মস্তিষ্ককে চাঙ্গা করতে, সজাগ রাখতে মাদক বা ওষুধ খাওয়া উচিত কি? এর প্রবক্তরা ক্ষুদ্র পরিমাণে এমন পদার্থ সেবনের পরামর্শ দিলেও অনেক বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে অত্যন্ত সন্দিহান৷ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এড়াতে তাঁরা এসব এড়িয়ে চলার পক্ষে৷
বিজ্ঞাপন
মার্কিন শিল্পপতি পল অস্টিন তাঁর আকাঙ্ক্ষিত সমাধান খুঁজে পেয়েছেন৷ এলএসডি মাইক্রোডোজ নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস কম নয়৷ পল বলেন, ‘‘মাইক্রোডোজ নেওয়ার ৪৫ মিনিট পর খুব ভালো বোধ করছি, সহজেই হাসি পাচ্ছে, বাইরের জগতের সঙ্গে আদান-প্রদানের ইচ্ছা বাড়ছে৷ লেখার সময় সহজেই আইডিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি৷ সব মিলিয়ে জীবনে অনেক কিছু সহজ হয়ে উঠেছে৷''
ক্ষুদ্র কৌটোয় এলএসডি – ৬ থেকে ২০ মাইক্রোগ্রাম৷ এটুকু খেলে নাকি মগজ চাঙা হয়৷ গটলিব ডুটভাইলার ইনস্টিটিউটে এক ভাষণে পল অস্টিন এমনটাই দাবি করলেন৷ সেটা কি শুধু অ্যামেরিকান হুজুগ? সম্ভবত নয়৷ কারণ, দর্শকদের একাংশ মাইক্রোডোজিংয়ের আইডিয়া মোটেই উড়িয়ে দিতে প্রস্তুত নয়৷
মগজকে যাঁরা বেশি কাজে লাগাতে চান, তাঁদের কাছে এমন রাসায়নিক দ্রব্যের মূল্য কি সোনার মতো? মানুষ অবশ্য বেশ কিছুকাল ধরে মগজ তাজা করতে ট্যাবলেট খাচ্ছে৷
মাদক উৎপাদনে শীর্ষ কয়েকটি দেশ
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনওডিসি (ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম) সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষ মাদক উৎপাদনকারী দেশের একটি তালিকা তৈরি করেছে৷
ছবি: Abdelhak Senna/AFP/Getty Images
মিয়ানমার
আফিম উৎপাদনকারী দেশের তালিকার শীর্ষস্থান দখল করেছে মিয়ানমার। নানা কারণে আফগানিস্তানে আফিমের আবাদ কমে যাওয়ায় মিয়ানমার এই অবস্থানে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। ইউএনওডিসির প্রতিবেদন মতে, মিয়ানমারের আফিম চাষীরা এখন অন্য যেকোনো পণ্য চাষের তুলনায় গড়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি উপার্জন করছেন। দেশটিতে এখন প্রতি কেজি আফিম ৩৫৫ ডলারে বিক্রি হচ্ছে ।
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আফগানিস্তান
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আফিম চাষ হত আফগানিস্তানে৷ ২০২২ সালে তালেবান শাসক মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশটিতে আফিম চাষ ৯৫ শতাংশ কমে যায়।জাতিসংঘের হিসেবে, প্রতি বছর প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টন কাঁচা আফিম উৎপাদন হত সেখানে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
কলম্বিয়া
কোকেন উৎপাদনে বিশ্বে সেরা কলম্বিয়া৷ জাতিসংঘের হিসেবে কলম্বিয়ায় প্রতি বছর তিন থেকে চার’শ টন কোকেন উৎপাদিত হয়৷ এছাড়া পেরু ও বলিভিয়াতেও কোকেনের চাষ হয়৷ ল্যাটিন অ্যামেরিকা, উত্তর অ্যামেরিকা আর ইউরোপ কোকেনের সবচেয়ে বড় বাজার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মরক্কো
