মহালছড়িতে আগুন দিয়েছে কে
১২ জুলাই ২০২২থানার ওসি আগুনের জন্য পাহাড়িদের দায়ী করছেন।
গত ৭ জুলাই মহালছড়ির মাইসছড়ি ইউনিয়নের জয়সেন পাড়ায় হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্তরা সংবাদমাধ্যমে কথা বললেও মঙ্গলবার তাদের অনেককেই ফোনে পাওয়া যায়নি। যাদের পাওয়া যায় তাদের মধ্যে একজন হলেন জয়সেন পাড়ার কারবারি জ্যোতি লাল চাকমা। ঘটনার সময় তিনি বাজারে ছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন,"ঘটনার দিন সকাল ৮টার আগে সেটেলাররা জুমের জমিতে তৈরি করা আমাদের ৩০টি বাড়িতে হামলা চালায় । মোট ২২টি বাড়ি ভাঙচুর করে এবং আগুনে পুড়িয়ে দেয়। আমরা প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। আমাদের দুই জন আহত হন। হামলা ও আগুনের মুখে আমরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হই।”
তিনি অভিযোগ করেন,"ঘটনার সময় অদূরেই পুলিশ থাকলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি । এর আগে গত ৮ মার্চও হামলা করেছিলো সেটেলাররা। এখন পুলিশ আমাদের ওই এলাকায় যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ৩০টি ঘরে ৩০টি পরিবারের বসবাস ছিলো। সবাই উচ্ছেদ হয়ে গেছে।”
তিনি জানান, তাদের বসতি থেকে আধা কিলোমিটার দূরেই সেটেলারদের আবাসস্থল যা মুসলিম পাড়া নামে পরিচিত।
জয়সেন পাড়া লেমুছড়ি মৌজার মধ্যে পড়েছে। ওই মৌজার হেডম্যান দিনেন্দ্র চাকমা। তিনি বলেন,"ওই এলাকায় জমিজমা নিয়ে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব আছে। আগেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। ওই দিন কারা আগুন দিয়েছে আমি জানি না।” আপনি মৌজার হেডম্যান হয়েও কেন জানেন না জানতে চাইলে বলেন," ওখানে এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান করছে। তারাই ভালো বলতে পারবে। শুনেছি পহাড়ি বাঙালি সবাইকে বিরোধপূর্ণ জমি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।”
উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কান্তি চাকমাও ঘটনা শুনেছেন বলে জানান। তবে কী ঘটেছে তা তিনি জানেন না। তিনি বলেন,"জমি জমা নিয়ে বিরোধ আছে। সেটা নিয়ে একটি ঘটনা ঘটেছে। বড় ঘটনা হবে বলে মনে হয় না। ওখানে এখন পুলিশ আছে। তবে প্রায়ই জমিজমা নিয়ে ওখানে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ঝামেলা হয়।”
আর সেটেলারদের মুসলিম পাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা সংবাদ মাধ্যমের কাছে দাবি করেন," ওই পাহাড়িরা টিলার ওপর কয়েকটি অস্থায়ী ঘরবাড়ি বনিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এটার সাথে পাহাড়ি একটি রাজনৈতিক চক্র জড়িত।”
দ্বন্দ্ব কী নিয়ে:
২০ একর জমি নিয়ে জয়সেন পাড়ায় পহাড়ি ও সেটেলার বাঙালিদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। ১৯৮৬ সালে দাঙ্গার পর পাহাড়িরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যান। ১৯৮৮ সালে ওই এলকায় বহিরাগত বাঙালিরা গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর বঙালিরা ১৯৯৭-৯৮ সালে ওই এলকা ছেড়ে গুচ্ছগ্রামে চলে যান। কিন্তু ওই ২০ একর জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই যায়।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা বলেন, এবার হামলার পর পাহাড়িরা ওই এলাকায় এখনো যেতে পারেনি, তবে ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলে হামলা ও আগুনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি বলেন,"ওই দিন মহালছড়ি বাজারে হাটবার থাকায় জয়সেন পাড়ার বয়স্করা সকালে হাটে যাওয়ার পর আগুন দেয়া হয়। এতে প্রায় ৩০টি ঘর পুড়ে যায়। পাশের সেটেলাররা এসে আগুন দেয় ও হামলা চালায়। যে ২০ একর জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব সেটা তো বাঙালিদের হতে পারে না। বংশানুক্রমে পাহাড়িরা ওই জমির মালিক। তারা এক সময় ভয়ে চলে গিয়েছিলো পরে আবার ফিরে আসেন। এই ফাঁকে সেটেলাররা জমি দখল করেছিল। শান্তি চুক্তির পর আমরা তো তাই ভূমি কমিশন গঠনের দাবি করে আসছি। ভূমি কমিশন গঠন না হলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।”
তিনি অভিযোগ করেন, হামলার পর পাহাড়িরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের কোনো নিরাপত্তা দেয়া হয়নি। আরো ভিতরে গিয়ে তারা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি বলেন,"শুরুতে আমরা টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পারলেও এখন আর পারছি না। তারা ভীতসন্ত্রস্ত আছে। মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন আমরা ভিন্নভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছি। স্থানীয় পুলিশ এবং প্রশাসন বিভ্রান্তিকর কথা বলছে। তারা হামলাকারীদের সুরেই কথা বলছে। কোনো মামলাও নেয়নি।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,"পাহাড়িরা নিজেদের তৈরি করা বাড়িতে নিজেরাই আগুন দিয়েছে এটা তো একটা বানানো কথা। এটা কল্পনাও করা যায় না। পাহাড়িরা নিজেরা ঘর বাড়ি বানিয়ে নিজেরাই আগুন দেবে এটা কীভাবে সম্ভব! বাস্তব পরিস্থিতি জানলে বুঝতে পারবেন এটা কল্পনার বাইরে।”
জ্যোতি লাল চাকমা বলেন,"ওই জমি বংশ পরম্পরায় আমাদের। ওটা কখনোই সেটেলারদের বন্দোস্ত দেয়া হয়নি। আমাদের মধ্যে দুইজনের নামে কাগজপত্র আছে। কিন্ত সেটেলাররা বার বার জমি দখলের চেষ্টা করেছে। আমরা গরিব মানুষ তাই পুলিশ প্রশাসন তাদের পক্ষে কাজ করছে।”
নিজেরাই নিজেদের বাড়িতে আগুন দিয়েছেন এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন,"আমরা কীভাবে আগুন দেব! আমরা তো হামলার মুখে পালিয়ে গেছি। আমাদের লোকজন তো আহত হয়েছে।”
ইউএনও এবং ওসি যা বললেন:
মহালছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা( ওসি )হারুনুর রশীদ দাবি করেন," ওই দিন বাঙালিরা ওই জমিতে গেলে পাহাড়িরা তাদের মারধোর করে। ওই জমিতে পাহাড়িদের দুইটি টং ঘর ছিলো তাতে নিজেরাই আগুন ধরিয়ে দেয়। বাঙালিরা কোনো ঘরে আগুন দেয়নি। কোনো পক্ষই মামলা করেনি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। কোনো সমস্যা নেই।”
তিনি বলেন," সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ওই ২০ একর জমি বাঙালিদের বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছিলো। তবে বাঙালিরা সেখানে গেলেই পাহাড়িরা মারধোর করত। তারা পুলিশকেও মানেনা। ঘটনার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি দুই পক্ষের কাগজপত্র দেখে সমাধান করে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তার আগে ওই জমিতে কেউ যেতে পারবেন না।”
মহালছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) জেবাইদা আক্তারের কাছে পাহাড়িদের বাড়িতে হামলা, আগুন ও জমির মালিকানা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,"পুরো বিষয়টি নিয়ে এখন তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমি কিছু বলতে পারবো না।”