ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘স্বচ্ছ ভারতের' পর এবার ‘ড্রাগস-ফ্রি-ইন্ডিয়া'-র ডাক দিয়েছেন৷ গত রবিবার তাঁর তৃতীয় ‘মন-কি-বাত' বা ‘মনের কথা' নামের বেতার ভাষণে মাদক সেবনকে ‘জাতীয় বেদনা' হিসেবে অভিহিত করেন মোদী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিজ্ঞাপন
মাদক সেবন জীবনে অন্ধকার, বিনাশ ও বিপর্যয় ডেকে আনে, বলেছেন মোদী তাঁর বেতার ভাষণে৷ জাতির প্রতি সরাসরি বক্তব্য রাখার এই সহজ-সরল পদ্ধতিটি ক্রমেই আরো বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে এবং মোদী দৃশ্যত এই ভাষণের জন্য এমন সব বিষয় বেছে নিচ্ছেন, যা সর্বভারতীয় পর্যায়ে বর্তমান সমস্যাবলী ও তাদের যৌথ প্রতিরোধ তথা প্রতিষেধকের দিকে নজর ফেরাতে সক্ষম৷ মাদক বর্জ্জিত ভারত ঠিক সেইরকম একটি ‘স্লোগান'৷
মোদী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একদিকে নিজের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, অপরদিকে আসন্ন এবং পরিকল্পিত প্রশাসনিক পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন৷ তার মধ্যে প্রথমেই আসে একটি টেলিফোন ‘হেল্পলাইন', যা শীঘ্র সৃষ্টি করা হবে৷ সম্প্রতি তিনি যখন আসামে পুলিশের ডাইরেক্টর-জেনারেল বা ডিজি-দের সঙ্গে একটি সম্মেলনে মিলিত হন, তখন তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের এ ধরনের একটি হেল্পলাইন গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন, বলে মোদী জানান৷
মাদক প্রসঙ্গে যে দু'টি শব্দ বারংবার মোদীর মুখে শোনা গেছে, সেগুলো হলো: বেদনা এবং রোষ৷ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন একাধিক সরকারী কর্মকর্তা তাঁর কাছে এসে তাঁদের সন্তানদের মাদকসেবনে জড়িয়ে পড়ার বেদনাদায়ক কাহিনি শুনিয়েছেন; একবার তিনি পাঞ্জাবে মাদকসেবীদের মায়েদের রোষ ও বেদনা পরিলক্ষণ করেছেন – বলে মোদী জানান৷ তাঁর মতে মাদকের অপব্যবহার একটি ‘সাইকো-সোশ্যাল-মেডিকেল' সমস্যা এবং সেইভাবেই তার মোকাবিলা করা উচিত৷
বিশ্বের অদ্ভুত সব মাদক নিরাময় কেন্দ্র
আমাদের দেশে মাদকাসক্তি এখন বড় ধরনের সমস্যা৷ তবে মাদকাসক্তদের জন্য এখন বেশ কিছু নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে৷ কিন্তু সেগুলো এতটা অদ্ভুত হয়ত নয়৷ বিশ্বের অদ্ভুত কিছু মাদক নিরাময় কেন্দ্রের তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/R.Gul
থাইল্যান্ডের পুনর্বাসন কেন্দ্র
থাইল্যান্ডে ফ্রা পুত্থাবাতের কাছে থামক্রাবক মঠ৷ এখানে মাদকাসক্তদের ভিন্ন উপায়ে চিকিৎসা করা হয়৷ আধ্যাত্মিক ও প্রাকৃতিক উপায়ে মাদকাসক্তদের মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি এনে দেয়ার চেষ্টা করেন মঠের সন্ন্যাসীরা৷
ছবি: N.Asfouri/AFP/Getty Images
বমনের মাধ্যমে শুদ্ধি
এখানে সাধারণত মাদকাসক্তদের ১০দিনের একটি কর্মসূচিতে রাখা হয়৷ তবে এর মধ্যে বহির্বিশ্বের সাথে মোকাবিলা করার ক্ষমতা গড়ে না উঠলে আরো দীর্ঘ সময় সেখানে থাকতে পারেন তারা৷ ভোর বেলা প্রত্যেককে একটি পানীয় খেতে বাধ্য করা হয়, যার ফলাফল বমি৷ মঠের সন্ন্যাসীদের মতে পানীয়টি খুবই বাজে, কিন্তু কার্যকর৷ এছাড়া মঠ ছাড়ার আগে প্রতিটি অংশগ্রহণকারীকে অঙ্গীকার করতে হয় যে, সে আর কখনো মাদক ছুঁয়ে দেখবে না৷
ছবি: Getty Images/Paula Bronstein
আধ্যাত্মিক চেতনা
পেরুর আয়াহুয়াস্কা নিরাময় কেন্দ্রে প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ প্রাকৃতিক উপায়ে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির চিকিৎসা নিতে যান৷ সেখানকার আদিবাসীদের বিশ্বাস আয়াহুয়াস্কা প্রত্যেকের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি এনে দেয়৷ তবে পশ্চিমা চিকিৎসকদের মতে এ ধরনের চিকিৎসার ফলে ভয়ের স্মৃতি, বমি, প্রচুর ঘাম এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে৷ তাই বিশ্বের অনেক দেশে এখন আয়াহুয়াস্কা নিষিদ্ধ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V.Donev
ধর্মীয় পন্থা
ব্রাজিলের রিও ডি জানেরোর পুনর্বাসন কেন্দ্র এটি৷ এখানে আধ্যাত্মিক উপায়ে চিকিৎসা করা হয়৷ প্রতিদিন সকালে সব মাদকাসক্ত ব্যক্তি জড় হয়ে ঈশ্বরের বন্দনা করেন৷ প্রত্যেককেই একটি গির্জার পাশে থাকতে দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP/ F.Dana
শিকল বেঁধে চিকিৎসা
এই ব্যাক্তির নাম আমানউল্লাহ, যাকে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে জালালাবাদে একটি মাজারে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে৷ এখানে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা করা হয়৷ শিকল দিয়ে ৪০ দিন বেঁধে রাখা হয় তাদের৷ খেতে দেয়া হয় একটু রুটি, অল্প পানি আর একটু মরিচের গুড়া৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/R.Gul
