ইদানীং মোটরসাইকেল চালকদের হয়েছে বিপত্তি৷ পদ্মাসেতু চালুর পর মহাসমারোহে সেটা দেখতে গিয়েছেন হাজার হাজার বাইকার৷ এখন সেতুতে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ৷ ঈদের সময়েও এক সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা৷
বিজ্ঞাপন
হঠাৎ করে বাইকারদের উপরে কেন এত নিষেধাজ্ঞা? সাদা চোখে উত্তরটা সহজ৷ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন৷ গত ঈদের যে পরিসংখ্যান নানা পত্রিকা ছেপেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, গত ঈদের সময় মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৩২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ নিহতদের ৪৩ শতাংশই ছিলেন মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী৷
বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেয়া তথ্য জানাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন হাজার ৩০৯ জন৷ নিহতদের মধ্যে মোটরসাইকেলের চালক বা আরোহীর সংখ্যা এক হাজার ৩১৩৷
এসব পরিসংখ্যান ভয় পাইয়ে দেয়ার মতোই৷ বাংলাদেশে সড়কে, মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানো যে বিপজ্জনক সেটা বেশ পরিষ্কারভাবেই ফুটে উঠেছে পরিসংখ্যানে৷ অবশ্য সড়ক দুর্ঘটনায় বাকি ৬০ শতাংশ যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে মোটরসাইকেলের সম্পর্ক নেই৷
কথা হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনারোধে কি তাহলে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করাই সমাধান? আমার কাছে সেটা মনে হয় না৷ বরং আমার কাছে মনে হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে কিছু রূঢ় বাস্তবতা তুলে ধরছে৷
আমি নিজে বাংলাদেশের সড়কে মোটরসাইকেল, গাড়ি চালিয়েছি৷ যে বিষয়টি আমার চোখে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে সেটা হচ্ছে, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, বাস বা ট্রাক যেটাই বলি না কেন, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব প্রকট৷ পাশাপাশি তাদের মধ্যে বেপরোয়া মানসিকতা দেখা যায়৷
বিশেষ করে দূরপাল্লার বাসের অনেক চালকের মধ্যে মহাসড়কে কোনো কিছু তোয়াক্কা না করার একটা প্রবণতা রয়েছে৷ যত্রতত্র ওভারটেক করা, অপর পাশ থেকে আসা মোটর সাইকেল, প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাসকে সাইড না দেয়া এসব চালকদের কাছে একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হয়৷
তাদের ঈদ ভাবনা
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সেতুর উদ্বোধন, প্রথমবারের মতো মহাসড়কের মোটরবাইক নিষিদ্ধকরণ, করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের আশঙ্কা৷ এর মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ঈদ ভাবনা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘মানুষ কেজি দরে গরুর দাম বলে’
বিক্রির উদ্দেশে ঢাকার গাবতলীতে পশুর হাটে কুষ্টিয়া থেকে ছয়টি গরু এনেছেন মো. বিল্লাল মিয়া৷ তিনি জানান, ‘‘এবারের হাটে এখন পর্যন্ত ক্রেতার সংখ্যা কম৷ ভোজ্য এবং জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর গো-খাদ্যের মূল্য ৫০ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে৷ অথচ হাটে মানুষ গরুর দাম বলছে মাংসের কেজির হিসাব করে৷’’ এতে গরু লালন-পালনের খরচও উঠবে না বলে দাবি করেন বিল্লাল মিয়া৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘কোরবানি দিতে পারতেসি না এইবার’
ঢাকার গুলিস্তান মোড়ে নতুন টাকার ব্যবসা করেন হারুনুর রশীদ৷ তিনি প্রায় ২০ বছর যাবত এই পেশায় আছেন৷ গত বছর কোরবানি দিলেও এবার সেই সামর্থ্য হচ্ছে না৷ বলেন, ‘‘মানুষের এইবারের মতো খারাপ অবস্থা আগে দেখি নাই৷ আমার নিজের অবস্থাই তো করুণ৷ গত বছর বাচ্চাদের শখ পূরণ কইরা একটা ছোট ছাগল কুরবানি দিসিলাম, কিন্তু এইবার কোনভাবেই সম্ভব হইতেসে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘পদ্মা সেতু দিয়ে পার হবো’
ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের নোঙর করা ঢাকা-হাতিয়া রুটে চলাচলকারী এমভি তাসরিফ-১ এর কর্মচারী মোঃ নাসির হোসেনের বাড়ি পটুয়াখালি৷ কিন্তু তিনি নিজেই পদ্মাসেতু দিয়ে বাসে করে এবার বাড়ি যাবেন৷ দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মাসেতু হওয়ায় তিনি খুশি৷ আবার নিজের পেশায় এর নেতিবাচক প্রভাবও টের পাচ্ছেন৷ এবার ঈদে বোনাস পাবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘‘এইবার বোনাস চাইলে মালিক নিশ্চিত মাইর দিবে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তবুও লঞ্চেই যাচ্ছেন জুনায়েদ
ঈদ করতে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে সপরিবারে হাতিয়ায় গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন জুনায়েদ হোসেন৷ পদ্মা সেতু দিয়ে না গিয়ে কেন লঞ্চে যাচ্ছেন জানতে চাইলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী জুনায়েদ জানান, বাসে যাওয়ার চেয়ে পরিবার নিয়ে লঞ্চে যাওয়াই তার জন্য সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘দুইটা টাকা কামাই করে সংসার চালানো কি অন্যায়?’
