডিউলটি৷ ক্যাপসুলটি প্রথমে চন্দ্র প্রদক্ষিণ করবে৷ তারপর মহাশূন্যে অবস্থান নেবে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু হিসেবে৷ হয়তো মঙ্গলগ্রহ যাত্রার পথে তা কাজে লাগবে৷
ছবি: ESA-D. Ducros, 2012
মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় অভ্যস্ত হওয়া
প্রথমে ইউরোপের নভচারীদের পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএস’এ যাত্রা করার পালা৷ এসা’র অ্যাস্ট্রোনট ইটালির লুকা পার্মিতানো একটি জলের চৌবাচ্চায় স্পেস ওয়াক অভ্যেস করছেন৷ স্থান: কোলোনের কাছে ইউরোপীয় নভচারী কেন্দ্র (ইএসি)৷
ছবি: ESA/H. Rueb, 2010
আইএসএস’র জন্য তিন ইউরোপীয় নভশ্চর
লুকা পার্মিতানো আইএসএস’এ থাকবেন এ’বছরের মে মাস থেকে নভেম্বর মাস অবধি৷ ২০১৪ সালে এ’ভাবেই যাবেন জার্মানির আলেক্সান্ডার গের্স্ট৷ তারপরে যাবেন একজন মহিলা, ইটালির সামান্থা ক্রিস্টোফোরেত্তি৷
ছবি: dapd/NASA
মানুষের বদলে মাল পরিবহণ
তিন ইউরোপীয় নভশ্চর আইএসএস’এ যাবেন রুশ সোয়ুজ রকেটে চড়ে৷ এসা ইতিমধ্যে তথাকথিত অটোম্যাটিক ট্রান্সফার ভেহিকেল বা এটিভি’র মাধ্যমে আইএসএস’এ মালপত্র পাঠায়৷ পরের যাত্রা আগামী ১৮ই এপ্রিল৷ এটিভি’তে সাত টন খাদ্য ও সরঞ্জাম পাঠানো যায়৷
ছবি: ESA/S.Corvaja/dapd
চন্দ্রবাসের স্বপ্ন
চন্দ্রপীষ্ঠে এ’ধরনের একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন থেকে এসা এখনও অনেক দূর৷ সেখানে জন পাওয়া গেলে, তা’তে চাঁদের ধুলো মিশিয়ে বাড়িঘর তৈরি করা যেতে পারে৷ এবং চাঁদে জল আছে কিনা, চীনের চাঙ-ই ৩ রোভার চন্দ্রযান তা এ’বছরেই জানতে পারবে৷ চন্দ্রে অবতরণের পর এসা ঐ রোভারে তথ্য পাঠানোর ভার নেবে এবং তার গতিবিধি পরিচালনা করবে৷
ছবি: ESA/Foster + Partners
ডার্মস্টাট থেকে স্যাটেলাইট পরিচালনা
এসা’র ইউরোপীয় মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা এসক থেকে চাঙ-ই ৩’এর আগের চীনা মহাকাশযানগুলিতে তথ্য পাঠানোয় সাহায্য করা হয়েছিল৷ চীনের আগের মহাকাশযানগুলি চন্দ্র প্রদক্ষিণ করেছে কিন্তু চন্দ্রপীষ্ঠে অবতরণ করেনি৷ এসক থেকে অপরাপর বহু গবেষণা ও যোগাযোগ সংক্রান্ত স্যাটেলাইটের যাত্রার উপর নজর রাখা হয়৷
ছবি: ESA - J. Mai
থ্রি-ডি’তে আমাদের ছায়াপথ
এ’বছরের অক্টোবর মাসে স্পেস প্রোব বা মহাশূন্য অভিযাত্রী যান ‘গাইয়া’ তার যাত্রা শুরু করবে৷ ইন্টারোফেরোমিটারের সাহায্যে আলোকতরঙ্গ থেকে আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জের একটি থ্রি-ডি ছবি তৈরি করবে এবং ‘মিল্কি ওয়ে’ ছায়াপথের অনেক রহস্য উদঘাটন করবে৷ এসা’র গবেষকরা অন্তত এক বিলিয়ন নতুন তারা আবিষ্কার করার আশা করছেন৷ এমনকি তিন বিলিয়নও হতে পারে৷
ছবি: ESA/Medialab
গ্রহাণুর সন্ধানে
রোজেট্টা স্পেস প্রোব’টি ২০০৪ সাল যাবৎ ৬৭/পি চুরজুমভ-গেরাসিমেঙ্কো ধূমকেতু অভিমুখে যাত্রা করছে৷ ২০১৪ সালের সূচনায় মহাকাশযানটি ধূমকেতুটির কক্ষপথে যোগদান করবে৷ তবে ধূমকেতু অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে রোজেট্টা অনেক কিছু দেখবে: নাসা’র ডিপ ইমপ্যাক্ট প্রোজেক্টাইলটি কিভাবে টেম্পল ওয়ান ধূমকেতুতে আঘাত করবে৷ এচাড়া রোজেট্টা দেখবে মঙ্গলগ্রহ এবং স্টাইনস ও লুটেশিয়া নামের দ’টি অ্যাস্টেরয়েড বা গ্রহাণু৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধূমকেতুর উপর অবতরণ
