স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী নানা অপরাধে জড়িত থাকায় গফরগাঁও ও ভালুকার তিন আসামিকে আমৃত্যু এবং পাঁচ আসামিকে ২০ বছর করে কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করে যুদ্ধাপরাধ আদালত৷
বিজ্ঞাপন
নয় আসামির মধ্যে এই মামলায় একজনকে খালাস দেওয়া হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৪২টি মামলার ১১৪ জন আসামির মধ্যে এই প্রথম কেউ বেকসুর খালাস পেলেন৷
বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়৷ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার৷
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আসামিরা রাজাকার বাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে ময়মনসিংহের বিভিন্ন গ্রামে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মত অপরাধের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে এ মামলা করা হয়৷
যেমন করে রাজাকার নামটি ঘৃণিত হলো
রাজাকার বাংলাদেশে এখন এক ঘৃণিত শব্দ৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে এই বাহিনী গঠন করেছিল পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার৷ পরবর্তীতে তারা হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷
ছবি: DW/M. Mamun
শব্দটি যেভাবে এল
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী রাজাকার ফারসি শব্দ৷ যার অর্থ স্বেচ্ছাসেবী৷ ১৯৪০ এর দশকে ভারতের হায়দ্রাবাদের নিজাম ওসমান আলী খানের শাসনামলে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন কাসেম রিজভী৷ এই বাহিনীর নাম দেয়া হয়েছিল রাজাকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Desfor
পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনী
হায়দ্রাবাদের সেই সশস্ত্র বাহিনীর অনুকরণেই ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার৷ মে মাসে খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন কর্মী নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়৷ ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মো. ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়৷ শুরুতে ১০টি জেলায় ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাদের রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
শান্তি কমিটি থেকে সেনাবাহিনী
বাংলাপিডিয়া বলছে, ‘‘প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন৷ ১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন৷ এর নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে৷ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত অধ্যাদেশে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনী সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়৷’’
ছবি: AP
প্রশিক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন৷ ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় এই বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়৷ ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে সাভারে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন জেনারেল এ.কে নিয়াজি৷ পরবর্তী পর্যায়ে এই বাহিনীকে একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদা দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
রাজাকারের সংখ্যা
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস এর গবেষণা অনুযায়ী রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো৷ জেনারেল নিয়াজী তার বইতে এই সংখ্যা উল্লেখ করেছেন৷ স্বাধীনতার পর রাজাকারদের বিচারে ৩৭ হাজার জনের একটি তালিকা করা হয় বলে জানা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
‘দুষ্কৃতকারী’ নিধন
পাকিস্তানপন্থী পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হত ভারতীয় চর, দুষ্কৃতকারী হিসেবে৷ ‘রাজাকররা ৭০ জন দুষ্কৃতকারী হত্যা করেছে’, ‘ভারতীয় চরকে নির্মূল করেছে’, এমন শিরোনামে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় গ্রামে-গঞ্জে অত্যাচার, নির্যাতন এবং সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী পথপ্রদর্শক৷’’
ছবি: Adnan Sadeque
আলবদরের সঙ্গে পার্থক্য
সেপ্টেম্বরে নিয়াজী গড়ে তোলেন আরেকটি আধা সামরিক বাহিনী আলবদর৷ বাংলাপিডিয়ায় মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘‘রাজাকারদের কার্যকলাপের সঙ্গে খানিকটা পার্থক্য ছিল আল-বদর বাহিনীর৷ রাজাকাররা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতা করেছে৷ কিন্তু আল-বদর বাহিনীর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক হত্যার মাধ্যমে নিরীহ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা৷ পাকিস্তান বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করা ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য৷’’
ছবি: Journey/A. Hoque
‘তুই রাজাকার’
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক বহুব্রীহি৷ সেখানে একটি টিয়া পাখিকে ‘তুই রাজাকার’ বলতে শোনা যায়৷ এই সংলাপ পরবর্তীতে রূপ নেয় রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের স্লোগানে৷ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতেও ব্যবহার হয়েছে এই শব্দগুচ্ছ৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press
8 ছবি1 | 8
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলা পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন, জাহিদ ইমাম, তাপস কান্তি বল ও রেজিয়া সুলতানা চমন৷ আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান৷
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৪২টি মামলার ১১১৪ জন আসামির মধ্যে আটজন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন৷ মোট ১০৩ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৬৮ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে৷
আসামিদেরকারকীরায়
কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে মো. শামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালামকে ১ ও ৪ নম্বর অভিযোগে এবং পলাতক এ এফ এম ফয়জুল্লাহ ও আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডলকে চারটি অভিযোগের সবগুলোতেই আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷
আর কারাগারে থাকা মো. খলিলুর রহমান মীরকে ১ ও ৪ নম্বর অভিযোগে; মো. আব্দুল্লাহকে ১ নম্বর অভিযোগে, মো. রইছ উদ্দিন আজাদী ওরফে আক্কেল আলীকে ১, ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে এবং পলাতক সিরাজুল ইসলাম তোতাকে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে; আলিম উদ্দিন খানকে ১, ২ ও ৩ নম্বরে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল৷
এ মামলায় অভিযুক্ত আসামি আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল৷