বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে বর্ণনা দিয়ে নিজেরাই পোস্ট দিয়েছেন কেউ কেউ৷
বিজ্ঞাপন
মুসলিম অধ্যুষিত দেশটির মাদ্রাসাগুলোতে যৌন নির্যাতনের ঘটনা এর আগেও প্রকাশ পেয়েছে৷ গত এপ্রিলে এক মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক তার ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের পর পাশবিকভাবে হত্যা করেন৷ এরপর পরই এসব ঘটনা সামনে চলে আসছে৷
গত জুলাই মাসে পাঁচজন মাদ্রাসা শিক্ষককে তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১১ বছরের এক এতিমকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে আটক হন কয়েকজন শিক্ষার্থী৷ ১২ থেকে ১৯ বছর বয়সের ডজনখানেক ছেলেকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে একজন মাদ্রাসা শিক্ষককেও গ্রেপ্তার করা হয়৷
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মাদ্রাসাগুলোতে ধর্ষণ থেকে শুরু করে জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন করা হয়৷
শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রধান আবদুস শহীদ এএফপিকে বলেন, ‘‘বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় বছরের পর বছর ধরে তা প্রকাশ্যে আসেনি৷ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা শিশু সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠান, কিন্তু তারা এই অপরাধগুলো নিয়ে কথা বলেন না এটা ভেবে যে এতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি হবে৷’’
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা ও শিক্ষা
কওমি মাদ্রাসা বেসরকারি ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ ঢাকার কামরাঙ্গির চরে এমনই এক মাদ্রাসা জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া৷ সেখানে একটা গোটা দিন কাটিয়ে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার নানা দিক ক্যামেরায় তুলে ধরেছেন মুস্তাফিজ মামুন৷
ছবি: DW/M. Mamun
সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি
বাংলাদেশে প্রচলিত দু’ ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কওমি মাদ্রাসা একটি৷ উনিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার মাধ্যমে বাংলাদেশেও কওমি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হয়৷ দীর্ঘকাল ধরে কওমি মাদ্রাসা সরকারের আর্থিক সহায়তা ছাড়াই সাধারণ জনগণের সহায়তায় পরিচালিত হয়ে আসছিল৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে ইসলামি এ শিক্ষা ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/M. Mamun
১৪ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখেরও বেশি৷ তবে বেসরকারি হিসেব মতে, সারা দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাদ্রাসার একটি ক্লাসরুম
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিচালিত ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তরের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে আরবির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষাও দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
সহশিক্ষায় বাধা নেই শিশুদের
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষা স্বীকৃত নয়৷ তাই মহিলাদের শিক্ষার জন্য আলাদা কিছু প্রতিষ্ঠান আছে৷ তবে প্রাথমিক স্তরে শিশুদের সহশিক্ষার কোনো বাধা নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর একাংশ পরিচালিত হয় স্বতন্ত্র একটি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে৷ ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’ (বেফাক) নামের এই শিক্ষা বোর্ড কওমি মাদ্রাসার পরীক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ক্লাস হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সেশন পরিচালনা হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী৷ সাধারণত বেফাক আওতাধীন মাদ্রাসাগুলোর নতুন সেশন শুরু হয় আরবি ক্যালেন্ডারের শাওয়াল মাসের ১০ তারিখ থেকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়া ও শোয়ার জায়গা একটাই
ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এই কক্ষটি শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গাও৷ সাধারণত কওমি মাদ্রাসাগুলিতে পাঠদান এবং শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা একই হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্বক্ষণের সঙ্গী একজন শিক্ষক
কওমি মাদ্রাসার প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি একজন শিক্ষকও থাকেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
রুটিনমাফিক জীবন
কওমি মাদ্রাসাগুলো সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থায় পরিচালিত৷ তাই শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন রুটিনের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
উচ্চশিক্ষার সুযোগ
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ হিফজুল কোরান (বানানভেদে কোরআন)৷ এ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র পবিত্র কোরান শরীফ মুখস্থ করে থাকেন৷ তবে হিফজুল কোরান শেষ হলে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে অন্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষারো সুযোগ আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্ব্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিস
জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এটি কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ শ্রেণি৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার এই শ্রেণিকেই মাস্টার্স-এর সমমান বলে ঘোষণা করেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়াশোনার মূল মাধ্যম আরবি
কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের হাদিস সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত পড়ানো হয়৷ এ বিষয়ে পড়ানোর মূল মাধ্যম আরবি ভাষা৷ হাদিসের যথাযথ ব্যাখ্যা আরবি ভাষাতেই সম্ভব, এমনটাই মনে করা হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
আছে উর্দু এবং ফারসি ভাষাও
বাংলাদেশের কাওমি মাদ্রাসাগুলোয় প্রাথমিক স্তরে আরবির সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি পড়ানো হলেও উচ্চস্তরে আরবি ছাড়াও পড়ানো হয় উর্দু এবং ফারসি ভাষা৷
ছবি: DW/M. Mamun
গরিব ছাত্রদের জন্য ফ্রি খাবার
কওমি মাদ্রাসাগুলোয় গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে৷ তবে সামর্থবানদের থাকা ও খাওয়ার জন্য নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
মেঝেতেই খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা
শিক্ষা কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে টেবিল-চেয়ারের ব্যবহার নেই কওমি মাদ্রাসাগুলোয়৷ ইসলামি সুন্নত অনুসরণে পাঠদান কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সম্পন্ন হয় মেঝেতেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
15 ছবি1 | 15
ঢাকার তিনটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন হুজাইফা আল মামদুহ৷ গত জুলাইয়ে ফেসবুকে নিজেসহ অন্য মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রকাশ করে দেন তিনি৷ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মামদুহ বলেন, মাদ্রাসায় যারা পড়াশোনা করেছে তাদের সবাই এই যৌন নির্যাতন সম্পর্কে জানে৷
‘‘আমি জানি অনেক মাদ্রাসা শিক্ষক শিশুদের সঙ্গে যৌন মিলনকে বিবাহবহির্ভূত নারীদের সঙ্গে যৌন মিলনের থেকে কম অপরাধ বলে বিবেচনা করেন৷ যেহেতু তারা মাদ্রাসায় একই ছাত্রাবাসে থাকেন তাই তারা সহজেই তাদের অপরাধ আড়াল করতে পারেন এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের এ বিষয়গুলো চেপে রাখতে চাপ দেন৷’’
আল মামদুহের ফেসবুক পোস্টগুলো বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং এজন্য তাকে হুমকিও পেতে হয়েছিল৷ তাকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের এজেন্ট আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে মাদ্রাসার ভারমূর্তি ক্ষুন্নের অভিযোগ আনা হয়৷ একই সঙ্গে ২০১৫ সালে খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় তাকে৷
তবে ফেসবুকে মামদুহ মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতন নিয়ে খোলামেলাভাবে লেখার পর অন্যদেরও সেই নীরবতা ভাঙতে উৎসাহিত করে৷ মোস্তাকিম বিল্লাহ মাসুম একটি ওয়েবসাইটে লিখেছেন, সাত বছর বয়সে সে প্রথম তার মাদ্রাসার এক বড় ভাইয়ের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল৷
১৫ বছর বয়সি এই তরুণ এএফপিকে জানান, তার এক শিক্ষক তাকে অচেতন করে ধর্ষণ করেছিল৷ মাদ্রাসার অনেক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতন করার তথ্য তার কাছে রয়েছে৷