২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে রোজেট্টা ফিলি নামের এই রোবোটটিকে ধূমকেতুর উপরে নামাবে৷ কোলোনে অবস্থিত জার্মান বিমান ও মহাকাশযাত্রা কেন্দ্র ডিএলআর থেকে সেই অবতরণ নিয়ন্ত্রণ করা হবে৷ কাজটা শক্ত হবে, কেনান ধূমকেতুটির মাধ্যাকর্ষণ খুব বেশি নয়৷ রোজ্ট্টা ধূমকেতুটির রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করবে৷
ছবি: ESA/AOES Medialab
স্যাটেলাইটের রিসাইক্লিং সম্ভব নয়
অর্ধশতাব্দী ধরে মহাকাশে রকেট ও স্যাটেলাইট পাঠানো হচ্ছে৷ এক সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় প্রায় ছ’লাখ নানা ধরনের ও আকারের স্ক্র্যাপ এ’ভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে৷ এসা চাপ দিচ্ছে মহাশূন্যে আবর্জনা কমানোর জন্য: অকেজো স্যাটেলাইটগুলোকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রিতভাবে ভূপাতিত করতে হবে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
কাই পলস্টারার জ্যোতার্বিজ্ঞানীদের তথ্য সংরক্ষণের কাজ সহজ ও আরও কার্যকর করে তুলতে চান৷ এই লক্ষ্যে তিনি ‘অ্যাস্ট্রো কম্পিউটার সাইন্স' নামের একটি ক্ষেত্র গড়ে তুলছেন৷ মহাকাশের অনেক ছবির নাগাল পাওয়া কঠিন৷ বিভিন্ন মানমন্দিরের আর্কাইভে সে সব পড়ে থাকে৷ যেমন একশো বছরেরও বেশি পুরানো অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির এক ফটো-প্লেট৷ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এটা গুপ্তধনের মতো৷ এই কাচ ভেঙে গেলে অমূল্য তথ্য চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে৷ কাই পলস্টারার তাই এই সব ছবির ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করে সবার নাগালে আনতে চান৷
আগামী কয়েক বছরে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত তথ্যের পরিমাণ বিশাল মাত্রায় বেড়ে যাবে৷ টেলিস্কোপগুলির ক্ষমতা আরও বাড়তে থাকবে৷ চলতি দশকের শেষে চিলি-তে মার্কিন লার্জ সিনপটিক সার্ভে টেলিস্কোপ কাজ শুরু করবে৷ মাত্র তিন রাতেই এই টেলিস্কোপ গোটা আকাশের ছবি তুলতে পারবে৷ শুধু এই একটি টেলিস্কোপ প্রতি রাতে ৬০ টেরা বাইট পরিমাণ তথ্য সৃষ্টি করবে৷ ড.কাই পলস্টারার বলেন, ‘‘ভেবে দেখুন, প্রতি রাতে ৬০ মিটার উঁচু ডিভিডি-র স্তূপ তৈরি হচ্ছে৷ অর্থাৎ বিশাল পরিমাণ ডাটা৷ আর পুরানো পাঞ্চ কার্ডের হিসেবে প্রতি রাতে বিশাল কন্টেনার জাহাজ ভরে যাবে৷ পুরোটাই তথ্য সংরক্ষণের জন্য৷ এর অর্থ হলো, আমাদেরই তৈরি ডাটার ভার আমরা আর সামলাতে পারছি না৷''
মহাশূ্ন্যে বানর পাঠিয়ে ধাপ্পাবাজি?
ইরানের নিজস্ব বিবৃতি অনুযায়ী, সেদেশ ২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি একটি বানরকে যাত্রী করে মহাশূন্যে রকেট পাঠিয়েছে এবং সেটিকে আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফেরত নিয়ে এসেছে৷ কিন্তু ব্যাপারটায় একটা গোলমাল আছে৷
ছবি: Isna
যাত্রা শুরুর অপেক্ষায়
‘কাওয়শগর’ ক্যাপসুলটি একটি অপরিচিত স্থানে ভ্রাম্যমাণ লঞ্চ-প্যাডে দাঁড়িয়ে, যাত্রা শুরুর অপেক্ষায়৷ যাত্রী হিসেবে একটি বানরের ভিতরে থাকার কথা৷
ছবি: Irna
চুপচাপ বসো...
