যৌন হয়রানির মামলা করায় ফেনীতে মাদ্রাসা ছাত্রীকে মাদ্রাসার ছাদেই আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে৷ মামলার আসামি মাদ্রাসা অধ্যক্ষ আগেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন৷ তার অনুগতরা হত্যাচেষ্টার সাথে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে৷
বিজ্ঞাপন
ঘটনা শনিবার সকালের৷ ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় সকাল ১০টায় আলিম পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ আগে ওই ঘটনা ঘটে৷ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সে পরীক্ষা দিতে গেলে হলে ঢোকার আগেই তার এক বন্ধবীকে তিনতলার ছাদে নির্যাতন করা হচ্ছে খবর দিয়ে সেখানে নেয়া হয়৷ ছাদে যাওয়ার পর ৪-৫জন বোরখা পড়া দুর্বৃত্ত তার শরীরের তরল দাহ্য পদার্থ (কেরোসিন) ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়৷
গুরুতর আহত ছাত্রীটিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে এসে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে৷ চিকিৎসকরা বলেছেন তার অবস্থা আশঙ্কাজনক৷ ডা. সামান্ত লাল সেন এই বিষয়ে বলেন, ‘‘তার চিকিৎসায় ৮ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেছি৷ আমরা তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন আছি৷ আশঙ্কায় আছি৷''
‘যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা ভিতরেই ছিল’
যৌন হয়রানির মামলাই কি কাল হলো?
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে আগে ধর্ষণ চেষ্টার মামলা করেছিল এই ছাত্রী৷ ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ তার কক্ষে ডেকে নিয়ে অনৈতিক প্রস্তাব দেন৷ তাকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগাম দেয়ার কথা বলেন৷ ছাত্রীটি এর প্রতিবাদ করলে তাকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করে৷ এই ঘটনায় ছাত্রীর মা মামলা দায়ের করলে পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে৷ সে এখন কারাগারে আছে৷
তবে, অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের মাঝে দু'টি গ্রুপ হয়ে যায়৷ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে৷ আরেকটি অংশ অধ্যক্ষের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করে৷ অভিযোগ আছে স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন৷ এছাড়া টেলিফোনেও হুমকি দেয়া হয়েছে৷
যৌন হয়রানি ও অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ছাত্রীর বড় ভাই তাকে মাদ্রাসায় দিয়ে আসতেন৷ কিন্তু শনিবার সে নিয়ে গেলেও তাকে মাদ্রাসার ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি৷
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা ও শিক্ষা
কওমি মাদ্রাসা বেসরকারি ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ ঢাকার কামরাঙ্গির চরে এমনই এক মাদ্রাসা জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া৷ সেখানে একটা গোটা দিন কাটিয়ে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার নানা দিক ক্যামেরায় তুলে ধরেছেন মুস্তাফিজ মামুন৷
ছবি: DW/M. Mamun
সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি
বাংলাদেশে প্রচলিত দু’ ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কওমি মাদ্রাসা একটি৷ উনিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার মাধ্যমে বাংলাদেশেও কওমি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হয়৷ দীর্ঘকাল ধরে কওমি মাদ্রাসা সরকারের আর্থিক সহায়তা ছাড়াই সাধারণ জনগণের সহায়তায় পরিচালিত হয়ে আসছিল৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে ইসলামি এ শিক্ষা ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/M. Mamun
১৪ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখেরও বেশি৷ তবে বেসরকারি হিসেব মতে, সারা দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাদ্রাসার একটি ক্লাসরুম
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিচালিত ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তরের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে আরবির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষাও দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
সহশিক্ষায় বাধা নেই শিশুদের
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষা স্বীকৃত নয়৷ তাই মহিলাদের শিক্ষার জন্য আলাদা কিছু প্রতিষ্ঠান আছে৷ তবে প্রাথমিক স্তরে শিশুদের সহশিক্ষার কোনো বাধা নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর একাংশ পরিচালিত হয় স্বতন্ত্র একটি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে৷ ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’ (বেফাক) নামের এই শিক্ষা বোর্ড কওমি মাদ্রাসার পরীক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ক্লাস হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সেশন পরিচালনা হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী৷ সাধারণত বেফাক আওতাধীন মাদ্রাসাগুলোর নতুন সেশন শুরু হয় আরবি ক্যালেন্ডারের শাওয়াল মাসের ১০ তারিখ থেকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়া ও শোয়ার জায়গা একটাই
ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এই কক্ষটি শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গাও৷ সাধারণত কওমি মাদ্রাসাগুলিতে পাঠদান এবং শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা একই হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্বক্ষণের সঙ্গী একজন শিক্ষক
