জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবার এসপিডি নেতা মার্টিন শুলৎসের সঙ্গে কথিত ‘মহাজোট' গঠনের ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছেন৷ আগামী শুক্রবার পর্যন্ত যা চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
বার্লিনে শুরু হয়েছে এই প্রাথমিক আলোচনা, যেখানে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল রবিবার সিএসইউ নেতা হোর্সট জেহোফার এবং এসপিডি নেতা মার্টিন শুলৎসের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন৷
বার্লিনে সামাজিক গণতন্ত্রী দল এসপিডি'র সদর দপ্তরে তিনটি দল থেকে ১৩ জন প্রতিনিধি নিয়ে শুরু হয়েছে এই আলোচনা৷ যেখানে মূলত আলোচনা হচ্ছে ‘নতুন মহাজোটের' চুক্তি ও শর্ত নিয়ে৷ আজ সন্ধ্যার মধ্যেই হয়ত তিনটি দল তাদের মূল দাবিগুলো তুলে ধরবে৷
গত বছরের সেপ্টেম্বরের সংসদ নির্বাচনের তিন মাস পর শুরু হলো এই আলোচনা৷ প্রথম দফায় ম্যার্কেল চেষ্টা করছিলেন এফডিপি এবং গ্রিন পার্টির সাথে জোট গঠন করতে, যা নভেম্বরে ব্যর্থ হয়৷ কেননা এফডিপি প্রধান ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার আলোচনা থেকে সরে আসেন৷
কী চায় জার্মানির এসপিডি দল?
ছোট শরিক হয়েও জার্মানির বিদায়ী মহাজোট সরকারে যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে অনেক দলীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পেরেছে এসপিডি দল৷ তবে ভোটাররা তার স্বীকৃতি দেয়নি৷ আবার মহাজোটে যোগ দিলে অনেকগুলি শর্ত চাপাতে চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/U. Baumgarten
‘আরও ইউরোপ’
বর্তমান সংকটগুলির সমাধানের লক্ষ্যে ব্রেক্সিটের পথে না গিয়ে ইইউ-কে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চায় জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ ইউরোপীয় স্তরে ন্যূনতম মজুরি, তরুণদের বেকারত্বের মোকাবিলা, কোম্পানিগুলির উপর অভিন্ন কর চাপানো এবং ‘কর ফাঁকির মরুদ্যান’ বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন দলের নেতা মার্টিন শুলৎস৷ ২০২৫ সালের মধ্যে ‘ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্র’ স্থাপনের স্বপ্ন দেখছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই প্রাক্তন স্পিকার৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. Florin
শ্রমিকদের আরও অধিকার
জার্মানিতে শ্রমিক-কর্মীদের অধিকার বাড়াতে চিরকাল উদ্যোগ নিয়ে এসেছে সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ তবে সাম্প্রতিক কিছু সংস্কারের ফলে সেই ভাবমূর্তি বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছে৷ এবার বেতন ও মজুরি কাঠামো কার্যকর করা ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার দাবি জানাচ্ছে এসপিডি৷ তাছাড়া যারা পার্ট টাইম বা খন্ডকালীন কাজ করছে, তাদের ফুল টাইম বা পূর্ণ কাজের কাঠামোয় ফিরে যাবার অধিকারের স্বীকৃতি চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/Ulrich Baumgarten
অবসর ভাতার আমূল পরিবর্তন
সমাজে সংহতির ভিত্তিতে জার্মানির অবসর ভাতা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন চায় সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ বিশেষ করে সারা জীবন কাজ করেও শেষ বয়সে দারিদ্র্যের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চায় এসপিডি৷ অতএব সংহতির স্বার্থে অবসর ভাতার বিচ্ছিন্ন সব কাঠামোগুলিকে একত্র করার চেষ্টা চালাতে চায় তারা৷ অত্যন্ত জটিল এই ব্যবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন যে কঠিন হবে, সে বিষয়ে অবশ্য তেমন সংশয় নেই৷
ছবি: picture-alliance/S. Gollnow
বিনামূল্যে শিক্ষা
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় অংশই সরকারি ভরতুকিতে চলে৷ তবে অবকাঠামোর কিছু দুর্বলতার ফলে সমস্যা রয়েছে৷ বিশেষ করে শিক্ষা রাজ্য সরকারগুলির এক্তিয়ারে থাকায় এ ক্ষেত্রে সার্বিক উদ্যোগ নেওয়া কঠিন৷ এসপিডি দলের দাবি, সারা দেশে বিনামূল্যে কিন্ডারগার্টেন ও সেখানে সারাদিন বাচ্চা রাখার সুযোগকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির আধুনিকীকরণসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ চাই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থার সংস্কার
বর্তমানে জার্মানিতে সার্বজনীন ও বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা চালু রয়েছে৷ ডাক্তারখানা ও হাসপাতালে বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমাকারীদের বিশেষ খাতির করা হয়, অন্যদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়৷ এই বিভাজন ঘুঁচিয়ে সবাইকে নিয়ে এক ‘নাগরিক স্বাস্থবিমা’ চালু করতে চায় সামাজিক গণতন্ত্রীরা৷ তবে এই প্রস্তাবের জোরালো বিরোধিতা করছে বেশ কিছু মহল৷ তাদের আশঙ্কা, এর ফলে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মানের ক্ষতি হবে৷
ছবি: Colourbox
শরণার্থী নীতি
২০১৫ সালে বিশাল সংখ্যক শরণার্থীর ঢলের কারণে জার্মানির রাজনীতি জগত উত্তাল হয়ে উঠেছে৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেল তাঁর উদার মনোভাবের জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ এসপিডি গোটা অভিবাসন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের দাবি জানাচ্ছে, যাতে আইনি পথে বিদেশিরা জার্মানিতে এসে কাজের সুযোগ পায়৷ তবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার সঙ্কুচিত করার বিরোধী এই দল৷ আশ্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঊর্ধসীমাও মানতে নারাজ তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সন্ত্রাসী হামলা ও অপরাধ দমন করতে প্রায়ই হিমশিম খায় জার্মানির পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ৷ ফলে মানুষের মনে অসন্তোষ দেখা যায়৷ এই সমস্যার মোকাবিলা করতে এসপিডি দল আরও পুলিশকর্মী নিয়োগের দাবি জানাচ্ছে৷ সেইসঙ্গে অপরাধ প্রতিরোধ করার জোরালো উদ্যোগ চায় তারা৷ তাদের মতে, দাগী অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে গোটা ব্যবস্থায় আরও দক্ষতার ছাপ আনতে হবে৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/B. Marks
পরিবেশ সংরক্ষণ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে এককালে জার্মানি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে৷ বিকল্প জ্বালানির বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্যও এসেছে৷ কিন্তু কয়লার লাগাতার ব্যবহার, ডিজেল গাড়ি নিয়ে বিতর্কের মতো কারণে এ ক্ষেত্রে জার্মানির ভাবমূর্তি বেশ ধাক্কা খাচ্ছে৷ এমন প্রেক্ষাপটে এসপিডি বিকল্প জ্বালানির আরও ব্যবহারের উপর জোর দিতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নারী-পুরুষের সমানাধিকার
শিল্পোন্নত দেশগুলিতেও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য বাস্তব সমস্যা৷ এই তালিকায় জার্মানির অবস্থান ভালো নয়৷ একাধিক সরকার এই বৈষম্য দূর করতে শিল্প-বাণিজ্য জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে৷ এবার এসপিডি দল চায়, আলাপ-আলোচনার বদলে আইন করে তাদের এই বৈষম্য দূর করতে বাধ্য করা হোক৷
ছবি: Colourbox
9 ছবি1 | 9
এরপর ম্যার্কেলের জন্য একটাই পথ খোলা ছিল৷ তাহলো এসপিডি'র সঙ্গে জোট৷ আর এসপিডি'ও এই সুযোগ হাতছাড়া করছে না৷
