1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ছাত্রীরাই রুখছে বাল্যবিবাহ

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২১ নভেম্বর ২০১৮

আঠারো পেরোনোর আগে মেয়েদের বিয়ে না দেওয়ার পক্ষে অনেক প্রচারই হয়েছে৷ কিন্তু গরিব দেশে সেসব আর শোনেন ক'জন? মাদ্রাসার মীনা মঞ্চের ছাত্রীরা এবার নিজেরাই রুখছে বাল্যবিবাহ৷

Westbengalen Meena Mancha
ছবি: DW/P. Samanta 

ইউনিসেফের কার্টুন চরিত্র মীনা দক্ষিণ এশিয়ায় তিন দশক ধরে দারুণ জনপ্রিয়৷ মীনার কাহিনি এখানকার মেয়েদের গল্পই তুলে ধরে৷ বছর পাঁচেক আগে সেই মীনার নামে মঞ্চ করেই একজোট হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসার ছাত্রীরা৷ স্কুলছুটদের ফিরিয়ে আনা, এলাকার সমস্যা ও কুসংস্কার দূর করা, এমন প্রচুর কাজের পাশাপাশি এখন মীনা মঞ্চের ছাত্রীরা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে

পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসাগুলিতে বাল্যবিবাহ রুখে মীনা মঞ্চ রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে৷ মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দুই ২৪ পরগনার পাশাপাশি হাওড়া, হুগলি ও কলকাতার বিভিন্ন মাদ্রাসায় মীনা মঞ্চ হয়েছে৷ মাদ্রাসাপিছু ২০-৩০ জন ছাত্রী নিয়ে একজন শিক্ষকের নেতৃত্বে এই দল গঠন করা হয়৷ ছাত্রীদের মধ্যে একজন নেতা থাকে৷ তার তদারকিতেই সব কাজ চলে৷ মীনা মঞ্চের বছরে ২-৩টি কর্মশালা হয়৷ ব্লকভিত্তিক বা জেলাভিত্তিক এই কর্মশালায় হাজির থাকেন ইউনিসেফের সদস্যরা৷

মুর্শিদাবাদের রানিনগর-২ ব্লকের কোমনগর হাই মাদ্রাসার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সান্তানুর আহ্সানিয়া তার দলের লিডার৷ পরীক্ষা চলাকালীনই ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সান্তানুর দৃপ্ত কন্ঠে বলছিল, ‘‘বাবা-মায়েরা মেয়েদের বোঝা ভাবেন৷ তাই তাড়াতাড়ি মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই খুশি হন৷''

‘আগের থেকে এখন সচেতনতা বেড়েছে’

This browser does not support the audio element.

এই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আব্দুল হালিমও ছাত্রীর সঙ্গে সহমত৷ তিনি বলেন, ‘‘বাল্যবিবাহ আটকাতে বহু ক্ষেত্রে বাবা-মা-কে ডেকে ডিজ্ঞেস করি, এত অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন কেন? একবার এক ছাত্রীর মা উত্তর দিয়েছিলেন, এ কি পোষার জিনিস! মানে ছাগল, মুরগি যেমন পোষা হয়, মেয়েটি তেমনই তাঁদের কাছে পোষ্য৷ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এমনই যে, সারাদিন খেটে এসে মেয়ের জন্য পাত্র দেখাটাও কষ্টকর৷ একটা ভালো পাত্র হাতছাড়া হলে আবার কতদিন অপেক্ষা করতে হবে!''

পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে কমপক্ষে ২৫ জনের বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে মীনা মঞ্চ৷ ২০১৭ সালে মালদহে ১৪ জন ও ২০১৬ সালে উত্তর ২৪ পরগনায় ২২ জনের বিয়ে রোখা সম্ভব হয়েছে৷ কীভাবে বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়া হয়? প্রমীলা বাহিনীর নেত্রী সান্তানুর বলে, ‘‘বাল্যবিবাহের খবর পেলে মীনা মঞ্চের সদস্যের নিয়ে বৈঠক করি প্রথমে৷ তারপর ছাত্রীটির বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ওদের বাড়িও যাই৷ বোঝাই, এখন মিড ডে মিল, ইউনিফর্ম দেওয়া হচ্ছে, স্কলারশিপ বা কন্যাশ্রী রয়েছে৷ আঠারোর পরে বিয়ে করলে রূপশ্রী রয়েছে৷ তাছাড়া অল্প বয়সে বিয়ে দিলে শারীরিকভাবে সমস্যায় পড়তে হয়৷''

