ডাব্লিউডাব্লিউএফ ইন্টারন্যাশনাল-এর সর্বাধুনিক ‘‘লিভিং প্ল্যানেট রিপোর্ট’’-এ এই তথ্য দেওয়া হয়েছে: ১৯৭০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৩,০৩৮ প্রজাতির ১০,৩৮০টি গোষ্ঠীতে বন্যপ্রাণীদের সংখ্যা কমেছে গড়ে ৫২ শতাংশ৷
বিজ্ঞাপন
ডাব্লিউডাব্লিউএফ-এর লিভিং প্ল্যানেট রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৯৮ সাল থেকে, প্রতি দু'বছর অন্তর৷ এই রিপোর্টকে আমাদের গ্রহের অবস্থার ব্যারোমিটার বলে অভিহিত করা হয়৷ যে তথ্যের উপর ভিত্তি করে রিপোর্ট, সেই ‘ডাটাবেসটি' রাখে লন্ডনের জুওলজিকাল সোসাইটি৷ প্রথম এ ধরনের পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাঙ্গীণ ডাটা সংগৃহীত হয় ১৯৭০ সালে৷ প্রতিটি রিপোর্টের ভিত্তি চার বছর আগে সংগৃহীত ডাটা৷
মজার কথা হলো, মাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী জীব, উভয়চর জীব এবং সরীসৃপ মিলিয়ে বন্যপ্রাণীদের সংখ্যা ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে হ্রাস পেয়েছিল গড়ে ২৮ শতাংশ – ডাব্লিউডাব্লিউএফ-এর ২০১২ সালের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে৷ সে'যাবৎ সেই অনুপাত বদলে – এবং বেড়ে – গড়ে ৫২ শতাংশ হওয়ার কারণ, বিভিন্ন জীব ও প্রজাতির সংখ্যা গণনার পদ্ধতিতে ব্যাপক উন্নতিসাধন হয়েছে৷
হুমকির মুখে যেসব প্রাণী
হুমকির মুখে থাকা কিছু প্রজাতির প্রাণী লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে৷ এদের মধ্যে আফ্রিকার ওকাপিসহ আরো ২০০ পাখি রয়েছে৷ তবে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ওকাপি’র সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে
জিরাফের মতো দেখতে এই ওকাপি’র বাস কঙ্গোতে৷ আফ্রিকার ঐ অঞ্চলে কত প্রাণীর বাস তার হিসাব রাখে ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন)৷ সংস্থাটি সম্প্রতি হুমকির তালিকায় থাকা প্রাণীদের নাম প্রকাশ করেছে৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে, কঙ্গোর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকা এই ওকাপির সংখ্যা নব্বইয়ের দশকে ছিল ৪,৪০০৷ দশ বছর পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২,৫০০ তে৷ কঙ্গোর সহিংসতা এবং খনি ব্যবসাকে এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে৷
ছবি: cc-by-sa-3.0/Raul654
বিলুপ্তির পথে
আইইউসিএন জানিয়েছে, ওকাপি এখন হুমকির মুখে৷ তাদের তৈরি তালিকার একেবারে তলানিতে আছে ওকাপির নাম৷ অর্থাৎ এরাই সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে রয়েছে৷ এমন অনেক প্রাণী আছে, আজ থেকে ২০০ বছর আগেও যাদের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন বালি টাইগার৷ বাঘের প্রায় সব প্রজাতিই আজ হুমকির মুখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুইশ প্রজাতির পাখি হুমকির মুখে
নতুন রেড লিস্টে দুইশ প্রজাতির পাখিও রয়েছে৷ এদের মধ্যে অনেক শকুন আছে, যাদের বাস ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়৷ আইইউসিএন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, চীন ও মালয়েশিয়ার অনেক শকুন এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে৷ ইথিওপিয়া, জিম্বাবুয়ে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা অনেক শকুন এখন হুমকির মুখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এশিয়ার হাতি দ্রুত কমছে
বিশ্বে এখনও এশিয়ান এলিফেন্টের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজার৷ কিন্তু এরাও হুমকির মুখে রয়েছে৷ গত তিন প্রজন্ম ধরে এই প্রজাতির হাতির সংখ্যা কমছে৷ আইইউসিএন বলছে, তিন প্রজন্মে হাতির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান হাতি দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/Horst Galuschka
পাচার ও দাঁত বিক্রির কারণে বিপদ
