ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁর বিতর্কিত বিল মন্ত্রিসভায় পাস হলো। সামনে এলো সেই বিলের বিতর্কিত ধারাগুলিও।
বিজ্ঞাপন
মাক্রোঁ বলছেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রুখতে বিল আনা হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী, রাজনীতিবিদরা বলছেন, কট্টরপন্থী মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য নিয়েই বিল আনা হয়েছে। শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে হত্যা ও কার্টুন বিতর্কের পর এই আইন এনেছেন মাক্রোঁ। মন্ত্রিসভায় বিল অনুমোদিত হয়েছে। এ বার পার্লামেন্টে বিতর্ক হবে। তার আগে বিলে কী আছে, তার অনেকটাই সামনে এসেছে।
বিলে বলা হয়েছে, তিন বছর বয়স হলেই বাচ্চাকে বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলে যেতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রেই তাঁকে বাড়িতে পড়াশুনোর অনুমোদন দেয়া হবে। বলা হচ্ছে, কট্টরপন্থীদের পরিচালিত গোপন স্কুলে বাচ্চাদের যাওয়া বন্ধ করতে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গোপন স্কুলগুলিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে বিলে।
বিলে বলা হয়েছে, সব মসজিদকে ধর্মস্থান হিসাবে নথিভুক্ত করতে বলা হবে। এখন মসজিদগুলি রুলস ফর অ্যাসোসিয়েশন-এর অধীনে আছে। ১০ হাজার ইউরোর বেশি বিদেশি সাহায্য পেলে মসজিদগুলিকে তা জানাতে হবে।
মুসলিম বিশ্বে মাক্রোঁর সমালোচনা এবং জবাব
চরমপন্থিদের হামলায় নিহত শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে মরনোত্তর লিজিয়ন অফ অনার দিয়ে তাকে পূর্ণ সমর্থন জানানোর পর থেকে মুসলিম বিশ্বে তোপের মুখে পড়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Reuters/E. Gaillard
মাক্রোঁ যা বলেছিলেন
গত ২১ অক্টোবর প্যাটিকে মরনোত্তর লিজিয়ন অফ অনারে ভূষিত করে প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁ বলেন, ''আমরা কার্টুন ছাড়বো না৷ ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে রক্ষা করতে গিয়ে প্যাটি জীবন দিয়েছেন । তিনি এই প্রজাতন্ত্রের মুখ।''
ছবি: Francois Mori/Pool/Reuters
এর্দোয়ানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
মাক্রোঁর বক্তব্য শুনে তাকে মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়ে এক সভায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এর্দোয়ান বলেন,‘‘মাক্রোঁ নামের এই ব্যক্তির ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে সমস্যা কী? একজন রাষ্ট্রনেতা যদি বিশ্বাসের স্বাধীনতা না বোঝেন এবং তার দেশে বসবাসরত কয়েক মিলিয়ন ভিন্ন বিশ্বাসের অনুসারীদের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, তাহলে তাকে আর কী বলা যায়!’’