উত্তর আফ্রিকার মরক্কোতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় দেড় হাজার টন মারিজুয়ানা ও হাশিশ উৎপাদিত হয়৷ যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোতে সীমিত আকারে মারিজুয়ানা বা গাঁজার ব্যবহার বৈধ করায় এর চাষ আরও বেড়েছে৷
ছবি: Abdelhak Senna/AFP/Getty Images
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল
মাদক উৎপাদনে এশিয়ার তিন দেশ মিয়ানমার, লাওস আর থাইল্যান্ড ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ নামে পরিচিত৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই তিন দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় এক হাজার টন আফিম উৎপাদিত হয়৷
ছবি: AP
যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো
মেথাম্ফেটামিন বা ক্রিস্টাল মেথ হলো এক ধরণের মাদক, যেটা এক ধরণের সুখানুভূতি এনে দেয় বলে মনে করেন এর সেবনকারীরা৷ ইদানীং এই মাদক সেবনের হার বাড়ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ৷ তবে কোন দেশে এটা সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় তা জানা যায়নি৷ তবে ক্রিস্টাল মেথ ল্যাবেও তৈরি করা যায়৷ তাই সারা বিশ্বে পুলিশ এ ধরনের ল্যাবে অভিযান চালাচ্ছে৷ এ পর্যন্ত যত অভিযান হয়েছে, তার ৮০ ভাগই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর ল্যাবে৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
6 ছবি1 | 6
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিউরোএনহ্যান্সার বা মগজের উন্নতি করে এমন ওষুধের যাত্রা শুরু হয়েছিল৷ জার্মান সৈন্যদের জন্য বড় আকারে অ্যাম্ফিটামিন উৎপাদন করা হয়৷ বাজারে তার নাম ছিল পেরভিটিন৷ মানুষকে আরো সজাগ ও দক্ষ করে তোলাই ছিল তার উদ্দেশ্য৷ বেসমারিক জনগণও সেই ওষুধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে৷ এমনকি টফির মধ্যে অ্যাম্ফিটামিন ভরে বিক্রি শুরু হয়৷
কঠিন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণে সত্তরের দশকে সুইজারল্যান্ডে অ্যাম্ফিটামিনকে অ্যানেস্থেশিয়া সংক্রান্ত আইনের আওতায় আনা হয়েছিল৷
আজ মস্তিষ্কের ডোপিং করতে চাইলে অসংখ্য ওষুধ পাওয়া যায়৷ অ্যাম্ফিটামিন ও এলএসডি মাইক্রোডোজ ছাড়াও বিটাব্লকার বা মডাফিনিল ট্যাবলেট রয়েছে, যা আসলে নিদ্রাহীনতা কাটাতে প্রয়োগ করা হয়৷ এছাড়া রিটালিন অত্যন্ত জনপ্রিয়৷
বরিস কুয়েডনো-র মতো সাইকো-ফার্মাকোলজিস্ট মনে করেন, এক শতাংশেরও কম মানুষ নিয়মিত এমন ওষুধ খান৷ কারণ, সেগুলির প্রভাব সম্পর্কে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি এমন কোনো পদার্থ খেলে তার প্রভাবের মধ্যে সবসময়ে সংঘাত থেকে যায়৷ হয়তো আমার প্রেরণা, সজাগ থাকার ক্ষমতা বেড়ে যায়, অন্যদিকে আবার অন্য কিছু কগনিটিভ ক্ষমতার অবনতি ঘটে৷''
কোন মাদকের কারণে শরীরে কী ক্ষতি হয়?