ঢাকার কারওয়ান বাজার মোড়ে কথা হয় রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের একজন মোটরবাইক চালকের সাথে৷ শুরুতে পদ্মা সেতুতে, পরে ঈদ উপলক্ষে মহাসড়কে মোটরবাইক নিষিদ্ধে ক্ষুব্ধ তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘কিছু হইলেই আমাদের উপর বিধিনিষেধ আসে৷ লকডাউনে সব চলছে, রাইড শেয়ারিং বন্ধ, ট্রাফিক পুলিশ কথায় কথায় জরিমানা করে, এখন আবার মহাসড়কে আমাদের চলাচল নিষেধ৷ আমাদের উপর কেন সব ঝড় আসে? দুইটা টাকা কামাই করে সংসার চালানো কি অন্যায়?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘এবার ঈদে আয় নাই’
মো. আবুল বাশার ঢাকার গুলিস্তানের ফুটপাথে দর্জির কাজ করে পরিবার চালান৷ ঈদ এলে তার কাজ বাড়ে, আয়ও বাড়ে৷ কিন্তু এবার খুশি নন তিনি৷ বাশার বলেন, ‘‘গত বছর লকডাউন থাকলেও সাত দিনে যা আয় করেছি এবার ঈদ চলে আসলেও সেই তুলনায় তেমন আয়ই হয়নি৷ তেলের দাম বৃদ্ধি আর প্রতিদিনের খরচ দুইগুণ বেড়েছে৷ খরচ মেটানোর পর হাতে আর কোনো টাকা থাকে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
খুশি নন বাসচালক শরীফ
গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জ রুটের শীতল পরিবহণের চালক মো. শরীফ বলেন, ‘‘দেশে সেতু, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন হচ্ছে৷ এতে আমরা খুশি৷ কিন্তু রাস্তা-ঘাটে যানজট বেড়েই চলেছে৷ গত কোরবানির ঈদে লকডাউন থাকায় রাস্তায় গাড়ি কম ছিল, ট্রিপ বেশি মারতে পারায় বেতনও ছিল বেশি৷’’ রাস্তায় তীব্র জ্যামে এই ঈদে গতবারের তুলনায় আয় অর্ধেকও হবে না বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদের দিন বাড়ি যাবেন জব্বার
ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে কুলির কাজ করেন মো. জব্বার৷ ঈদ নিয়ে তার বাড়তি কোনো ভাবনা নেই৷ কোরবানি দেয়ার সামর্থ্যও নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘গরিব মানুষের ঈদ নাই৷ ঈদ হলো ধনী মানুষের জন্য৷‘’ তার মতে, দেশে প্রতিবছর বড়লোক আরো বড়লোক হচ্ছে, গরিব আরো গরিব হচ্ছে৷ ‘‘ঢাকায় যে কয়টা প্রাইভেট গাড়ি আছে, সে কয়জনই শুধু টাকাওয়ালা, বাকিদের অবস্থা খারাপ,’’ বলেন জব্বার৷ ঈদের দিন পর্যন্ত কাজ করে লঞ্চে বাড়ি ফিরবেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আয় না বাড়লেও খরচ বাড়ছে ম্যালা’
তৈয়ব মিয়া ঢাকার রাস্তায় ফেরি করে শুকনো খাবার বিক্রি করেন৷ করোনাকালীন সময়ের চেয়ে তার আয় বেড়েছে৷ কিন্তু তার চেয়েও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খরচ৷ তৈয়ব মিয়া বলেন, ‘‘করোনার সময় রাস্তাঘাটে মানুষ কম থাকায় আমাগো ইনকাম কম আছিল৷ কিন্তু এমনিতে আমগো ইনকাম প্রায় একই৷ তয় এই কথা ঠিক যে এহন মানুষের আয় না বাড়লেও খরচ বাড়ছে ম্যালা৷’’ ঈদের আগের দিন পিরোজপুরে গ্রামের বাড়ি যাবেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ঈদ আগের মতো নেই’
ঢাকার মিরপুর ১০ সার্কেলের একটি পোশাক তৈরির কারখানার কর্মী সালেহা আক্তার৷ প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি দুই বছর যাবত কাজ করেন৷ এই মাসে তার বেতন বেড়েছে এক হাজার টাকা৷ কিন্তু সার্বিক খরচ বেড়েছে ৩০-৪০ ভাগ পর্যন্ত৷ তাই বেতন কিছুটা বাড়লেও তিনি পুরোপুরি খুশি হতে পারছেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘আগের বেতন দিয়ে যেভাবে ঈদ পালন করতাম এখন বেতন বাড়ার পরেও তা সম্ভব হয় না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ঈদ নিয়ে বাড়তি পরিকল্পনা নেই’