ছবি: Sercan Kucuksahin/AA/picture-alliance
মাক্রোঁর সমালোচনায় ইমরান খান
টুইটারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান লিখেছেন, ‘‘একজন নেতার প্রধান গুণ হলো, তিনি সব মানুষকে বিভক্ত না করে ম্যান্ডেলার মতো ঐক্যবদ্ধ করেন৷এটি এমন এক সময় যখন প্রেসিডেন্ট মাঁক্রো নিরাময়ের ব্যবস্থা নিতে পারতেন এবং চরমপন্থাকে আর ছাড় দিতে অস্বীকার করতে পারতেন, অথচ তিনি আরো মেরুকরণ এবং প্রান্তিকীকরণের পথ ধরলেন যা অনিবার্যভাবেই মৌলবাদের দিকে নিয়ে যায়৷’’
মাক্রোঁর জবাব
তার সমালোচনার জবাবে টুইটারে এমানুয়েল মাক্রোঁ লিখেছেন, ‘‘আমরা কখনো হাল ছাড়বো না৷ আমরা শান্তির চেতনায় সব পার্থক্যকে সম্মান করি৷ আমরা ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য গ্রহণ করি না এবং যুক্তিসঙ্গত বক্তব্যকে রক্ষা করি৷ আমরা সব সময় মানুষের মর্যাদাবোধ এবং সার্বজনীন মূল্যবোধের পাশে থাকবো৷’’
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিশামুদ্দীন হুসেইন এক বিবৃতিতে বলেছেন,
‘‘ইসলাম ধর্মের অবমাননা হয় এমন যে কোনো উত্তেজক বক্তব্য বা কাজের আমরা তীব্র নিন্দা করি৷’’
ছবি: Reuters
‘জনগণকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন মাক্রোঁ’
চেচনিয়ার নেতা রমজান কাদিরভ ইন্সটাগ্রামে এমানুয়েল মাক্রোঁর উদ্দেশ্যে লিখেছেন, ‘‘ আপনি জনগণকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন৷ আপনি তরুণদের মস্তিষ্কে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর অবস্থা তৈরি করছেন৷ আপনি খুব সাহস করে নিজেকে আপনার দেশে সন্ত্রাসবাদের নেতা, সন্ত্রাসবাদের প্রেরণাদাতা মনে করতে পারেন৷’’
ছবি: Imago-Images/ITAR-TASS/ Press Office Republic of Chechnya
প্রবাসে অবস্থানরত নাগরিকদের জন্য উদ্বেগ
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, বাংলাদেশ, ইরাক ও মৌরিতানিয়ায় অবস্থানরত সকল ফরাসি নাগরিককে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে৷ সবাইকে সব জনসমাবেশ এবং কার্টুনের বিরুদ্ধে সব প্রতিবাদ সমাবেশ থেকেও দূরে থাকতে বলা হয়েছে বিবৃতিতে৷
ছবি: Reuters/E. Gaillard
7 ছবি1 | 7
বিল অনুযায়ী, কোনো চিকিৎসক যদি কোনো নারীকে ভার্জিন সার্টিফিকেট দেন, তা হলে তাঁর জরিমানা এবং এক বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। নারীবাদী মুসলিম এবং অধিকাররক্ষা কর্মীরা এই ধরনের সার্টিফিকেটের বিরুদ্ধে। কিন্তু উল্টোদিকের যুক্তি হলো, এই সার্টিফিকেট না থাকলে মেয়েরা নির্যাতিতা হতে পারেন। এমনিতেই ফরাসি আইন অনুসারে বহুবিবাহ বন্ধ। তারপরেও বিলে বহুবিবাহ বন্ধের কথা আবার বলা হয়েছে।
জোর করে বিয়ে বন্ধ করতে বিলে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া হচ্ছে, এমন সন্দেহ হলে স্বামী ও স্ত্রীকে আলাদাভাবে এক কর্মকর্তার কাছে যেতে হবে। কর্মকর্তা তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তিনি যদি মনে করেন, জোর করে বিয়ে হয়েছে, তা হলে সরকারি আইনজীবীকে ব্যবস্থা নিতে বলবেন।
সরকারি কাজের সময় কোনো ধর্মীয় পোশাক পরাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে বিলে।
মাক্রোঁর দাবি, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ফ্রান্সের বিপদের কারণ হয়ে উঠেছেন। তাই তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে এই বিল আনা হয়েছে। কিন্তু অধিকাররক্ষা গোষ্ঠীগুলির মতে, এই আইন হলে ফরাসি মুসলিমরা বৈষম্যের শিকার হবেন। ফলে এই বিল খুবই বিতর্কিত।
তবে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, এই বিল কোনো ধর্মের বিরোধী নয়। বিলে কোথাও মুসলিম বা ইসলাম কথা লেখা নেই। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, মসজিদ, স্কুল, জনসেবা ও বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলি যাতে আরো ভালোভাবে চলে এবং ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষতা যাতে বজায় থাকে সেই লক্ষ্যেই বিলটি আনা হয়েছে।