বাংলাদেশে মাদকাসক্তি একটি বড় সমস্যা৷ মাদক হিসেবে একসময় ফেনসিডিল ও গাঁজার বেশ চল থাকলেও এখন সেই স্থান নিয়েছে ইয়াবা৷ এছাড়া আছে হেরোইন, আফিম, অ্যালকোহল, প্যাথিডিন ইত্যাদি৷
ছবি: bdnews24.com
ইয়াবা
বাংলাদেশে বর্তমানে মাদক হিসেবে এটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে৷ এর ফলে কিডনি, লিভার ও ফুসফস ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ সাময়িক যৌন উত্তেজনা বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়৷ এছাড়া ইয়াবার কারণে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/epa/Barbara Walton
ফেনসিডিল
একসময় এটিই প্রধান মাদক ছিল৷ ইয়াবা আসার পর ফেনসিডিলের ব্যবহার কিছুটা কমেছে৷ এটি খাওয়ার কারণে ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যায়৷ ফলে খাবার না খাওয়ায় শরীর পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না৷ এতে স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ ইয়াবার মতো ফেনসিডিলও যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়৷ এছাড়া শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
ছবি: bdnews24.com
গাঁজা
রক্তবাহী শিরার ক্ষতি করে, ফলে রক্ত পরিবহনে সমস্যা হয়৷ মস্তিষ্কের উপর প্রভাবের কারণে স্মৃতিশক্তির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়৷ তাছাড়া মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে৷ পুরুষের ক্ষেত্রে টেস্টিকুলার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ অনেকের ধারণা গাঁজা খেলে সৃজনশীলতা বাড়ে৷ তবে এটি ভুল বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে৷ গাঁজা খেলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়, চোখের দৃষ্টি কমে যায়৷
ছবি: AFP/Getty Images/F. K. Godhuly
হেরোইন
যারা অধিক পরিমাণে হেরোইন সেবন করেন তারা নানারকম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েন৷ যেমন লিভার সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ, তীব্র কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনি রোগ, হার্ট ও ত্বকে সমস্যা, হেপাটাইটিস, নারীদের সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, গর্ভপাত ইত্যাদি৷
ছবি: bdnews24.com
আফিম
আফিম খেলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, যা থেকে অবচেতন হয়ে পড়া এবং বেশি পরিমাণে খেলে মৃত্যুও হতে পারে৷ এছাড়া মুখ ও নাক শুকিয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি হতে পারে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Majeed
অ্যালকোহল
জার্মানির সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট ফর মেন্টাল হেল্থ-এর ফাল্ক কিফার বলেন, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ হয়ে জীবনের মূল্যবান বছরগুলি হারিয়ে যায়৷ লিভার সিরোসিস থেকে শুরু করে কর্মক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন অনেকে৷ ডাব্লিউএইচও-র রিপোর্ট বলছে, ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে ৩.৩ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন৷ এছাড়া ২০০টি নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হতে পারে অতিরিক্ত অ্যালকোহলের কারণে৷
ছবি: picture-alliance/empics/Y. Mok
6 ছবি1 | 6
কারণ, নিউরোএনহ্যান্সার জাতীয় ওষুধ মস্তিষ্কের কোষগুলির মধ্যে স্বাভাবিক যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করে৷ তারা নিউরোট্রান্সমিটারের চলাচল বদলে দেয়৷ স্নায়ুকোষগুলির মধ্যে স্পন্দনও প্রভাবিত হয়৷ নিউরোএনহ্যান্সারের প্রভাবের ফলে আরো বেশি সেমিওকেমিক্যাল সৃষ্টি হয়৷ এর ফলে মস্তিষ্কে কিছু ক্রিয়া বেড়ে যায় বটে, কিন্তু কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায়৷ বরিস কুয়েডনো বলেন, ‘‘ব্যক্তিগতভাবে আমি এলএসডি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেবো৷ এমনকি মাইক্রোডোজেও নিয়মিত খাওয়া উচিত নয়৷''
অর্থাৎ, মস্তিষ্কের জন্য আদর্শ রাসায়নিক পদার্থ এখনো স্বপ্নই থেকে গেছে৷ বরিস কুয়েডনোর মতো গবেষকরা তার বদলে এক কাপ কফি পান করার পরামর্শ দেন৷ এভাবেও টেকসই প্রক্রিয়ায় আমাদের কগনিটিভ ক্ষমতা বা বোধশক্তি বাড়তে পারে৷