শুলৎস যখন সিদ্ধান্ত নিলেন সিডিইউ এর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করবেন, সেটা যেন তাঁর আগের অবস্থানের একেবারে বিপরীত ছিল৷ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে শুলৎস পেয়েছিলেন মাত্র ২০ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট, যা এসপিডি আগে কখনো পায়নি৷ তখনই শুলৎস জানিয়েছিলেন, তার দল ম্যার্কেলের সঙ্গে আগামী চার বছর কাজ করবে না৷
যদিও অনেকেই মনে করছেন ম্যার্কেলের সঙ্গে জোট বাঁধলে এসপিডি আগামীতে আরও ভোটার হারাবে৷
প্রাথমিক এই আলোচনায় শুলৎস তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন, যা ম্যার্কেলের সিডিইউ পার্টি এবং তাদের বাভেরিয়ান সহযোগী দল সিএসইউ এর জন্য কিছুটা বিপদ ডেকে আনতে পারে৷ যেমন, সবার জন্য বাধ্যতামূলত সরকারি স্বাস্থ্য সেবা এবং শরণার্থীদের পরিবারের সদস্যদের জার্মানিতে নিয়ে আসার অনুমতি দেয়া৷
এরপর ২১শে জানুয়ারি বন শহরে দলের সম্মেলনে এসপিডি ভোটাভুটি করে ঠিক করবে ম্যার্কেলের দলের সাথে তারা আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করবে কিনা৷ অর্থাৎ এসপিডি'র ৪ লাখ ৪০ হাজার সদস্য মহাজোটের অংশ হতে চায় কিনা সে বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হবে৷
তবে সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন ইস্টারের আগে যে জার্মানিতে কোন সরকার গঠন হচ্ছে না, সেটা প্রায় নিশ্চিত৷
ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে জার্মানি
দেশজুড়ে ভোট দিচ্ছেন জার্মানরা৷ শুধু প্রার্থী নির্বাচন নয়, পরবর্তী চার বছরের জন্য কারা চালাবে দেশ, কোন পথে যাবে জার্মান নীতি, তাও নির্ধারিত হচ্ছে আজ৷ এক নজরে দেখে নিন ভোটের চিত্র৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
আঙ্গেলা ম্যার্কেল
বার্লিনের একটি কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন বর্তমান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ ধরেই নেয়া যায়, খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল – সিডিইউ-এর এই নেতা ভোটটা নিজেকেই দিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
মার্টিন শুলৎস
ম্যার্কেলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরা হচ্ছে সামাজিক গণতন্ত্রী দল – এসপিডি-র নেতা মার্টিন শুলৎসকে৷ বর্তমান সরকারে সিডিইউ-এসপিডি জোটে থাকলেও নির্বাচনে কোন ছাড় নেই৷ স্ত্রী ইঙ্গেকে নিয়ে আখেনের পাশে ভ্যুরসেলেনে ভোট দিয়েছেন শুলৎস৷
ছবি: Reuters/T. Schmuelgen
চেম ও্যজদেমির
গ্রিন পার্টি বা সবুজ দলের নেতা চেম ও্যজদেমির ভোট দিয়েছেন বার্লিনে৷ পর্যাপ্ত ভোট পেলে জোট সরকার গঠনের আলোচনায় অংশ নেয়ার সম্ভাবনা থাকছে ও্যজদেমিরের দলের৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Hirschberger
বার্লিনে ভোটারদের সারি
এমন চিত্র খুব একটা দেখা যায় না জার্মান নির্বাচনে৷ তবে দিনের শুরুর অংশে এমন দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়েই ভোট দিয়েছেন জার্মানরা৷ তবে দুপুরের দিকে একেবারেই কমে যায় ভোটারদের আনাগোনা৷
ছবি: Reuters/S. Loos
অভিবাসী জার্মান ভোটার
মাথায় স্কার্ফ পড়া এক নারী ভোট দিচ্ছেন বার্লিনের ক্রয়েসবার্গের একটি কেন্দ্রে৷ জার্মানিতে প্রতি দশ জন ভোটারের একজন অভিবাসী পরিবার থেকে আসা৷ অর্থাৎ তাঁরা অথবা তাঁদের বাবা-মায়ের জন্ম জার্মানির বাইরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Hirschberger
বহুসংস্কৃতির জার্মানি
বার্লিনে ভোট দেয়ার পর ডয়চে ভেলের সাথে কথা বলছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক জার্মান পরিবার৷ জার্মান পার্লামেন্টে ৬৩১ জন প্রতিনিধির ৩৭ জনই নিজেরা অভিবাসী অথবা অভিবাসী পরিবারের সন্তান৷