ঢাকার পল্টনের ফুটপাথের হোটেল ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়তি হইলেও সাধারণ মানুষের কথা ভাইবা হোটেলের খাবারের দাম বাড়াই নাই৷ কিন্তু তা-ও কাস্টমার আগের মতন নাই৷ মানুষ দুপুরে ভাতের জায়গায় চা-রুটি খায়, যে ১০-২০ টাকা বাঁচে, সেইটাই এখন অনেক টাকা৷’’ তিনি বলেন, গত বছরের ধার-দেনায় এখনও আটকে আছেন, তাই ঈদে বাড়তি কিছু করার পরিকল্পনা তার নেই৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদে নতুন জামা
ঈদ উপলক্ষে ফুটপাথ থেকে নতুন জামা কিনছেন মো. আল আমিন৷ নরসিংদী থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছেন দশম শ্রেণির এই ছাত্র৷ কেনাকাটা সেরে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাবে সে৷ অন্যবার শপিং মল থেকে জামা-কাপড় কিনলেও এবার জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফুটপাথেই কেনাকাটা সারছেন বলে জানান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদ কাটবে সড়কে
ঢাকার গুলিস্তান মোড়ে কথা হয় এই ট্রাফিক পুলিশের সাথে৷ ১৫ বছরের চাকরিজীবনে হাতেগোনা কয়েকটি ঈদ তিনি বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছেন৷ এবারও তাকে ঈদের দিন রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে হবে৷ নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, ‘‘আমরা সরকারি চাকরি করি, কিছু বলতে পারি না৷ বেতন যা পাই, বউ-বাচ্চা গ্রামে রেখে পালতেও কষ্ট হয়া যায়৷ তা-ও তো আমরা নিয়মিত বেতন পাই, সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ কিভাবে চলে আল্লাহই ভালো জানেন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আমরাই সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত’
একটি সরকারি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু নাসের৷ ঈদ আসলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে হতাশ তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘খুব সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম আমরা ১২২টি দেশের মধ্যে হতাশা ও দুঃখে সপ্তম অবস্থানে আছি, প্রথমে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান৷ আমার মতে, বাংদেশের যে সার্বিক পরিস্থিতি, আফগানিস্তান নয়, আমাদেরই তালিকায় এক নাম্বারে থাকা উচিত৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
14 ছবি1 | 14
স্পিডলিমিট বলে যে একটা ব্যাপার আছে, সেটা সম্ভবত এসব চালকের অনেকই জানেন না৷ এমনকি ভোরের দিকে বা কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশেও অনেক সময় বাস বা ট্রাক চালকরা হেডলাইট ব্যবহার করেন না৷ ফলে কখনো কখনো দেখা যায় খুব কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত সেসব বাহনের উপস্থিতিই টের পাওয়া যায় না৷
ফলে মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সেটির চালক বা আরোহীর ভূমিকা কতটা আর এসব বেপরোয়া বাস, ট্রাকের চালকদের দায় কতটুকু সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে৷ পরিসংখ্যানে এই দিকটা ঠিক পরিষ্কার হয়নি৷ মোটরসাইকেল চালকদের জন্য দুর্ঘটনা কতটা ঘটছে, আর তারা কতটা অন্যের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন সেটা বোঝা জরুরি মনে হয় আমার কাছে৷
চালকদের এই যে প্রশিক্ষণে ঘাটতি, সচেতনতার অভাব - সেটা মেটানো মোটরসাইকেলের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে মনে হয়৷ এক্ষেত্রে জার্মানির অভিজ্ঞতা জানাতে পারি৷