বাল্যবিবাহ রোধের কাজ কেমন চলছে? ছাত্রীরা কি বিয়ে না হওয়ায় কষ্ট পায়? সান্তানুর বলে, ‘‘এই বছরই চারটে বিয়ে আটকেছি তো৷ বিয়ে না হলে ছাত্রীরা খুশিই হয়৷ তবে চারপাশে অনেকে আমাদের কথা শোনায়, সেটার পরোয়া করি না৷'' বাল্যবিবাহ রোধে কোমনগর মাদ্রাসার মীনা মঞ্চের সুগম কর্তা শবনম পারভেজ জানালেন, ‘‘বাড়িতে বাবা-মায়ের চাপে অনেকে বিয়েতে সম্মতি জানালেও আদতে বিয়ে ভেঙে গেলে তারাই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়৷'' তাঁর মতে, ‘‘মেয়েরা শিক্ষার গুরুত্ব বুঝছে৷ অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার কুফল চোখের সামনে দেখে তারা আরো বেশি সচেতন৷''                

‘পুলিশ ডেকে বরপক্ষকে অ্যারেস্ট করিয়েছি’

This browser does not support the audio element.

মীনা মঞ্চের প্রথমদিকের বাল্যবিবাহ রোধের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? শবনম জানালেন, অষ্টম শ্রেণির নাসরিন ইয়াসমিনের কথা৷ ১৩-১৪ বছরের মেয়ে নাসরিনের বিয়ের খবর পেয়ে মীনা মঞ্চের মেয়েরা তা ভেঙে দিয়েছিল৷ শবনম বলেন, ‘‘কিন্তু ক'দিন পরেই নাসরিনকে মামার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়৷ ৬ মাসের মধ্যে ডিভোর্স নিয়ে নাসরিন ফিরে আসে৷ এরপর নাসরিন মীনা মঞ্চের অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে যোগ দেয়৷ বর্তমানে নাসরিন অন্য মেয়েদের বাল্যবিবাহ ঠেকাতে নিজের প্রসঙ্গ তুলে ধরে৷''

শবনমের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এমন বহু অভিজ্ঞতা৷ ক্লাস সেভেনের আবেদা-সুবেদার কথাই ধরা যাক৷ রোগা-পাতলা এই দুই যমজ বোনের বিয়ে রুখতে একসময় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হয়েছিল৷ ১৪ বছর বয়সি অষ্টম শ্রেণির রাশিদা খাতুনবিয়ের কথা ভয়ে জানায়নি৷ ওর বন্ধুদের কাছ থেকে নাকি ব্যাপারটা জানা গিয়েছে৷ শবনম বলেন, ‘‘মীনা মঞ্চের মেয়েরা খুবই সক্রিয়৷ বিয়ের খবর ওরাই জোগাড় করে৷ এমনকি কোনো ছাত্রীর বাড়ির আশেপাশে ঘটক ঘোরাফেরা করতে দেখলেও তারা সন্দেহ শুরু করে৷''

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর ব্লকের নাইত সামসেরিয়া হাই মাদ্রাসা (উচ্চমাধ্যমিক)-এর প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান জানালেন, ‘‘কয়েকমাস আগে দশম শ্রেণির বাসেরুন খাতুনের বিয়েতে লেনদেন সবই ঠিক হয়ে গিয়েছিল৷ মীনা মঞ্চের মেয়েরা গিয়ে বিয়েতে বাধা দেয়৷ বিয়ে ভেঙে গেলেও পাত্রপক্ষ বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে৷ এদিকে মেয়েপক্ষও কিছু টাকা পাত্রপক্ষকে দিয়ে দিয়েছেন৷ তখন আমরা পাত্রপক্ষকে ডেকে টাকা দিতে বলেছি, নইলে আইনের সাহায্য নেবো, সে কথাও জানালাম৷ তখন পাত্রপক্ষ টাকা ফেরত দেয়৷ এমন ৮-১০ জনের বিয়ে আটকেছি মঞ্চের সাহায্যে৷''

মেয়েরাই বিয়ে রুখতে এগিয়ে আসছে

This browser does not support the audio element.