কওমি মাদ্রাসার প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি একজন শিক্ষকও থাকেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
রুটিনমাফিক জীবন
কওমি মাদ্রাসাগুলো সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থায় পরিচালিত৷ তাই শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন রুটিনের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
উচ্চশিক্ষার সুযোগ
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ হিফজুল কোরান (বানানভেদে কোরআন)৷ এ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র পবিত্র কোরান শরীফ মুখস্থ করে থাকেন৷ তবে হিফজুল কোরান শেষ হলে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে অন্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষারো সুযোগ আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্ব্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিস
জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এটি কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ শ্রেণি৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার এই শ্রেণিকেই মাস্টার্স-এর সমমান বলে ঘোষণা করেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়াশোনার মূল মাধ্যম আরবি
কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের হাদিস সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত পড়ানো হয়৷ এ বিষয়ে পড়ানোর মূল মাধ্যম আরবি ভাষা৷ হাদিসের যথাযথ ব্যাখ্যা আরবি ভাষাতেই সম্ভব, এমনটাই মনে করা হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
আছে উর্দু এবং ফারসি ভাষাও
বাংলাদেশের কাওমি মাদ্রাসাগুলোয় প্রাথমিক স্তরে আরবির সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি পড়ানো হলেও উচ্চস্তরে আরবি ছাড়াও পড়ানো হয় উর্দু এবং ফারসি ভাষা৷
ছবি: DW/M. Mamun
গরিব ছাত্রদের জন্য ফ্রি খাবার
কওমি মাদ্রাসাগুলোয় গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে৷ তবে সামর্থবানদের থাকা ও খাওয়ার জন্য নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
মেঝেতেই খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা
শিক্ষা কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে টেবিল-চেয়ারের ব্যবহার নেই কওমি মাদ্রাসাগুলোয়৷ ইসলামি সুন্নত অনুসরণে পাঠদান কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সম্পন্ন হয় মেঝেতেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
15 ছবি1 | 15
আলোচিত মাদ্রাসাটি তিন তলা৷ সেখানে সহশিক্ষা প্রচলিত রয়েছে৷ রবিবার সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাদ্রাসাটি সুরক্ষিত৷ ঘটনার দিন গেটে পুলিশ ছিল তাই বাইরে থেকে কেউ গিয়ে ওই ছাত্রীটিকে আগুনে পুড়িয়েছে এমন আশঙ্কা কম৷ যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা ভিতরেই ছিল৷ তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা ছাদে গিয়ে আর কাউকে পায়নি৷ অথবা কাউকে দৌড়ে পলাতে দেখেনি৷ ঘটনাটি পূর্ব পরিকিল্পিতই মনে হচ্ছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ব্যবস্থা কমিটিতে থাকা আওয়ামী লীগের দু'টি গ্রুপ দুই দিকে অবস্থান নেয়৷ তারাই মিছিল পাল্টা মিছিল করেছিল৷ অধ্যক্ষ আগে জামায়াত করতেন৷ নানা অভিযোগে জামায়াত তাকে বহিস্কার করার পর আওয়ামী লীগের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সহায়তায় তিনি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল পদে টিকে আছেন৷''
ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত
এদিকে, সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখনো পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা হয়নি৷ তবে আমরা ২ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছি৷ তারা পুরুষ, তারা এর আগে ছাত্রীটিকে হুমকি দিয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত হতে পারে৷ আর এখানে বাইরে থেকে কেনো লোক আসার তেমন সুযোগ নেই৷ আমরা চেষ্টা করছি জড়িতদের চিহ্নিত এবং আটক করতে৷''
আহত হওয়ার পর অবশ্য ওই ছাত্রী এম্বুলেন্সে একটি বক্তব্য দিয়েছে৷ সেই বক্তবের অডিও ডয়চে ভেলের হাতেও এসেছে৷ তাতেই ওই ছাত্রী বলেছেন, ‘‘সকালে আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষায় অংশ নিতে মাদ্রাসায় যাই৷ মাদ্রাসায় পৌঁছলে এক ছাত্রী আমার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের উপর কেউ মারছে বলে ডেকে নেয়৷ সেখানে আরও চার-পাঁচজন মুখোশধারী ছাত্রী ছিলেন৷ তারা বলেন, প্রিন্সিপালের উপর যে অভিযোগ করেছিস তা মিথ্যা, বল৷ আমি বলি না, আমি যা বলেছি সব সত্যি৷ তারা বলে, তোকে এখনই মেরে ফেলবো৷ আমরা তোর সব খবর নিছি৷
‘এখনো পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা হয়নি’
অডিও রেকর্ডে ও শিক্ষার্থী আরো বলেন, ‘‘আমি বলি, আমি সব সত্য বলেছি৷ আমি শিক্ষকদের সম্মান করি, কিন্তু যে শিক্ষক আমার গায়ে হাত দিয়েছে আমি তার প্রতিবাদ করেছি৷ সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার হাত-পা চেপে ধরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়৷''
উল্লেখ্য, ঢাকায় হাসপাতালে ওই ছাত্রীর বাবা-মা এবং দুই ভাই রয়েছেন৷ তবে তারা মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত যে তাদের সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও বিস্তারিত কথা বলা যায়নি৷ তার ছোটভাই রাশেদুল হাসান রায়হান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার অপার অবস্থা খুবই খারাপ, আশঙ্কাজনক৷ তার শেষ পর্যন্ত কি হয় জানিনা৷''