গণজাগরণ মঞ্চের বর্ষপূর্তিতে স্বাধীনতা বিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে অবিচল থাকার ঘোষণা করেছেন মঞ্চের নেতা-কর্মীরা৷ তাঁরা শপথ নিয়েছেন নতুন করে৷ এই নতুন শপথে উজ্জীবিত শাহবাগ৷ সংহতি জনিয়েছেন হাজারো মানুষ৷
বিজ্ঞাপন
বর্ষপূর্তির কর্মসূচি শুরু হয় সকাল থেকেই৷ সকালে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান৷ নীরবতা পালন করে সম্মান জানান ৫২-র ভাষা শহিদদের৷ তার সঙ্গে তাঁরা শপথ নেন নতুন আন্দোলনের৷
বিকেলে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে সমাবেত সবাই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেন৷ বিকেল সাড়ে ৩টার কিছু আগে ইমরান এইচ সরকার শপথ বাক্য পাঠ করান সমবেত সবাইকে৷ প্রজন্ম চত্বরে সকলে সমবেত কণ্ঠে শপথ নেন সকল যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, যুদ্ধাপরাধীদের সব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জোট বর্জন করা, সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার লক্ষ্যে৷ শপথের পর শাহবাগ থেকে শুরু হয় গণজাগরণ যাত্রা৷ যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ তাঁদের দাবির পক্ষে ব্যানার, পোস্টার আর ফেস্টুন নিয়ে পায়ে হেঁটে এই জাগরণ যাত্রা শাহবাগ থেকে শুরু হয়ে কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা ঘুরে আবারো শাহবাগে এসে শেষ হয়৷ এরই মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর৷
এরপর শুরু হয় আলোচনা সভা ও স্মৃতিচারণ এবং সবশেষে রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান৷ এ সব কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ ছাড়াও বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেন৷ তাঁরা আলোচনা সভায় গণজাগরণ মঞ্চের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন৷ বলেন, অনেক অপপ্রচার হয়েছে৷ কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে থামানো যায়নি৷ তাঁরা মাথা নোয়ায়নি৷ তাঁরা জেগে আছে বলেই আজ বাংলাদেশে যু্দ্ধাপরাধের বিচার সম্ভব হয়েছে৷ আর তাঁরা জেগে থাকলে এই বিচার কেউ বন্ধ রতে পারবে না৷ সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ‘‘শাহবাগের এই তারুণ্যই আমাদের বাতিঘর৷ তারাই আমাদেও পথ দেখিয়েছে, পথ দেখাবে৷'' শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘শাহবাগের তারুণ্য আমাদের গর্ব৷ তারাই আমাদেও পথ হারাতে দেয়নি৷''
বর্ষপূর্তির সমাবেশে আসা তরুণ কর্মজীবী সায়মা সুলতানা জানান, অনেকেই সমালোচনা করেছেন৷ তিনি নিজেও শাহবাগে আসার কারণে সহকর্মীদের নিন্দার মুখে পড়েছেন, তবুও পিছপা হননি৷ ভবিষ্যতেও হবেন না৷ এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাবির আহমেদ বলেন, তাঁকেও নাস্তিক ব্লগার বলে গালি দেয়া হয়েছে৷ ভয় দেখানো হয়েছে৷ অপপ্রচার করা হয়েছে, যা চলছে এখনও৷ কিন্তু যে তারুণ্য এক বছর আগে জেগেছে, সেই তারুণ্য থামবে না৷
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, তাঁদের আন্দোলনে সব সময়ই গণমানুষের সমর্থন ছিল এবং থাকবে৷ দেশের মানুষ এই আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছে৷ ভবিষ্যতেও পথ দেখাবে৷ কোনো অপশক্তির কাছে তাঁরা মাথা নোয়াবেন না৷ কোনো ভয়ে তাঁরা ভীত নন৷ কোনো অপপ্রচারই তাই সফল হবে না৷ দেশ যুদ্ধাপরাধী এবং সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চলবে৷
পুলিশি নির্যাতনের শিকার গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা
পাকিস্তানের সঙ্গে অস্থায়ী কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা৷ এতে নারীসহ বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন৷ প্রতিবাদে নতুন আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ৷
ছবি: REUTERS
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের দাবি
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় গত ১২ ডিসেম্বর কার্যকর হয়৷ এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়৷ এমনকি সেদেশের জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাবও পাস হয়৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে পাকিস্তানের এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সরব হয় গণজাগরণ মঞ্চ৷
ছবি: DW
‘নাক গলানোর’ প্রতিবাদ
কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে পাকিস্তানের ‘নাক গলানোর’ প্রতিবাদে ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় সেদেশের দূতাবাসের সামনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা৷ কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা পুলিশের বাধার কারণে সফল হয়নি৷ তাই গুলশানে পাকিস্তান দূতাবাসের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
সম্পর্ক ছিন্নের আল্টিমেটাম
গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা বুধবারের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আপাতত স্থগিত রাখতে সরকারকে ২০ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়৷ এই সময়ের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন না করলে পাকিস্তান দূতাবাস ঘেরাও করার ঘোষণাও দেয় তারা৷
ছবি: DW/M. Mamun
পাকিস্তান দূতাবাস ঘেরাও চেষ্টা
আল্টিমেটাম অনুযায়ী, ২০ ঘণ্টা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আবারো সক্রিয় হন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা৷ কিন্তু পাকিস্তান দূতাবাস অভিমুখে তাদের মিছিলে লাঠিপেটা করে পুলিশ৷ ফলে দূতাবাস অবধি পৌঁছানো আর সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষে৷
পুলিশের লাঠিপেটায় আহতদের মধ্যে রয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার৷ পুলিশ তাঁকে মিছিল থেকে একাধিকবার আটকের চেষ্টা করে বলে দাবি করেছেন মঞ্চের কর্মীরা৷ কিন্তু কর্মীদের বাধার মুখে ইমরানকে আটক করতে পারেনি পুলিশ৷ গণজাগরণ মঞ্চের মারুফ রসুল এই বিষয়ে বলেন, ‘‘ইমরানকে পুলিশ দু’দফায় লাঠিপেটা করলে তিনি মাথা, বুক ও পিঠে আঘাত পান৷ তাঁকে প্রথমে ল্যাবএইড এবং পরে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হয়৷’’
ছবি: DW/M. Mamun
বাদ যায়নি নারী কর্মীরাও
পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের নারী কর্মীরাও৷ এক নারী কর্মীকে পুরুষ পুলিশের পেটানোর এবং টানাহ্যাঁচড়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে৷ পুলিশ অবশ্য দাবি করেছে, তারা গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা বা নির্যাতন করেনি৷ ঐ এলাকা কূটনৈতিক পল্লি হওয়ায় স্পর্শকাতর এলাকা থেকে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে৷
ছবি: DW
‘পুলিশের লাঠিপেটা গ্রহণযোগ্য নয়’
গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের উপর পুলিশের লাঠিপেটা প্রসঙ্গে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেছেন, ‘‘গণজাগরণ মঞ্চ যে অবস্থান থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিতের দাবি জানিয়েছে তা ঠিকই আছে৷ কিন্তু সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় সবদিক বিবেচনা করে৷ তবে গণজাগরণ মঞ্চের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে পুলিশের লাঠিপেটা গ্রহণযোগ্য নয়৷’’
ছবি: DW/M. Mamun
‘সাত দিনের মধ্যে বিচারের দাবি’
এদিকে, কর্মীদের ওপর হামলাকারী পুলিশের ৭ দিনের মধ্যে বিচার না হলে আগামী শুক্রবার কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ৷ শুক্রবার শাহবাগে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে একথা জানান তাঁরা৷ এসময় বাংলাদেশিদের প্রতি পাকিস্তানের পণ্য বর্জনের আহ্বানও জানায় গণজাগরণ মঞ্চ৷
ছবি: DW/M. Mamun
গণজাগরণ মঞ্চ
উল্লেখ্য, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে শাহবাগে সমবেত হন অসংখ্য মানুষ৷ শাহবাগের এই সমাবেশ থেকেই সৃষ্টি হয় গণজাগরণ মঞ্চ, যাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আপিলের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার৷
ছবি: REUTERS
10 ছবি1 | 10
গত বছরের ৫ই ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রতিবাদে ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ব্লগাদের আহ্বানে প্রতিবাদী তরুণরা নেমে আসেন শাহবাগে৷ এরপর সেই আন্দোলন শাহবাগ থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন পরিণত হয় সবার আন্দোলনে৷
বছর পূর্তিতে বুধবার আবারো মানুষের পদভারে এবং স্লোগানে প্রকম্পিত হয় শাহবাগ৷ শাহবাগ আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে পালন করা হচ্ছে তিন দিনের কর্মসূচি৷ কেউ কেউ লিখেছেন কবিতা৷ যেমন কবি আলেক্স আলিম৷ তিনি লিখেছেন: