মাইতী নেপাল এবং অনুরাধা কৈরালা
১৯ জুন ২০১১সিএনএন প্রতিবছর বিশেষ একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে৷ নাম সিএনএন হিরোজ এ্যাওয়ার্ড৷ এই পুরস্কারে কখনো সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, স্কুল শিক্ষক বা ব্যবসায়ীদের দেখা যায়৷ স্ব স্ব ক্ষেত্রে এরা রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর৷ মাইতী নেপালের প্রতিষ্ঠাতা অনুরাধা কৈরালা এর ব্যতিক্রম নন৷
মাইতী নেপাল একটি সংগ্রাম, একটি কণ্ঠ৷ যে কণ্ঠ নিপীড়িত, নির্যাতিত মেয়েদের কথা বলে৷ গৃহ নির্যাতন থেকে শুরু করে নারী ও শিশু পাচারের মত অপরাধকে রুখতে কাজ করছে মাইতী নেপাল৷ ১৯৯৩ সালে বেশ কিছু শিক্ষক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী এগিয়ে আসেন সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার জন্য৷ সক্ষম হয়েছেন এবং সাহায্য করছেন অসহায় মেয়েদের৷ এ পর্যন্ত প্রায় বারো হাজার মেয়েকে পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে মাইতী নেপাল৷ জোর করে এসব মেয়েদের পতিতা করা হয়েছিল৷ শিশুদের নিয়োগ করা হয়েছিল বিভিন্ন কাজে৷ এসব থামাতে চেয়েছেন অনুরাধা কৈরালা৷ এ ধরণের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রেরণা উৎসাহ কীভাবে পেলেন?
অনুরাধা কৈরালা বললেন, ‘‘আসলে ১৯৯০ সালের আরো আগে থেকেই নেপালে মেয়েদের পাচার করা হত৷ শুরু হয়েছে ১৯২৬ সাল থেকে৷ কেউই কখনো এর প্রতিবাদ করেনি, এসব মেয়েদের সাহায্য করতেও কেউ এগিয়ে আসেনি৷ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর অনেকেই এ নিয়ে কথা বলা শুরু করে, প্রশ্ন করা শুরু করে৷ তখন বেশ কিছু সংস্থাও এগিয়ে আসে পাচার বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়ে৷ তবে মূল সমস্যা ছিল গ্রামগুলোতে৷ তখন আমরা কাজ শুরু করি গ্রামে৷ গ্রামের মানুষদের মানবাধিকার, নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার নিয়ে কথা বলি৷ অথচ রাজধানী কাটমান্ডুতেই এসব অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে৷ এরপরই আমি প্রতিষ্ঠা করি ‘মাইতী নেপাল'৷''
খুব ছোট আকারে শুরু হলেও এখন অনেক বড় একটি সংস্থা মাইতী নেপাল৷ কিন্তু তারপরও সরকারের কাছ থেকে কোন ধরণের সাহায্য সহযোগিতা ‘মাইতী নেপাল' পাচ্ছে না৷ ক্ষোভ দেখিয়ে অনুরাধা কৈরালা বললেন, ‘‘আর্থিকভাবে কোন সাহায্য আমরা সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছি না৷ তবে পুলিশ বাহিনী আমাদের সাহায্য করছে এবং আইনগত দিক থেকেও বিভিন্ন ধরণের সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি৷''
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ইউরোপ
তবে দেশে বিদেশে ‘মাইতী নেপাল'-এর কথা সবাই জানে৷ যে ধরণের কাজ সংস্থাটি করছে তাতে সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷ তাই সরকারের কাছ থেকে কোন ধরণের সাহায্য না পেলেও ‘মাইতী নেপাল' নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছে৷ বিভিন্ন সাহায্য এবং সহযোগিতা প্রসঙ্গে অনুরাধা কৈরালা বললেন, ‘‘আমি যখন প্রথম প্রতিষ্ঠানটি চালু করি তখন আমি আমার নিজের টাকা এর পেছনে খরচ করেছি৷ এরপর ব্রিটেনের প্রিন্স চালর্স প্রতিষ্ঠানটিকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন৷ সেই অর্থ দিয়ে আমরা কিছু জমি কিনি৷ প্রতিষ্ঠানটিকে বাড়াই৷ এছাড়া জার্মানির সোনিয়া কিল ফাউন্ডেশন আমাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে৷ এই যে এত বিশাল ভবনে আমরা কাজ করছি তা এই ফাউন্ডেশনই গড়ে দিয়েছে৷ সংস্থাটি এখনও আমাদের সাহায্য করছে৷ এছাড়া বোনো-ডিরেক্টহিল্ফেও আমাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করছে৷ আমরা সাহায্য পাচ্ছি কার্ল-মার্ক্স ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকেও৷''
এ বছর অনুরাধা কৈরালা সিএনএনের হিরোজ এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন৷ পুরস্কার হাতে তুলে দিয়েছেন হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ডেমি মুর৷ পুরস্কার দেয়ার আগে ‘মাইতী নেপাল'-এর একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি দেখানো হয়৷ এরপরই অনুরাধা কৈরালাকে ডাকা হয় স্টেজে পুরস্কার নেয়ার জন্য৷ উপস্থিত দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেছেন অনুরাধা কৈরালাকে৷ কেমন ছিল পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি? অনুরাধা কৈরালা উচ্ছাস, ‘‘আমি যখন এই পুরস্কার পাই তখন আমি অ্যামেরিকাতেই ছিলাম৷ প্রথমেই আমার মনে হয়েছে যে সব মেয়েকে আমি সাহায্য করেছি, আমার সেই মেয়েগুলো কেন কাছে নেই? এটাতো ওদেরও পুরস্কার৷ আমার মনে হয়েছে এই সময়ে আমার উচিত ছিল ওদের কাছে থাকার৷ তবে আরেকটি দিক হল আমি যে কাজ করছি, যে সমস্যা তুলে ধরেছি তা বিশ্ববাসী জানছে, দেখছে৷ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আজ এক স্বরে বলবে, ‘‘হ্যাঁ নারী-পাচার তীব্র একটি সমস্যা৷'' আমি আশা করছি এখন সারা বিশ্ব আমাকে সাহায্য করবে, সহযোগিতা করবে৷ হয়তো একদিন আমরা এমন একটি পৃথিবী পাবো, সমাজ পাবো যেখানে মানুষকে আর পাচার করা হবে না৷''
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন