২০১৮ সালের মে মাস৷ আচমকাই কলকাতায় মাংস শব্দটিই প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছিল মধ্যবিত্তের হেঁসেলে৷ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল ‘ভাগাড়' শব্দটি ঘিরে৷ ফাঁস হয়েছিল এক ভয়াবহ সত্য৷ কলকাতার একাধিক দোকানে বিক্রি হচ্ছে ভাগাড়ের মাংস৷
রাস্তাঘাটে মরে পড়ে থাকা পশু ধাপার আবর্জনা স্তূপে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে তাদের জ্বালিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে৷ অভিযোগ উঠেছিল, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সেখান থেকে মরা পশু নিয়ে এসে বাজারে বিক্রি করছে৷ এবং বাজারের দামের চেয়ে অনেক কম দামে সেই মাংস বিক্রি করা হচ্ছে৷ তদন্তে নেমে প্রশাসন দেখেছিল, ভাগাড়ের সেই পচা মাংস কলকাতার বিভিন্ন রেস্তোরাঁ এবং পথের ধারের ছোট ছোট জয়েন্ট কিনছে এবং সস্তায় সেই মাংস রান্না করে বিক্রি করা হচ্ছে৷
বেশ কিছু এমন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ৷ কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও হয়৷ কলকাতা পুরসভা এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার মানুষকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছিল, বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে৷ কিন্তু তাতেও আতঙ্ক পুরোপুরি কাটতে সময় লেগেছে৷
২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় ভিন রাজ্য থেকে আসা এক সহকর্মী কলকাতায় পা রেখেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘মাংস খাওয়া যাবে তো? এখনো ভাগাড়ের মাংস বিক্রি হচ্ছে না তো?''
ঐতিহাসিক সময় থেকে শহর কলকাতা বাহারি খাবারের জন্য সুপ্রসিদ্ধ৷ মিষ্টি হোক বা বিরিয়ানি, মোগলাই হোক বা চাইনিজ-- কলকাতার বিভিন্ন মহল্লায় আলাদা আলাদা রকমের খাবার পাওয়া যায়৷ কলকাতার প্রায় প্রতিটি গলি পরিচিত তার স্ট্রিট ফুডের জন্য৷ এত রকমের স্ট্রিট ফুড ভারতের আর কোথাও পাওয়া যায় না৷
দিল্লির একটি পরিচিত অসুখের নাম দিল্লি বেইলি৷ অর্থাৎ, বাইরে থেকে দিল্লিতে এসে রাস্তার খাবার খেয়ে পেট খারাপ হবেই৷ যে পেট খারাপের পোশাকি নাম দিল্লি বেইলি৷ উদরপূর্তির কলকাতা একসময় তার খাবারের কোয়ালিটির জন্যও বিখ্যাত ছিল৷ যতই তেল-মশলার খাবার হোক, পেট খারাপ হবে না, এমন গ্যারান্টি দিত কোনো কোনো রেস্তোরাঁ৷ কিন্তু সে দিন গেছে৷ দিল্লির মতোই কলকাতা বেইলি এখন সাধারণ এবং স্বাভাবিক ঘটনা৷ এর মূল কারণ, পুরসভা খাতায় কলমে বাজারে, রেস্তোরাঁয় অভিযান চালালেও সত্যি সত্যি খাবারের কোয়ালিটি নিয়ে কেউই এখন তেমন মাথা ঘামায় না৷
খাসির মাংস যখন ৭৫০ টাকা প্রতি কিলো, ঘিয়ের দাম যখন প্রতি কেজি হাজার টাকার কাছাকাছি, বাসমতি চাল ১৫০ টাকা, তখন ১০০ টাকায় কীভাবে বিরিয়ানি বিক্রি হচ্ছে, এ প্রশ্ন তোলেন অনেকেই, কিন্তু ভিজিলেন্সের বেলায় লবডঙ্কা৷ নিন্দুকেরা বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে টাকা গুঁজে দিলেই সাত খুন মাফ৷ দোকানদারেরাও মানেন একথা৷ আর পুরসভা এবিষয়ে মন্তব্য এড়িয়ে যায়৷ হঠাৎ হঠাৎ ভাগাড়ের মাংসের মতো ব্রেকিং নিউজ যখন সমাজে ঝড় তোলে, পুরসভাও তখন কিছুদিনের জন্য নড়েচড়ে বসে৷
একটা কলকাতার মধ্যে আসলে অনেকগুলো কলকাতা লুকিয়ে আছে৷ ঝাঁ চকচকে পার্কস্ট্রিটে অর্গানিক মুদিখানার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর তৈরি হয়েছে৷ বড় বড় শিল্প সংস্থা শহরজুড়ে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের চেন খুলেছে৷ সেখানে লেবেল লাগিয়ে অর্গানিক জিনিস বিক্রি হয়৷ প্রোডাক্টের গায়ে সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য লেখা থাকে৷ বিক্রি হয় ঝাঁ চকচকে ফল, শাকসব্জি৷ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেন, ঝাঁ চকচকে করতে গিয়ে ওই সব সবজিপাতি এবং ফলমূলে যে ধরনের কেমিক্যাল লাগানো হয়, তা স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর৷ আবার সেই দোকানেই শাক-সবজি ধোয়ার জন্য এক ধরনের সাবান বিক্রি হচ্ছে আজকাল৷ সেই সাবান ব্যবহার করলে তরকারিতে ব্যবহৃত কেমিক্যাল হয়তো ধুয়ে যাবে, কিন্তু তার খাদ্যগুণ থাকবে তো? বিতর্ক চলতেই থাকে৷
আর এই মলশোভিত কলকাতার বাইরে যে আরেকটা কলকাতা আছে, সেখানে এখনো খুচরো তেল, খুচরো চাল, খুচরো ডাল বিক্রি হয়৷ সস্তা থেকে অতি সস্তার সেই খাবার কেমন, তার আঁচ পাওয়া যায় স্কুলে স্কুলে মিড ডে মিল নিয়ে ওঠা অভিযোগ অথবা জেলের খাবার সংক্রান্ত একাধিক অভিযোগ থেকে৷
ভারতের জেল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন গবেষক স্মিতা চক্রবর্তী৷ কিছুদিন আগেই তিনি বলছিলেন, জেলের খাবারের মান এতটাই খারাপ যে কহতব্য নয়৷ স্কুলের শিশুদের যে মিড ডে মিল দেয়া হয়, তা নিয়েও বহু সময় এমনই অভিযোগ উঠেছে৷
এই অভিযোগগুলি যে শুধুমাত্র কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গেই ওঠে, এমন নয়৷ গোটা দেশেই কমবেশি এধরনের অভিযোগ আছে৷ ফেরা যাক দিল্লির প্রসঙ্গেই৷ পুরনো দিল্লির যে অঞ্চল মোগলাই খানার জন্য বিখ্যাত, সেখানে হাইজিন কতটা দেখা হয়, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন আছে৷ দিল্লি বেইলির ভয়ে অনেকেই ইদানীং ওই সব লোভনীয় খাবার খেতে চান না৷ আবার উল্টো দিকটিও আছে৷ পুরনো দিল্লির গলির খাবার এখনো পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ৷ ঠিক যেমন কলকাতার রোল, ফুচকা পর্যটকদের জন্য মাস্ট৷ কোয়ালিটি নিয়ে তখন কেউ আর প্রশ্ন তোলেন না৷ ব্যবাসায়ীরাও মনের সুখে ভেজাল দিয়ে উদর-উৎসবের বিজ্ঞাপন চালিয়ে যান৷ সরকার কড়া হাতে হস্তক্ষেপ না করলে এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন৷
কেউ কেউ অবশ্য ইদানীং বলেন, ভেজাল এবং কার্বাইডে আম-ভারতীয়ের পেট এতটাই অভ্য়স্ত হয়ে গেছে যে খাঁটি খাবার শরীরে গোলমাল বাধাতে পারে৷