1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বাণিজ্য’

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩১ মে ২০১৮

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া, এমনকি টাকা না পাওয়ায় ‘বন্দুক-যুদ্ধে’ হত্যার অভিযোগও উঠছে৷ তদন্তও শুরু হয়েছে কয়েকটি জায়গায়৷

ছবি: bdnews24.com

এইসব অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় এরইমধ্যে কিছু পুলিশ সদস্যের কিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে৷ চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকরাম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে সোমবার৷ তিনি একজন মাদক ব্যবসায়ীকে আটকের পর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ৷ অধিকতর তদন্তের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে৷

অভিযাগে বলা হয়েছে, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনার ঈশ্বরচন্দ্রপুরের ‘মাদক ব্যবসায়ী’ সেলিম উদ্দিন ঝন্টুকে আটকের পর ৭ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেন ওসি আকরাম হোসেন৷ শুধু তাই নয়, তাকে এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতাও করেন৷ তার বিরুদ্ধে ওই এলাকার মাদকবিরোধী অভিযানের নামে নিরীহ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে অর্থ আদারেয়রও অভিযোগ আছে৷

এদিকে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানার এএসআই জুয়েল হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে একই ধরনের অভিযোগে৷ তিনি অন্তত দু'জন ‘মাদক ব্যবসায়ীকে’ আটকের পর ঘুস নিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ৷

ওই ঘটনায় তিনি মোট তিনজনকে আটক করেন৷ দু'জন টাকা দিয়ে ছাড়া পেলেও আরেকজন টাকা দিতে না পরায় তার বিরুদ্ধে ইয়াবা পাচারের মামলা করেন এএসআই জুয়েল৷ তার বিরুদ্ধে আরো অনেক লোককে আটক এবং টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে৷ নিরীহ লোকজনকে মাদকের মামলায় আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও আছে এসআই জুয়েলের বিরুদ্ধে৷

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে টাকার বিনিময়ে দুই মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে৷ ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) তাজুল ইসলাম ও আতাউর রহমান গত শনিবার রাতে আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে দুই  ‘মাদক ব্যবসায়ীকে’ ছেড়ে দেন৷

ফেনির ফুলগাজীতেও উঠেছে ভয়াবহ অভিযোগ৷ টাকা না পাওয়ায় ‘বন্দুক যুদ্ধে’ হত্যার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে৷ ২৩ মে রাতে ফুলগাজী উপজেলা আনন্দপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামে ‘মাদক চোরাকারবারিদের’ সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলির সময় সাহমিত হোসেন শামীম (২৫) ও মজনু মিয়া মনির (২৩) নামে দুইজন নিহত হয় বলে পুলিশ জানায়৷ তবে শামীমের মা আনোয়ারা বেগম সংবাদ মাধ্যমের কাছে দাবি করেন, বুধবার দুপুরে বাড়ির পাশের জমিতে গরুর জন্য ঘাস কাটছিল তাঁর ছেলে৷ বেলা ২টার দিকে ফুলগাজী থানার এসআই শফিক এসে সেখান থেকে শামীমকে নিয়ে যায়৷ আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘‘পরে পুলিশ আমাদের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে৷ টাকা দিতে না পারায় রাতে ওকে গুলি করে হত্যা করেছে৷’’ একই ধরনের অভিযোগ করেছেন মজনু মিয়া মনিরের বোন রেজিনা বেগম৷ তিনি বলেছেন, ‘‘গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে এসে একদল লোক বুধবার রাতে ফেনী শহরের বড় মসজিদ এলাকার বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়৷ পরে দেড় লাখ টাকা দাবি করে৷ রাতে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গেলে আমাদের তাড়িয়ে দেয়৷ টাকা দিতে না পারায় ভোর রাতে পুলিশ মনিরকে গুলি করে মেরেছে৷’’ তবে পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷

অন্যদিকে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী এলকার একটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তুলেছে৷ অভিযোগ– জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের হিসেবে এক প্রভাবশালী প্রতিপক্ষের হয়ে পুলিশ সমর চৌধুরী নামে এক বয়স্ক ব্যক্তির হাতে ইয়াবা ও অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে৷ তাঁকে পুলিশ আগে তুলে নেয়৷ এরপর ক্রসফয়ারের ভয় দেখায়৷ সর্বশেষ মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে কারাগারে পাঠায়৷ এলএলবি পাস সমর চৌধুরী আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ করেন এবং এলাকায় সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত৷ এর আগেও পুলিশ ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষ নিয়ে সমর চৌধুরীকে নানাভাবে হয়রানি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷

গত ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফে র‌্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন কাউন্সিলর একরামুল হক৷ পরে তাঁর স্ত্রী আয়েশা বেগম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘আমার স্বামীকে সাজানো বন্দুক যুদ্ধের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে৷ তিনি কোনোভাবেই কোনো মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না৷’’ সংবাদ সম্মেলনে তাঁর দুই মেয়ে তাহিয়াত (১৪) ও নাহিয়ানসহ (১১) পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন৷

আয়েশা বেগম দাবি করেন, তাঁর স্বামীকে অন্যায়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার স্বামী কোনোদিন ইয়াবা তো দূরের কথা, কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে পর্যন্ত চলাফেরা করেনি৷ র‌্যাবের সাথে কোনোভাবে বন্দুকযুদ্ধ হয়নি৷ বন্দুকযুদ্ধের নামে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে৷ ঘটনাস্থল থেকে যে ইয়াবা ও অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ সাজানো৷’’ তবে র‌্যাব দাবি করেছে, একরামুল হক ‘তালিকাভূক্ত’ মাদক ব্যবসায়ী এবং তিনি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন৷

দেশের বিভি্ন থানা এালাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য চলমান মাদকবিরোধী অভিযানকে টাকা আয়ের সুযোগ হিসেবে নিয়েছে৷ তারা কয়েকভাবে টাকা আদায় করেন বলে অভিযেগ৷ গ্রেপ্তারে ভয় দেখিয়ে, গ্রেপ্তার করে ছাড়ার বিনিময়ে, নিরীহ লোককে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকভূক্ত করার ভয় দেখিয়ে এবং তালিকা থেকে নাম কাটার বিনিময়ে৷ এছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ভয়কে তারা মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে৷

জানাগেছে, কেন্দ্রীয়ভাবে মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা থাকলেও স্থানীয়ভাবে থানা পর্যায়েও তালিকা করা হয়েছে এবং  হচ্ছে৷ অভিযোগ, থানা পর্যায়ের তালিকায়ই কোনো কোনো পুলিশ সদস্য ‘ঘুস বাণিজ্যে’র কাজে লাগাচ্ছেন৷ ‘ইন্সপেক্টর (তদন্ত)-এর কাছে এই তালিকার দায়িত্ব থাকলেও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অর্থ আদায়ের জন্য তাদের ইচ্ছেমতো তালিকায় নাম অন্তর্র্ভূক্ত করছেন, বাদও দিচ্ছেন৷ এমনকি সর্কেল এএসপি এবং এএসপিরাও এই তালিকা সম্পর্কে অবগত নন৷ অর্থ আদায়ের জন্য মাদকের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তিদের নামও তালিকায় ঢোকানো হচ্ছে৷

পুরো বিষয়ে বক্তব্য জানতে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগাযোগ করেও কোনো তথ্য বা বক্তব্য জানা যায়নি৷  পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগ ডয়চে ভেলেকে বলছে, সাংবাদিকের পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কোনো তথ্য দেয়া যাবে না৷ আর পরিচয় নিশ্চিতের পদ্ধতি হিসেবে সশরীরে পুলিশ সদর দপ্তরে যাওয়াকে একমাত্র উপায় হিসেবে জানানো হয়৷

শুরু থেকে তালিকায় নাম দেয়া, না দেয়া নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ আছে: নূর খান

This browser does not support the audio element.

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথম থেকেই আমার প্রশ্ন ছিল, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই মাদকবিরোধী অভিযানকে তাদের অর্থ বাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে কিনা৷ আজকে এই পর্যায়ে এসে অনেক ক্ষেত্রেই তাই মনে হচ্ছে৷ আমরা এরই মধ্যে অনেক অভিযোগ দেখছি৷ টাকা নিয়েও ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে৷ আবার ক্রসফয়ারের ভয় দেখিয়েও টাকা নেয়া হয়েছে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘এই অভিযানে সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে৷ ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব হচ্ছে৷ আর শুরু থেকে তালিকায় নাম দেয়া এবং নাম না দেয়া নিয়ে বাণিজ্যেল অভিযোগ আছে৷ ফলে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে সহজে বের হওয়া সম্ভব হবে বলে আমরা মনে হয় না৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ এটাকে অর্থবাণিজ্যের কাজে লাগাবে৷’’

ক্ষমতা থাকলে তারতো অপব্যবহার হয়ই: সাবেক আইজি

This browser does not support the audio element.

আর পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নূরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ক্ষমতা থাকলে তার তো অপব্যবহার হয়ই, এট তো আর নতুন কিছু না৷ এখানে দেখতে হবে, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন সেখানে অ্যাকশন নিতে হবে৷ আর যার কাছে এই কো-আর্সিভ ক্ষমতা থাকে, ধরার ক্ষমতা থাকে, সেখানে বাড়াবাড়ি হতেই পারে৷ বাড়াবাড়ি হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ সুপারভাইজারি অফিসারদের দায়িত্ব নিয়ে এটা দেখতে হবে৷ তা না করলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীওতো বলেছেন, বাড়াবাড়ি হলে তার অ্যাকশন নেয়া হবে৷ বাড়াবাড়ি হবে বলে তো আর অভিযান বন্ধ করে দেয়া যায় না৷ এটা ব্যক্তির দায় বা বিচ্যুতি৷ এটার জন্য তো কোনো বাহিনী দায়ী নয়৷ ব্যক্তি অপরাধ করলে ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’

প্রসঙ্গত, মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত ১৩৮ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি৷

প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