ইউরোপের এই দেশটিতে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়ারক্ষেত্রে কয়েকটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতেই হবে৷ প্রথমে ফার্স্ট এইড কোর্স করতে হবে, তারপর তাত্ত্বিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে আর সবশেষে বেশ কয়েক ঘণ্টা একজন প্রশিক্ষকের সঙ্গে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা অর্জনের পর ব্যবহারিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে মেলে লাইসেন্স৷ সেই লাইসেন্স আবার গাড়ি ভেদে ভিন্ন হয়৷ অর্থাৎ মোটর সাইকেল চালানোর লাইসেন্স আলাদা, প্রাইভেট কার চালানোর লাইসেন্স আলাদা আর বাস-ট্রাক চালানোরটাতো আলাদাই৷
জার্মানির মহাসড়কে, সেতুতে, টানেলে মোটরসাইকেল চালাতে কোনো বাধা নেই৷ এমনকি যে রাস্তায় কোনো স্পিডলিমিট নেই সেখানেও দিব্যি চলে মোটরসাইকেল৷ তবে চালকদের অবশ্যই কিছু নিয়ম মানতে হয়৷ যেমন অবশ্যই হেলমেট ও বিশেষ একধরনের পোশাক পরা যা দুর্ঘটনার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক৷
এত নিরাপত্তার পরও দুর্ঘটনা যে হয়না, তা নয়৷ জার্মানিতেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে৷ এবং তাতে প্রাণহানিও ঘটে৷ তবে দুর্ঘটনা রোধে এবং এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে সরকারের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকে৷ উপযুক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লাইসেন্স দেয়ার পাশাপাশি গাড়ির ফিটনেস নিয়মিত যাচাই ও ট্রাফিক আইন মানার বিষয়টি নিশ্চিত করে দুর্ঘটনার হার অনেক কম রাখা সম্ভব হচ্ছে৷
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে৷ সরকারি হিসেবে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা চার লাখের মতো৷ আমার মনে হয়, প্রকৃত মোটরসাইকেলের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে৷ দেশের রাস্তাঘাটে একটু চোখ দিলেই সাংবাদিক, সরকারি কর্মী, পুলিশ কিংবা রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থক পরিচয় দেয়া অনেককে নম্বর প্লেটের উপর নম্বর ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেল চালাতে দেখা যায়৷ সেগুলো অনেকেই দেখেন, কিন্তু কিছু বলেন বলে মনে হয় না৷
মোটরসাইকেলের এই যে সামগ্রিক বিকাশ, সেটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির একটি ইঙ্গিতও৷ পাশাপাশি সরকারের নীতির কারণেও দুই চাকার এই বাহন কেনা সহজ হয়েছে অনেকেরপক্ষে৷ আর হাজার হাজার বেকার তরুণ-যুবকের আয়ের এক উৎসও হয়ে উঠেছে মোটরসাইকেলকেন্দ্রিক রাইডশেয়ারিং ও বিভিন্ন পণ্য ডেলিভারি৷
তাই, সামগ্রিক বিচারে মোটরসাইকেলের উপর এককভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেয়ে আমার কাছে মনে হয় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লাইসেন্স প্রদান থেকে শুরু করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, সড়ক, মহাসড়ক মোটরসাইকেল ও গাড়িবান্ধব করে তোলা ও ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগের দিকে আরো বেশি নজর দেয়া উচিত৷ দীর্ঘমেয়াদে উদ্যোগ নিয়ে এসবক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে৷
আর সাধারণ মানুষকে গণপরিবহণ ব্যবহারে আরো উৎসাহিত করতে পারলে মোটরসাইকেলের ব্যবহার কমতে পারে৷ কিন্তু সেক্ষেত্রেও ঘাটতি স্পষ্ট৷ বড় কোনো উপলক্ষ তৈরি হলেই ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় না, বাসের সিডিউল ঠিক থাকে না, আর বাড়তি ভিড়ের মধ্যে স্ত্রীসন্তানসহ গণপরিবহনে যাত্রা করা অনেকের পক্ষে কঠিনই৷ সঙ্গে যানজটের বিড়ম্বনাতো রয়েছেই৷
এই জটিলতা থেকে দূরে থেকে একটু চলাচলের স্বাধীনতা পেতে হয়ত মোটরসাইকেল চালকরা লম্বা পথেও নিজের বাহনটি নিয়ে যেতে চান৷ তাদের সেই স্বাধীনতাটুকু বজায় রাখা যায় কীভাবে সেদিকেই মনোযোগ দেয়া হোক৷