ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত৷ একটা ডাগর সবুজ কাঁচা মরিচ৷ মিহি করে কাটা পেঁয়াজের কুচি৷ সঙ্গে আধডুবো তেলে বড় রুই মাছের পেটি ভাজা৷ মাছ থেকে নিতান্ত অনিচ্ছায় গড়িয়ে পড়া তেল৷ ঐ তেলটুকুই ভাতটা মাখাবে৷
বিজ্ঞাপন
তখন আমাদের নিবাস বরগুনায়৷ আমতলীতে৷ প্রকৌশলী পিতার চাকরির সূত্রে৷ আকারে ও প্রকারে আমি তখন এতটাই ক্ষুদ্র যে, খণ্ড খণ্ড কতক স্মৃতি ছাড়া আর সব কিছুই বিস্মৃত হয়েছি৷ তবে মানসপটে যেসব দৃশ্যের আনাগোনা, তার একটি মাছ ধরার৷ আহা! যেন এক উৎসব৷
যে সরকারি বাড়িটাকে নিজের বাড়ি ভাবতাম, তার সামনেই একটা পুকুর৷ ছিল বাঁধানো ঘাট৷ পুকুরের দৈর্ঘ্য প্রস্থের মাপ জিজ্ঞেস করলে বিব্রত হব৷ তবে মনের গহীন থেকে ভেসে ওঠা বাইনারি কোড বলছে, মাঝে মাঝেই সেখান থেকে মাছ ধরা হত৷ জাল দিয়ে অনেকে মিলে মাছ ধরতেন৷ হৈ চৈ পড়ে যেত৷
অনেকটা রূপকথার মতো মনে হতে পারে এখন, ঐ স্বল্প-গভীর জলের মাছগুলো আমার চেয়েও দীর্ঘ ছিল! তাই যে পাশে মাছগুলো ধরা হতো, আমি থাকতাম তার থেকে দূরে৷ আর আজকাল বাজারে যেসব ‘বড়' মাছ পাওয়া যায়, সেগুলো তখন ধরা পড়লে ছেড়ে দেয়া হতো, যথেষ্ট বড় নয় বলে!
কী আর করা৷ জীবন যেখানে যেমন!
এখানেই শেষ নয়৷ আরো মজার ঘটনা আছে৷ বাড়ির কাছেই একটা ক্ষেতমতো জায়গায় চিংড়ি মাছ চলে আসত৷ নদীর বড় বড় চিংড়ি৷ কীভাবে আসত কে জানে! যতটুকু বুঝতে পারি, নদীর পানির সঙ্গে চলে আসত৷ এসে আটকে যেত৷ পানি নেমে গেলেও চিংড়িকূলের বিদগ্ধ প্রতিনিধিদের ঘরে ফেরা হতো না৷
মাছ আমাদের আর যা উপকার করে
‘মাছে ভাতে বাঙালি’৷ বাঙালির খাবারে তাই অন্তত মাছের একটা আয়োজন থাকবে না, এ প্রায় অকল্পনীয়৷ কিন্তু রসনাবিলাসের উপাদান হওয়া ছাড়াও মাছ যে আরো নানাভাবে আমাদের উপকার করে থাকে, তা কি জানতেন?
ছবি: Getty Images/AFP/A. Gharabli
পোড়া ক্ষত সারাতে তেলাপিয়ার চামড়া
রোগীর শরীরের পুড়ে যাওয়া ক্ষত সারাতে চিকিৎসকরা তেলাপিয়া মাছের ত্বকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখছেন বিজ্ঞানীরা৷ এখন পর্যন্ত সাফল্য পাওয়ার কথাই জানাচ্ছেন তাঁরা৷ তেলাপিয়ার ত্বকে মানুষের ত্বকের প্রায় সমপরিমাণ আর্দ্রতা আর কোলাজেন প্রোটিন আছে৷ এছাড়া তেলাপিয়ার ত্বক মানুষের ত্বকের মতোই রোগপ্রতিরোধী বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা৷
ছবি: Reuters/P.Whitaker
মাছ দিয়ে পেডিকিওর
সৌখিন অনেকেই এখন নিয়মিত পার্লারে গিয়ে পেডিকিওর, মেনিকিওর করান৷ এক ধরনের মাছ যে পেডিকিওরে ব্যবহার হয়, তা কি জানতেন? এই মাছের নাম ‘গারা রুফা’ হলেও একে সাধারণভাবে ‘ডাক্তার মাছ’ বলে ডাকা হয়৷ ছোট ছোট এই মাছে ভর্তি অ্যাকুরিয়ামে পা চুবিয়ে রাখলে, মাছগুলি পায়ের মরা চামড়া খেয়ে নেয়৷
ছবি: Colourbox
মাছের চামড়ায় ফ্যাশন
মাছের চামড়া এখন ব্যবহার হচ্ছে গরু বা ছাগলের চামড়ার বিকলপ হিসেবে৷ ব্যাগ, ব্লট এমনকি জুতাও তৈরি করা হচ্ছে মাছের চামড়া ব্যবহার করে৷ মাছের চামড়ার এ বাজার টেকসই করতে অবশ্য এখনও বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের৷
ছবি: Fotolia/Africa Studio
সৌন্দর্য বর্ধন
বসার ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে এখন অনেকের বাড়িতেই দেখা যায় বৈচিত্র্যময় অ্যাকুরিয়াম৷ আর তাতে শোভা পায় নানা রঙের মাছ৷ এই অ্যাকুরিয়ামে মাছ পোষাকে কেন্দ্র করে সব দেশেই গড়ে উঠেছে বড় বড় সব শিল্প৷ উৎপাদিত হচ্ছে মাছের খাবার, মাছের খেলনা থেকে শুরুর করে আরো নানা জিনিস৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Imaginechina
