স্কুল-কলেজের পাশাপাশি মাদ্রাসাতেও জাতীয় সংগীত প্রতিযোগিতা আয়োজনের নির্দেশনাকে চ্যালেঞ্জ করা রিট নিয়ে আলোচনা চলছেই৷ রিট খারিজ করে আদালত অবশ্য জানিয়ে দিয়েছৈ, মাদ্রাসাতেও জাতীয় সংগীত গাইতে হবে৷
বিজ্ঞাপন
রিট করেছিলেন নুরুল ইসলাম নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক এবং দুই অভিভাবক৷ কিন্তু হাইকোর্ট ওই রিটটি ‘উত্থাপিত হয়নি' মর্মে খারিজ করে দিয়েছেন৷ ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংগীত গাইতে হবে এবং প্রতিযোগিতা আয়োজনের আদেশও তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর থাকবে৷
মঙ্গলবার (২৭ মার্চ) হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈতবেঞ্চে শুনানির সময় রিটকারী আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘‘আপনি দেখান, পবিত্র কোরআনের কোথায় আছে জাতীয় সংগীত গাওয়া যাবে না? পবিত্র কোরআনের কোথাও নেই যে, জাতীয় সংগীত গাওয়া যাবে না৷ আগে তো মাদ্রাসার সিলেবাসে অংক, ইংরেজি, বিজ্ঞান ছিল না৷ যুগের চাহিদা অনুযায়ী সেগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে৷''
আদালত আরো বলেন, ‘‘স্কুলের শিক্ষার্থীরা জাতীয় সংগীত গাইবে আর মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা গাইবে না, এটা তো হতে পারে না৷ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে গেলে যখন বিদেশিরা জাতীয় সংগীতের বিষয় জানতে চাইবে, তখন তারা কী জবাব দেবে?''
‘জাতীয় সংগীত গাওয়া ইসলাম বিরোধী এই বিচেনায় রিটটি করা হয়নি, রিটটি করা হয়েছিল আইন ও সংবিধান বিবেচনা করে’
আদালতের মন্তব্য, ‘‘ব্রিটিশ আমলে আমরা ইংরেজি না শিখে পিছিয়ে পড়েছিলাম৷ একইভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে দিতে এই ধরনের রিট করা হয়েছে৷''
রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন বিএনপি নেতা এবং আইনজীবী তৈমূর আলম খন্দকার৷ বুধবার ডয়চে ভেলেকে তিনি অবশ্য বলেন, ‘‘জাতীয় সংগীত গাওয়া ইসলামবিরোধী এই বিচেনায় রিটটি করা হয়নি৷ রিটটি করা হয়েছিল আইন ও সংবিধান বিবেচনা করে৷''
তিনি দাবি করেন, ‘‘ন্যাশনাল অ্যানথেম রুলের ৫(২) ধারায় স্কুলের কথা বলা আছে৷ অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ এবং ১৯৭৮-এ স্কুলের ডেফিনেশন দেয়া আছে৷ সেই ডেফিনেশনে বলা হয়েছে এনি এডুকেশন্যাল ইন্সটিটিউশন এক্সক্লুডিং মাদ্রাসা৷ আর মাদ্রাসার ডেফিনেশনে বলা আছে, ইসলামি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ সংবিধানের আর্টিকেল ৪১-এ বলা আছে যার যার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তার তার মতো চলতে পারবে৷ তাই মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া বাধ্যতামূলক করা আইনে কাভার করে না– এটাই আমরা রিটে বলেছি৷ জাতীয় সংগীতের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো কথা বা অবস্থান নাই৷ আমরা আইনগত বিষয়টি নিয়ে রিট করেছি৷ আদালত আমাদের রিট লিগ্যাল গ্রাউন্ডে খারিজ করেননি৷ আদালত বলেছেন, এখন মাদ্রাসায় ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও বিজ্ঞান, ইরেজি ও বাংলাসহ নানা বিষয় পড়ানো হয়৷ তাই এখন আর আগের অর্ডিন্যান্স ব্যাখ্যা আমলে না নিয়ে ‘উত্থাপিত হয়নি' মর্মে খারিজ করে দিয়েছেন৷''
‘আমাদের আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গায় এতে আমরা অসুবিধার কিছু দেখিনা’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘রিটকারী এখন প্রতিকার পেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন বরবেন৷ আমিও আইনজীবী হিসেবে তাঁদের সেই পরামর্শ দিয়েছি৷''
রিটকারী কুড়িগ্রামের সুখদেব ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম মিয়া ও ঢাকার কদমতলা মাদ্রাসার দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি৷ তবে ঢাকার কদমতলা দারুল ইসলাম আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গায়৷ এতে আমরা অসুবিধার কিছু দেখি না৷ তবে কওমি মাদ্রাসার চিত্র ভিন্ন হতে পারে৷ আমরা বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই জাতীয় সংগীত গাই৷ আর জাতীয় সংগীতে ইসলামবিরোধী কিছু নাই৷ দেশপ্রেমের কথা আছে৷ বাদ্যযন্ত্রের বিষয় থাকলে হয়তো আপত্তির জায়গা থাকতো৷''
‘অনেক আগে থেকেই কওমী মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়না আমরাও গাইনা,বোর্ড নির্দেশ দিলে গাইতে হবে’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘যাঁরা রিট করেছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন কেন তাঁরা জাতীয় সংগীতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন৷ আমার কথা হলো, আমরা স্বাধীন হয়েছি, স্বাধীন দেশে বসবাস করি৷ ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে তার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো কথা নাই৷''
কওমী শিক্ষাসনদ বাস্তবান পরিষদের আহ্বায়ক মুফতি আবুল কাসেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো এখন বোর্ডভুক্ত, তাই আমাদের এখন জাতীয় সংগীত গাইতে হবে৷ বোর্ডের যে নির্দেশ আসবে তা মানতে হবে৷ আর জাতীয় সংগীতের শব্দগুলো যদি খারাপ না হয়, তাহলে দোষের কী আছে?''