আধ্যাত্মিক সাহায্য
মীর আলী বাবা, যাঁর নামে এই মাজার৷ স্থানীয়দের বিশ্বাস, মাদকাসক্তদের এখানে এভাবে বেধে রাখার ফলে আলী বাবা তাদের এই আসক্তি থেকে বের হতে সাহায্য করেন৷ এই ধারণা কেবল আফগানিস্তানেই নয় বিশ্বের অনেক স্থানে রয়েছে৷ কিছু স্থানে মাদকাসক্তদের শাস্তি দেয়া হয়, এমনকি হত্যা করাও হয়৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/R.Gul
শ্রমিক শিবির
চীনে মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন হয় জেলখানায়৷ কারাদণ্ড হওয়ার পর ঐ ব্যক্তিকে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়৷ কোকেইন, হেরোইন বা মারিজুয়ানা নিয়ে কেউ ধরা পড়লেও একই শাস্তি৷ তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, চীন মাদকাসক্তদের ক্লিনিকগুলোকে শ্রমিক ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে৷ অর্থাৎ তাদের দিয়ে নানা কাজ করিয়ে নেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Shenglian
মৃত্যু অভিজ্ঞতা
কিরঘিজস্তানে যে পুনর্বাসন পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয় তা ভয়াবহ৷ এটাকে বলা হয় ‘কোমা চিকিৎসা’৷ মাদকাসক্তদের একটি ইনজেকশন দেয়া হয় যার প্রভাবে তারা কয়েক ঘণ্টা কোমা’র মতো অবস্থায় থাকে৷ এরপর যখন তারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে তখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায় বলে বিশ্বাস সেখানকার মানুষের৷ বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর ব্যাপক সমালোচনা করেছেন৷
ছবি: picture alliance/Robert Harding World Imagery
বিলাসবহুল পন্থা
অনেক তারকারা মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে বিলাসবহুল পথ বেছে নেন৷ সবচেয়ে বিখ্যাত পদ্ধতিটি হয় অ্যামেরিকার বেটি ফোর্ড ক্লিনিকে৷ এখানে বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ও অভিনেতারা চিকিৎসা করান৷ এই ক্লিনিকে এমন কিছু সুযোগ সুবিধা থাকে যাতে আপনার মনে হবে আপনি একটি বিলাসবহুল হোটেলে আছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A.Rain
সবার চিকিৎসার সুযোগ নেই
বিশ্বের বেশিরভাগ মাদকাসক্তের চিকিৎসার সুবিধা নেই৷ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী, সে দেশের মাত্র ১০.৪ শতাংশ মাদকাসক্ত ব্যক্তি চিকিৎসার সুবিধা পান৷ গরীব দেশগুলোতে এ অবস্থা আরো শোচনীয়৷
ছবি: picture alliance/JOKER
10 ছবি1 | 10
এক্ষেত্রে নিউজ মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম যে ভূমিকা রেখেছে, প্রধানমন্ত্রী তার প্রশংসা করেন – অপরদিকে তিনি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের প্রতি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ‘ড্রাগ অ্যাবিউজ' সংক্রান্ত সচেতনতা প্রসারের অনুরোধ করেন৷ উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, কাশি থামানোর সিরাপের মতো ওষুধও ‘সময় কাটানোর ড্রাগ' হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে – তাঁর মতে এ ধরনের কাফ সিরাপও প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করা উচিত নয়৷ মাদক বিরোধী আন্দোলনে হ্যাশট্যাগ #ড্রাগ-ফ্রি-ইন্ডিয়া ব্যবহারের প্রস্তাব দেন মোদী৷
মাদক কেনার জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, তা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের পুঁজি যোগাতে পারে, বলে মোদীর আশঙ্কা৷ নভেম্বরের ৪ তারিখে তাঁর দ্বিতীয় জাতীয় বেতার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মাদক প্রসঙ্গে সকলের মতামত জানতে চেয়েছিলেন এবং এনজিও-দের প্রতি তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে অনুরোধ করেছিলেন৷ এবার তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কয়েকজন মাদকে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে এবং তার ফলে একটি পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে,'' এটাই হলো তাঁর উদ্বেগ৷
মাদক সেবনের সমস্যার প্রতিরোধের জন্য পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সমাজ, সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলাকে একযোগে কাজ করতে হবে, বলে মোদী অভিমত প্রকাশ করেন৷ তিনি জানান যে, তিনি সিনেমা, খেলাধুলা এবং সমাজজীবনের অপরাপর অংশের সেলেব্রিটিদের তাঁর এই ‘ড্রাগস-ফ্রি-ইন্ডিয়া' অভিযানে সংশ্লিষ্ট করার চেষ্টা করবেন৷ মোদীর দৃষ্টিকোণ থেকে ‘‘মাদকাসক্তি খারাপ হতে পারে, কিন্তু মাদকাসক্ত সন্তান নয়''৷