দশম শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষার্থী বাসেরুন খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলে, ‘‘১৮ বছরের আগে বিয়ে হওয়াটা ঠিক নয়৷ কিন্তু, ৪-৫ মাস আগে আমার বিয়ে ঠিক হয়৷ আমি দেখলাম, আমার ১৮ বছর হয়নি৷ তাই বন্ধুদের বলেছিলাম৷ তারাই স্যারদের বলেছিল৷ এখন আমি পড়াশুনোই করতে চাই৷''

কোমনগর মাদ্রাসায় ফের যোগ দিয়েছে ১৬ বছরের দিলরুবা খাতুনও৷ অক্টোবরের শুরুতে তার বিয়েটা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল৷ বিয়ের আগের রাতে বাজারে যাওয়ার অছিলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে দিলরুবা মীনা মঞ্চের ঘরে যায়৷ জানায়, সে বিয়ে করতে চায় না, পড়তে চায়৷ এরপর দল বেঁধে মঞ্চের মেয়েরা আসে তার বাড়িতে৷ দিলরুবার বাবাকে শেষমেশ মুচলেকা দিতে হয়৷ শবনম বলেন, ‘‘দিলরুবার বিয়েতে আত্মীয়-স্বজনরা চলেই এসেছিল৷ তারপরও বিয়ে বাতিল করেছে মঞ্চের মেয়েরা৷ যা করার সব মেয়েরাই করেছে৷'' সাহসী দিলরুবা মীনা মঞ্চের কর্মী৷ সে ডয়চে ভেলেকে বলল, ‘‘আমার নিজের বিয়ে আটকানোর পর আমি নিজে আরো তিনটে বিয়ে আটকেছি৷ এটাই আমাদের সাফল্য৷''

দিলরুবা তারই এলাকার রেজিনা খাতুন, বৈশালী খাতুন, হাসিনা খাতুনদেরবিয়ে আটকেছে এই কয়েকদিনের মধ্যে৷ দিলরুবা কীভাবে বন্ধ করল এই বিয়েগুলো? তার ভাষায়, ‘‘আমার মামাতো বোনের বিয়েটাও আটকে দিয়েছি৷ আমি প্রথমে বোঝালাম, সংসারের কী বুঝবে ওইটুকু মেয়ে৷ তারপরে মীনা মঞ্চের বন্ধুদের ডাকলাম৷ ভয়ও দেখিয়েছি, আমাদের কথা না শুনলে ওসিকে ডাকব বলেছি৷'' 

সান্তানুর এভাবেই আটকেছে মৌমিতা খাতুনের বিয়ে৷ তার ভাষায়, ‘‘মৌমিতার বিয়ের সব আয়োজন হয়ে গিয়েছিল৷ বরপক্ষও চলে এসেছিল৷ আমরা পরে জানতে পেরে ওখানে গেছি৷ তখন শুধু রেজিস্ট্রি করা বাকি ছিল৷ পুলিশ এসে বরপক্ষকেও অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়েছিল৷ মৌমিতা এরপর বিএ সেকেন্ড ইয়ার অবধি পড়েছে৷ তখন পড়তে পড়তেই ওর বিয়ে হয়েছে৷''

‘আমি তিনটে বিয়ে আটকেছ’

This browser does not support the audio element.

তবে রাজ্যে ৬১৫টি মাদ্রাসার সবগুলিতেই মীনা মঞ্চ গড়ে ওঠেনি৷ আবার মঞ্চ থাকলেই যে বিয়ে আটকানো গিয়েছে, তা-ও নয়৷ মীনা মঞ্চ বিয়ে আটকানোর পরেও যে লুকিয়ে বিয়ে হয় না, সেটাও বলা যায় না৷ শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানান, বিয়ে ভেস্তে দেওয়ার পরেও রাতের অন্ধকারে মাঠের মধ্যে বিয়ে হয়েছে৷ কখনো বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়েও বিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এ ব্যাপারে আগামী দিনে কী পরিকল্পনা? ইউনিসেফের আধিকারিক অমৃতা সেনগুপ্ত জানান, এখন সাতটি জেলায় মীনা মঞ্চ কাজ করছে৷ আরেকটি জেলা যোগ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে আরো বেশি সংখ্যায় পড়ুয়াদের এই অভিযানে যুক্ত করা সম্ভব হবে৷

মীনা মঞ্চ মানুষকে অনেকটা সচেতন করতে পেরেছে বলেই মনে করেন প্রধান শিক্ষক আবদুল হালিম৷ তাঁর মতে, ‘‘মুর্শিদাবাদের সীমান্ত এলাকায় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিটা না পাল্টালেও মীনা মঞ্চের কাজে চেতনা বাড়ছে৷'' শিক্ষক জিয়াউল রহমান বলেন, ‘‘সচেতনার প্রচণ্ড ঘাটতি ছিল৷ সবটা মিটেছে তা নয়, তবে অনেকটা উন্নতির দিকে৷ মেয়েরা বিয়ে আটকানোর পরে আবার পড়াশুনোর মূল স্রোতে ফিরে আসছে৷ কন্যাশ্রী যোদ্ধারা যে কাজ এখন করছে, সে কাজই মীনা মঞ্চ আগে থেকে করে আসছে৷ মীনা মঞ্চকে আরো প্রসারিত করলে আরো ভালো হবে৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