ভারতে এবারের নির্বাচনের সবথেকে আশাব্যঞ্জক দিক হলো, মাওবাদী এলাকাগুলিতে ভোটের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে৷ তাতে এটাই সূচিত হচ্ছে মাওবাদীদের বজ্রমুষ্টি ক্রমশই ঢিলে হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের সাতটি রাজ্য ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িষা এবং পশ্চিমবঙ্গ মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি৷ প্রতিবার নির্বাচনের আগে মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকে আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠী সাড়া দিতে বাধ্য হত ভয়ে এবং আতঙ্কে৷ কিন্তু ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভোটদানের অষ্টম পর্বে ৫০২টি আসনের ভোটের পর দেখা গেছে মাওবাদী জঙ্গিদের রক্তচক্ষু এবং ভোট বয়কটের ডাক অগ্রাহ্য করে ৬২ শতাংশ ভোট পড়েছে ঐসব অঞ্চলে৷ গত ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে এই হার ছিল ৪৭ শতাংশের মত৷
মাওবাদী গেরিলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্র বলে পরিচিত মহারাষ্ট্রের গডচিরোলী এবং দন্ডকারণ্য স্পেশাল জোন কমিটি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ভোট পড়ে ৬৯ শতাংশের মত৷ ২০০৯ সালের নির্বাচনে এই হার ছিল বেশ কম৷ উল্লেখ্য, দন্ডকারণ্য ঘন জঙ্গল ঘেরা এক দুর্গম ভূখন্ড৷ ছত্তিশগড়, ওড়িষা, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশ এই চারটি রাজ্য জুড়ে এই ভূখন্ড বিস্তৃত৷
অনুরূপভাবে বিহারের জামুই ও মুঙ্গের সংসদীয় আসনগুলিতে ভোটের হার বেড়েছে ১০ শতাংশ৷ ওড়িষার মালকানগিরিতে অবশ্য এই হার কিছুটা কম৷
ছত্তিশগড়ের বস্তার অঞ্চল মাওবাদীদের দুর্ভেদ্য গড়৷ গত ১০ এপ্রিল সেখানকার আদিবাসীদের মধ্যে ভোট দেবার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে মাওবাদীদের৷ এর কারণ খুঁজতে আদিবাসী এবং উপজাতি প্রতিনিধিদের ডেকে বিভিন্ন জায়গায় গোপন মিটিং করেছে মাওবাদীরা৷
পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী অধ্যুষিত পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে ৭ মে পর্যন্ত চতুর্থ দফার ভোট পর্বে ভোটের হার ছিল যথাক্রমে ৮১.৪১, ৭৮.৭৫ ও ৮০.৫৫ শতাংশ৷ আর ঝাড়গ্রামের মাওবাদী এলাকায় ভোট পড়ে ৮৮ শতাংশের মত৷
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আপাত কারণ হলো, আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠী এতদিন সুদিনের আশায় মাওবাদীর ওপর আস্থা রেখেছিল৷ কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে হিংসা, রক্তপাত এবং আতঙ্কের আবহে থাকতে থাকতে তাঁরা ক্লান্ত ও হতাশ৷ এর পরিবর্তনে তাঁরা মরিয়া৷ উন্নয়নের জন্য, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য দিন বদলের আশায় তাঁরা চাতক পাখির মত তৃষ্ণার্ত৷
ভারতের নির্বাচন ২০১৪
ভারতে একমাসেরও বেশি সময় ধরে নয় দফায় ভোটগ্রহণ হবে৷ ৭ এপ্রিল থেকে ১২ মে পর্যন্ত চলবে ভোট গ্রহণ৷ ভোট গণনা হবে ১৬ মে৷ ৮০ কোটি ভোটার এই নির্বাচনে অংশ নেবেন৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
জনগণের সরকার
ভারতের সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর৷ পার্লামেন্টে দুটি কক্ষ রয়েছে৷ উচ্চকক্ষকে বলা হয় রাজ্যসভা আর নিম্নকক্ষ লোকসভা হিসেবে পরিচিত৷ নিম্নকক্ষে যে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তারাই দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করে৷
ছবি: AP
দৌড়ে এগিয়ে
সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে৷ তবে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পথটা নতুনভাবে বিবেচনা করতে হবে৷ কেননা ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গার কারণে যুক্তরাষ্ট্র নরেন্দ্র মোদীকে বয়কট করেছে৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেস নেতা
দীর্ঘ সময় ধরে কংগ্রেসের হাল ধরা সোনিয়া গান্ধী এবার দলের দায়িত্বের বোঝা তুলে দিয়েছেন নিজ পুত্র রাহুল গান্ধীর কাঁধে৷ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রপৌত্র, প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী পৌত্র এবং সবচেয়ে কমবয়সি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে রাহুল৷ কিন্তু গত ১০ বছর ধরে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থেকেও সেখানে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুর্নীতি বিরোধী নেতা
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির রাজ্যসভা নির্বাচনে অভিষেক হয় দুর্নীতি বিরোধী দল আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালের৷ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘কিং মেকার’ দল
বামপন্থি চারটি দল এবং সাতটি আঞ্চলিক দল মিলে থার্ড ফ্রন্ট গঠন করেছে, যা বিজেপি এবং কংগ্রেসের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ৷ লোকসভায় এখনই তাদের আধিপত্য আছে৷ ঝুলন্ত পার্লামেন্টের সম্ভাবনা থাকলে তারা হয়ে উঠতে পারে ‘কিং মেকার’৷ অর্থাৎ তারা যে দল সমর্থন করবে তারাই গঠন করবে সরকার৷
ছবি: Sajjad HussainAFP/Getty Images
সামাজিক গণমাধ্যমের ভূমিকা
এ বছর নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে৷ এটিকে নির্বাচনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে কোনো দলই পিছিয়ে নেই৷ এ বছর প্রথম ভোট দেবেন এমন মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি৷ এদের মধ্যে ৪০ ভাগ শহরে বাস করে, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সক্রিয়৷ ফলে নতুন এই প্রজন্ম এবারের নির্বাচনে একটা বড় ভূমিকা রাখছে৷
মেশিনের মাধ্যমে ভোট
লোকসভার ৫৪৫ টি আসনের প্রতিনিধি নির্বাচনে ভারতের মানুষ ভোট দেবেন ৫ সপ্তাহ ধরে৷ ইলেকট্রনিক মেশিন পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ চলবে৷ ফলাফল জানা যাবে ১৬ মে৷
ছবি: AP
সংখ্যালঘুদের উপর নির্ভরশীলতা
ভারতে ১৩ শতাংশ ভোটদাতা মুসলিম৷ ১০০টি সংসদীয় কেন্দ্রে ১৫-২০ শতাংশ, ৩৫টি কেন্দ্রে ৩০ শতাংশ এবং ৩৮টি আসনে মুসলিম ভোটদাতাদের সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো৷ কাজেই আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম ভোটবাক্স নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করছেন ভোট বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘নমো’ উন্মাদনা
যখন থেকে বিজেপি নরেন্দ্র মোদীকে (নমো) তাদের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়; তখন থেকেই সে দেশের গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ব্র্যান্ড হিসেবে ‘নমোকে’ তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়৷ বিজেপির প্রচার-কুশীলবদের রি-ব্র্যান্ডিং অভিযানের তোড়ে নৈতিকতার প্রশ্নগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে৷
প্রান্তিক আদিবাসী গ্রামগুলির জওয়ান ছেলেদের টাকা আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে ক্যাডার বানিয়েছে মাওবাদী নেতারা৷ তোলা আদায় করেছে গরিব মানুষদের কাছে৷ দিতে না পারলে উনুন জ্বালানো বন্ধ আর অরন্ধনের আদেশ দিয়েছে৷ পুলিশের চর সন্দেহে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে গেছে লাশ৷ জ্বালিয়ে দিয়েছে আদিবাসীদের ঘর আর সরকারি প্রাথমিক স্কুল৷ নিরাপত্তা বাহিনীকে আটকাতে রাস্তাঘাট কেটে মাইন পুঁতে রাখে৷ আধা সামরিক বাহিনীর হাতে মাওবাদীদের শীর্ষ নেতারা নিহত বা ধরা পড়ার পর তাঁরা এখন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে৷ নিরাপত্তাবোধ কিছুটা ফিরে এসেছে৷ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছে৷ দু টাকা কিলো দরে নিয়মিত চাল পাচ্ছে৷ ঘর তোলার জন্য সাহায্য পাচ্ছে৷ তাই ভোটে তাঁদের উৎসাহ বেড়েছে৷ এটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন সরকারের উচিত নিরাপত্তার পাশাপাশি সর্বাত্মক উন্নয়নে গতি আনা৷