কেবল এশিয়া নয়, আফ্রিকার হাতিরাও হুমকির মুখে৷ বন উজাড় এবং দাঁতের জন্য শিকারীদের উৎপাতও হাতিদের সংখ্যা কমানোর জন্য দায়ী৷ সেইসাথে অবৈধভাবে শিকার এবং চুরি করে পাচার করাও দিন দিন বাড়ছে৷ হাতি পাচার রোধে এ মাসের ২ থেকে ৪ ডিসেম্বর বতসোয়ানায় ‘আফ্রিকান এলিফেন্ট সম্মেলন’-এর আয়োজন করে আইইউসিএন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিলুপ্তির পথে মাছ
ডলফিনের মত দেখতে এই পরপয়েসদের সচরাচর দেখা যায় ক্যালিফোর্নিয়ায়৷ মাছ ধরার জালে আটকে প্রায়ই মারা যায় এরা৷ কখনো কখনো জেলেরা এদের ধরে নিয়ে যায়৷ ফলে হুমকির মুখে রয়েছে এই প্রজাতিটি৷ বিশ্বে এখন মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ পরপয়েস রয়েছে৷
ছবি: WDC
কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে আশার আলো
কিছু কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে অবশ্য উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেমন লেদারব্যাক কচ্ছপ৷ অথচ এক দশক আগে এই প্রজাতির কচ্ছপটি ছিল রেড লিস্টে, অর্থাৎ হুমকির মুখে৷ দুই মিটার লম্বা এবং আধা টন ওজনের এই কচ্ছপগুলো আকারে সবচেয়ে বড় হয়৷ এদের হুমকির মুখে পড়ার কারণ সাগরের দূষণ৷
ছবি: gemeinfrei
প্রাণী কল্যাণ সংস্থার অবস্থা
এছাড়া ব্ল্যাকব্রোও অ্যালবাট্রসের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে৷ নতুন লাল তালিকায় এই প্রজাতির পাখির আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে৷ আইইউসিএন এর পরিচালক ইয়ান স্মার্ট জানান, অনেক প্রজাতির উন্নতি হলেও এখনও ২১,০০০ প্রাণী হুমকির মুখে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষবার দেখার সুযোগ: পান্ডা, গন্ডার, লিঙ্কস
হুমকির মুখে থাকা প্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম জায়ান্ট পান্ডা৷ বিশ্বে এদের সংখ্যা মাত্র ১০০০ থেকে ২০০০৷ আর আছে সুমাত্রার গন্ডার, যাদের মোট সংখ্যা মাত্র ২২০৷ এছাড়া লাইবেরিয়ার লিঙ্কসও আছে এই তালিকায়৷ এদের সংখ্যা মাত্র ৮০ থেকে ১৫০টি৷ ১৯৬৩ সাল থেকে এই রেড লিস্ট প্রকাশ করে আসছে আইইউসিএন৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
দেখা যাচ্ছে, বন্যপ্রাণী হ্রাসের অধিকাংশ হদিশ পাওয়া গিয়েছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকা, বিশেষ করে দক্ষিণ অ্যামেরিকা থেকে৷ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলিতে বন্যপ্রাণী হ্রাসের হার সবচেয়ে বেশি, গড়ে ৫৮ শতাংশ৷ সে তুলনায় ধনি দেশগুলিতে বন্যপ্রাণীদের সংখ্যা দৃশ্যত দশ শতাংশ বেড়েছে৷ আরেকটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান: স্থলচর প্রাণীদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে গড়ে ৩৯ শতাংশ, কিন্তু জলচর প্রণীদের সংখ্যা কমেছে ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত৷ বন্যপ্রাণী হ্রাসের মূল কারণ হিসেবে হ্যাবিট্যাট বা বাসস্থানের অবনতি বা অপসারণ, মাত্রাধিক শিকার ও মাছ ধরার কথা বলা হয়েছে৷
ইতিপূর্বে পৃথিবীতে বন্যপ্রাণীদের ইতিহাসে পাঁচবার যাকে বলা হয় ‘মাস এক্সটিংশন' বা গণ অবলুপ্তি ঘটেছে, বিশেষ করে মহাকাশ থেকে সুবিশাল ধূমকেতু এসে পৃথিবীতে আঘাত হানার ফলে৷ প্রায় ২৫ কোটি বছর আগে একটি ধূমকেতুর আঘাতে পৃথিবীর বন্যপ্রাণীদের ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়৷ সাড়ে ছ'কোটি বছর আগে একটি ধূমকেতু এসে আছড়ে পড়ায় ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে বসবাসকারি প্রজাতিদের তিন-চতুর্থাংশ প্রাণ হারায়৷
কিন্তু বন্যপ্রাণীদের বর্তমান সংকটের পিছনে রয়েছে বাসস্থানের অবনতি, শিকার ও মাছ ধরা; এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও পরিবেশ দূষণ৷ ‘‘এই ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী নয়, বরং আমারা যেভাবে বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার ফলশ্রুতি,'' বলেছেন লন্ডন জুওলজিকাল সোসাইটির বিজ্ঞান বিভাগীয় পরিচালক কেন নরিস৷