মাছের তেল
মাছ থেকে তৈরি হয় নানা রকমের তেল৷ এ সব তেল বিভিন্ন রোগে ওষুধের সহায়ক হিসেবে ডাক্তাররা রোগীদের খেতে বলেন৷ রোগ ছাড়াও শরীর সুস্থ রাখার জন্যও এসব তেল অনেকে নিয়মিত খান৷ মাছের তেলে শরীরের জন্য পুষ্টিকর ওমেগা-থ্রি নামের উপাদানের উপস্থিতি থাকে৷ হেরিং, টুনা, স্যামনসহ নানা মাছের শরীর থেকে এ তেল প্রস্তুত হয়৷ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মাছের তেলের নাম কড লিভার তেল৷ এটি তৈরি হয় কড মাছের লিভার থেকে৷
ছবি: Colourbox
5 ছবি1 | 5
যত মাছের গল্প করছি, এই সকল মৎস্যকূল আমার উদরে জায়গা পেত না৷ অন্যমস্তিষ্ক রসনাতৃপ্ত করে অন্যের কণ্ঠ দিয়ে চালান হতো৷
কারণ আমি তখন মাছ খেতাম না! অবাক হবার কিছু নেই৷ সত্যি খেতাম না৷ আরো অবাক হবার কিছু নেই, কারণ আমার বাড়ির কেউ মাছ খেতেন না!
এলাকার বড়কর্তা হিসেবে সমস্ত ভোগে পিতৃমহোদয়ের অগ্রাধিকার থাকলেও তা দুর্ভোগের কারণ হতো মাতৃমহোদয়ের৷ তিনি ও তাঁর কর্মসহযোগীরা মিলে সেই মৎস্যসম্প্রদায়কে কেঁটেকুটে অন্যকে উপঢৌকন পাঠাতেন৷ কিংবা বাড়িতে রান্না হলেও তা হতো অপরের প্রয়োজনে৷
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, দ্য কাউ লিভস অন গ্রাস৷ আর আমরা? উই লিভড অন কাউ অর চিকেন৷
মাছের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছে আরেকটু পরে৷ তা-ও বড় মাছগুলোই খেতে মজা, এই গুঢ় তত্ত্বের ওপর ভর করে৷ এই তত্ত্বে বিশ্বাস ছিল বহুকাল৷ যখন বরগুনার পাঠ চুকিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে কুমিল্লায় পাড়ি দিলাম, তখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কত হাঁকিয়ে হেঁকে গেছেন ‘কাচকি কাচকি' করে৷ আমাদের টলাতে পারেননি৷
এমনকি কালের বিবর্তনে টাকি-টেংরারা কখনো সখনো টেবিল অবধি আসতে পারলেও, আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি৷ মুখও৷ আর কৈ মাছও আমাকে টানতে পারলো কই? পেরেছে, আরো পড়ে৷
স্কুল পেরিয়ে কলেজ৷ সুবাদে রাজধানীকে চেনা৷ কত লোক, কত রং৷ কত ব্যস্ততা৷ মলা-ঢেলাদের সঙ্গে প্রথম ভাব জমিয়েছি এখানেই৷ এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টায় মাছ ভর্তায় মজেছি৷ বন্ধুদের সঙ্গে চলে গিয়েছি চিরল চিরল বাতাস বয় যেখানে, সেই বিরিশিরি৷
পেশাগত প্রয়োজনে ছুটে বেড়িয়েছি, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত৷ শোল, পিউলি, বাটা, শিং, মাগুর, তপসে, পাবদা, খলসে, কাচকি, পাইশা, সরপুটিরা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে৷ আমিও খেয়েছি তাদের৷
একবার রাজশাহীতে এক অনুজ খাওয়ালেন পদ্মার পাঁচমিশালী মাছ৷ নাম জানি না৷ নানান রকমের ছোট মাছের মিশ্রণ৷ খুব ভোরে ঘাটে পাওয়া যায় মাছগুলো৷ উঠে আসে অন্য মাছের সঙ্গে৷ ঝোল করে রান্না হলো৷ মুখে দিলেই গলে যায়৷ জিহ্বা থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত স্বাদ টের পাওয়া যায়৷
সাতসমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বন শহরেও খুঁজে পেয়েছি এক ঠিকানা৷ যেখানে গেলে মেলে দেশি মাছ৷ সেসব মাছেরা জল ছেড়ে বরফে ঢেকে এ পর্যন্ত আসতে মাস পেরিয়ে যায়৷ তাতে কি? দেশি মাছ তো৷
দেশে বিদেশে কত জায়গায় কত মাছ খেয়েছি৷ কিন্তু মিঠা পানিতে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছের স্বাদ আর কোথায়? নেই৷ চাষের মাছে আঁশ কি মেটে?
জার্মানির বাজারে বাংলাদেশের মাছ
মাছে-ভাতে বাঙালি বলে কথা৷ হ্যাঁ, বাঙালির সেই রসনা মেটাতেই রুই, কাতলা, ইলিশসহ বাংলাদেশের প্রায় সব মাছই আজকাল পাওয়া যায় জার্মানিতে৷ সে গল্পই থাকছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/N. Sattar
বাংলাদেশি মাছের বাজার
বাঙালি যে দেশেই বসবাস করুক না কেন, তাদের মাছ চাই৷ আর দেশীয় মাছ হলে তো কথাই নেই৷ জার্মানির বেশ কিছু শহরে তাই বাংলাদেশি পণ্যের দোকান রয়েছে, যেখানে মাছ ছাড়াও পাওয়া যায় অন্যান্য অনেকরকম খাবার৷
ছবি: DW/N. Sattar
বন শহরে বাংলাদেশি মাছের বাজার
এ দোকানে ইলিশ, রুই, কাতলা, চিংড়ি, পাবদা, কাজলি, পুটি, কেচকি, রূপচাঁদা ছাড়াও নানারকমের ছোট ও বড় মাছ পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/N. Sattar
বিশাল আকারের হিমায়িত রুই
কোলন শহরে রয়েছে বাংলাদেশি খাবারের দোকান৷ বড় বড় আস্ত রুই মাছগুলো এভাবেই বাংলাদেশ থেকে আসে৷ ক্রেতারা যে যেভাবে যতটুকু চান, তাঁকে সেভাবে দোকান থেকেই ইলেকট্রনিক ছুড়ি দিয়ে মাছ কেটে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/N. Sattar
স্বাদ করে সাধের ইলিশ খাওয়া
সারা বছরই অনেক বাঙালি নানাভাবে ইলিশ খান৷ তবে ১লা বৈশাখে ইলিশ চাই-ই চাই৷ যে কারণে অনেকে আগে থেকেই যথেষ্ট পরিমাণে ইলিশ কিনে ফ্রিজে রেখে দেন তাঁরা, পাছে ফুরিয়ে যায়৷ ইলিশ ছাড়া কি বাঙালির ১লা বৈশাখ জমে!
ছবি: Eesha Kheny
সবচেয়ে বড় বাংলাদেশি মাছের দোকান ফ্রাংকফু্র্টে
জার্মানির বাণিজ্য নগরী ফ্রাংকফুর্ট৷ সেখানে সরাসরি বাংলাদেশ বা লন্ডন থেকে মাছা আনা হয়৷ আর কোলন, বন বা অন্যান্য শহরের ব্যবসায়ীরা মাসে এক বা দু’বার মাছসহ অন্যান্য বাংলাদেশি পণ্য আনতে ফ্রাংকফুর্টে যান৷ মাঝে মাঝে অবশ্য তাঁরা লন্ডন থেকেও এ সব পণ্য নিয়ে আসেন৷ জানালেন বনের বাংলা শপের মালিক রিপন সাহেব৷
ছবি: DW/N. Sattar
বাঙালির আবেগ
জার্মানিতে এমন বাঙালিও আছেন, যাঁরা নিজের দেশের ফ্রোজেন মাছ ছাড়া তৃপ্তি করে ভাতই খেতে পারেন না৷ জার্মানির স্বাস্থ্যকর তাজা মাছে তাঁদের পেট ভরলেও মন যে ভরে না!
ছবি: DW/N. Sattar
ছোট মাছ
ছোট মাছের চচ্চরি! আহারে কি দারুণ স্বাদ! তা হোক না ফ্রোজেন, তাতে কি?
ছবি: DW/N. Sattar
শুটকি মাছ
শুধু ফ্রোজেন মাছ নয়, জার্মানির বাজারে ভোজন রসিক বাঙালির প্রিয় শুটকি মাছও রয়েছে৷
ছবি: DW/N. Sattar
মাছের মূল্য
রুই মাছ প্রতি কেজি পাঁচ ইউরো বা বাংলাদেশি টাকায় পাঁচ’শ টাকা৷ আর এক কেজি ইলিশ মাছের দাম এক হাজার তিন’শো টাকা৷ অনেকেরই প্রিয় দেশি চিংড়ি মাছ৷ যার মূল্যও ইলিশের মতোই৷ বাংলাদেশি ৮০০ টাকা প্রতি কেজি পাবদা মাছের দাম৷
ছবি: DW/N. Sattar
9 ছবি1 | 9
যুবায়ের আহমেদের লেখা এই ব্লগ পোস্টটি কেমন লাগলো আপনাদের? লিখুন আমাদের, নীচের ঘরে৷