যাত্রা শুরুর আগে বানরযাত্রীর ছবি৷ তার নাম রাখা হয়েছে আফতাব বা সূর্য৷
ছবি: Irna
এবার সামলে
নভোচারীর পোশাকে আফতাব৷ বেঁধেছেদে রাখায় তাকে খুব খুশি দেখানোর কথা নয়৷ ডান চোখের উপর আঁচিল কিংবা জরুলটা খেয়াল করবেন৷
বানরযাত্রীর কি অবস্থা?
২৮শে জানুয়ারি ইরানের সংবাদ সংস্থাগুলি মহাকাশযানের সফল যাত্রা শুরুর খবর দেয়৷
ছবি: Irna
বানর নভোচারীর ধরায় প্রত্যাবর্তন
মহাশূন্যে ১৬ মিনিটের যাত্রার পর আফতাব বহাল তবিয়তে ধরাধামে প্রত্যাবর্তন করেছে, বলে ইরানি সংবাদ সংস্থাগুলি জানায়৷ ইরানের মহাকাশ অভিযান কর্তৃপক্ষ একটি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন, যেখানে আফতাব নাকি সাংবাদিকদের হাসির খোরাক জুটিয়েছে, বলে সরকারি ইসনা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে৷
ছবি: Isna
ধকলের কোনো লক্ষণ নেই আফতাবের
অতো বড় মহাকাশযাত্রার পরেও আফতাব টপ ফর্মে, সেটা কি করে সম্ভব? বানর নভোচারীকে একটু ভালো করে দেখা দরকার...
ছবি: Isna
বদলে গেছে আফতাব!
সত্যিই, মহাকাশযাত্রার ফলে যেন আফতাবের বয়স কমে গেছে৷ ডানচোখের ওপর জরুলটা উধাও হয়েছে৷ গোঁফদাড়ি আগে সাদাটে ছিল, এখন ঘন বাদামি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
এমন একটি ‘আশ্চর্য’ সাফল্য
ইরানের মহাকাশযাত্রা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান মোহাম্মেদ ইব্রাহিমি (ডানদিকে; বাঁয়ে রয়েছেন হামিদ ফাজেলি, মহাকাশযাত্রা কর্তৃপক্ষের প্রধান) যেন নিজেই সেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না...
ছবি: Isna
8 ছবি1 | 8
কাই পলস্টারার তাই এমন কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করতে চান, যার সাহায্যে অনেকগুলি আর্কাইভের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মহাজাগতিক বস্তুর খোঁজ চালানো যাবে৷ কাজে লাগানো হবে এমন সফটওয়্যার, যা মানুষের সাহায্য ছাড়াই আরও বুদ্ধিমান হয়ে উঠতে পারে৷ ড. পলস্টারার বলেন, ‘‘যন্ত্রের শিক্ষাগ্রহণ অনেকটা ছোট শিশুদের সঙ্গে খেলার মতো৷ আমার ছোট মেয়ের সঙ্গে যখন বিল্ডিং ব্লক তৈরির খেলা খেলি, তখন তাকে বলি না – যাও এমন দেখতে, এমন রংয়ের বা এমন আকারের একটা ব্লকের টুকরো নিয়ে এসো৷ একই রকম দেখতে একটা ব্লক দেখিয়ে তাকে বলি, এমন ব্লক খুঁজছি৷ তখন সে বেশ তাড়াতাড়ি সেটা খুঁজে পায়৷''
যে সব জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তন প্রক্রিয়া কম্পিউটারে ফুটিয়ে তুলতে চান, তাদের জন্য এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ৷ মহাকাশের ছবির সঙ্গে তাঁদের মডেল মিলিয়ে দেখতে হয়৷ আর্কাইভে নতুন বা বিরল কোনো মহাজাগতিক বস্তু পেলে মডেলেও পরিবর্তন করা যাবে৷ ড. পলস্টারার বলেন, ‘‘বড় ক্যাটালগ ঘাঁটতে গেলে বা তা বিশ্লেষণ করতে গেলে কম্পিউটার আমাদের বুদ্ধিমান অ্যাসিস্টেন্টের মতো সাহায্য করবে, সেটাই তো চাই৷ যান্ত্রিক, একঘেয়ে কাজ তাকেই করতে হবে৷''
কাই পলস্টারার এই সব ডাটার থ্রিডি সিমুলেশনের স্বপ্ন দেখছেন৷ গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি তাদের বিবর্তন বুঝতে অনেক বেশি সাহায্য করবে৷ ফলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আরও নতুন জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব হবে৷