মুফতি আবুল কাসেশ আরো বলেন, ‘‘কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না৷ অনেক আগে থেকেই প্রচলন নাই, তাই আমরাও গাই না৷ কিন্তু এখন বোর্ড নির্দেশ দিলে তো গাইতে হবে৷''
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা ও শিক্ষা
কওমি মাদ্রাসা বেসরকারি ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ ঢাকার কামরাঙ্গির চরে এমনই এক মাদ্রাসা জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া৷ সেখানে একটা গোটা দিন কাটিয়ে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার নানা দিক ক্যামেরায় তুলে ধরেছেন মুস্তাফিজ মামুন৷
ছবি: DW/M. Mamun
সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি
বাংলাদেশে প্রচলিত দু’ ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কওমি মাদ্রাসা একটি৷ উনিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার মাধ্যমে বাংলাদেশেও কওমি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হয়৷ দীর্ঘকাল ধরে কওমি মাদ্রাসা সরকারের আর্থিক সহায়তা ছাড়াই সাধারণ জনগণের সহায়তায় পরিচালিত হয়ে আসছিল৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে ইসলামি এ শিক্ষা ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/M. Mamun
১৪ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখেরও বেশি৷ তবে বেসরকারি হিসেব মতে, সারা দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাদ্রাসার একটি ক্লাসরুম
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিচালিত ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তরের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে আরবির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষাও দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
সহশিক্ষায় বাধা নেই শিশুদের
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষা স্বীকৃত নয়৷ তাই মহিলাদের শিক্ষার জন্য আলাদা কিছু প্রতিষ্ঠান আছে৷ তবে প্রাথমিক স্তরে শিশুদের সহশিক্ষার কোনো বাধা নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর একাংশ পরিচালিত হয় স্বতন্ত্র একটি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে৷ ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’ (বেফাক) নামের এই শিক্ষা বোর্ড কওমি মাদ্রাসার পরীক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ক্লাস হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সেশন পরিচালনা হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী৷ সাধারণত বেফাক আওতাধীন মাদ্রাসাগুলোর নতুন সেশন শুরু হয় আরবি ক্যালেন্ডারের শাওয়াল মাসের ১০ তারিখ থেকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়া ও শোয়ার জায়গা একটাই
ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এই কক্ষটি শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গাও৷ সাধারণত কওমি মাদ্রাসাগুলিতে পাঠদান এবং শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা একই হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্বক্ষণের সঙ্গী একজন শিক্ষক
কওমি মাদ্রাসার প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি একজন শিক্ষকও থাকেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
রুটিনমাফিক জীবন
কওমি মাদ্রাসাগুলো সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থায় পরিচালিত৷ তাই শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন রুটিনের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
উচ্চশিক্ষার সুযোগ
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ হিফজুল কোরান (বানানভেদে কোরআন)৷ এ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র পবিত্র কোরান শরীফ মুখস্থ করে থাকেন৷ তবে হিফজুল কোরান শেষ হলে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে অন্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষারো সুযোগ আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্ব্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিস
জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এটি কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ শ্রেণি৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার এই শ্রেণিকেই মাস্টার্স-এর সমমান বলে ঘোষণা করেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়াশোনার মূল মাধ্যম আরবি
কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের হাদিস সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত পড়ানো হয়৷ এ বিষয়ে পড়ানোর মূল মাধ্যম আরবি ভাষা৷ হাদিসের যথাযথ ব্যাখ্যা আরবি ভাষাতেই সম্ভব, এমনটাই মনে করা হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
আছে উর্দু এবং ফারসি ভাষাও
বাংলাদেশের কাওমি মাদ্রাসাগুলোয় প্রাথমিক স্তরে আরবির সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি পড়ানো হলেও উচ্চস্তরে আরবি ছাড়াও পড়ানো হয় উর্দু এবং ফারসি ভাষা৷
ছবি: DW/M. Mamun
গরিব ছাত্রদের জন্য ফ্রি খাবার
কওমি মাদ্রাসাগুলোয় গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে৷ তবে সামর্থবানদের থাকা ও খাওয়ার জন্য নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
মেঝেতেই খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা
শিক্ষা কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে টেবিল-চেয়ারের ব্যবহার নেই কওমি মাদ্রাসাগুলোয়৷ ইসলামি সুন্নত অনুসরণে পাঠদান কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সম্পন্ন হয় মেঝেতেই৷