গোলাম আযমের মামলার রায়ে শাস্তির অংশ ছাড়া আর সব কিছুকেই ঐতিহাসিক বলছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটররা৷ এই রায়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের রাষ্ট্রীয় কোনো পদে আসীন না করার কথাও বলা হয়েছে৷ আর জামায়াতকে বলা হয়েছে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন৷
বিজ্ঞাপন
জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ৷ গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি না হয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডে হতাশ হলেও তিনি বলেন, এই রায়ের কিছু ঐতিহাসিক দিক আছে৷ তাঁর কথায়, ট্রাইব্যুনাল-১-এর এই রায়ের মধ্য দিয়ে একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ আর গোলাম আযম এই গণহত্যার বে-সামরিক প্রধান বা ‘মাস্টার মাইন্ড'৷ তিনিই ছিলেন এর সুপিরিয়র কমান্ড৷ এছাড়া, জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কাজ করেছে৷ সেই জামায়াতের পূর্ব-পাকিস্তানের নেতৃত্বে ছিলেন গোলাম আযম৷
তুরিন আফরোজ জানান, আদালত তার রায়ে এসব কথা স্পষ্ট করেই বলেছে৷ শুধু তাই নয়, আদালত বলেছে যে জামায়াতে ইসলামী এবং তার নেতা গোলাম আযম একাত্তরের পরও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকা থেকে সরে আসেনি৷ আদালত আরো জানায়, কোনো সরকারি পদে যেন মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আসীন না হতে পারে, তার দায়িত্ব সরকারের৷ তাই সরকারেরই এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে৷
গোলাম আযমের শাস্তি, প্রাণহানি
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১৷ তবে এই রায়ে সন্তুষ্ট নয় সাধারণ জনতা৷ এই নিয়ে সংঘর্ষে কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
আমৃত্যু কারাদণ্ড
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে – একথা উল্লেখ করে সোমবার (১৫.০৭.১৩) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছে, ‘‘তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের৷ তবে আযমের বয়স এবং অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে তাকে আমৃত্যু কারাগারে রাখার জন্য ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, সেই যুদ্ধে তিন থেকে পাঁচ লাখ প্রাণহানি হয়৷ তবে বাংলাদেশের দাবি, মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ এবং সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দুই লাখের মতো বাংলাদেশি নারীকে ধর্ষণ করেছিল৷
ছবি: AP
সন্ত্রাসী সংগঠন ‘‘জামায়াতে ইসলামী’’
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সোমবার দেওয়া রায়ে তার দল জামায়াতে ইসলামীকে ‘‘সন্ত্রাসী সংগঠন’’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আদালত৷ রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘গোলাম আযম একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই সংগঠনের প্রধান ছিলেন৷ তার নির্দেশে এবং পরিকল্পনাতেই একাত্তরে বাংলাদেশে হত্যা, ধর্ষণ এবং লুটতরাজসহ মানবতাবিরোধী অপরাধগুলি সংঘটিত হয়৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
‘‘তার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য ছিল’’
এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক মুনতাসির মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আদালত বলেছে তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের৷ তাই তার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য ছিল৷’’ অন্যদিকে বীরাঙ্গনা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনী রায় শুনে পুরোপুরি হতাশ৷ তিনি বলেন, ‘‘মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো শাস্তি নেই গোলাম আযমের জন্য৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
নিহত কমপক্ষে তিন
সোমবার (১৫.০৭.১৩) গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার দিন স্থানীয় সময় বিকেল ছয়টা পর্যন্ত কমপক্ষে তিন ব্যক্তি নিহত হয়েছে৷ বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের বরাতে ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ‘‘কুষ্টিয়ায় রাস্তা ব্লক করার চেষ্টার সময় গণপিটুনিতে প্রাণ হারায় দুই জামায়াতে ইসলামী কর্মী৷ এছাড়া চাপাইনবাবগঞ্জে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় আরেক ব্যক্তি৷’’ (ফাইল ফটো)
ছবি: Reuters
সন্তুষ্ট আওয়ামী লীগ
গোলাম আযমের ৯০ বছর কারাদণ্ড হওয়ায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকার এই রায়ে সন্তুষ্ট৷ আদালত স্বাধীনভাবে রায় দিয়েছে৷’’
ছবি: Harun Ur Rashid Swapan
আপিলের ঘোষণা
তবে গোলাম আযমের আইনজীবীদের একজন তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, এই রায় ন্যায়ভ্রষ্ট এবং আবেগতাড়িত৷ তাই এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ আদালতের রায়ে একাত্তরে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলারও সমালোচনা করেছেন তাজুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘আদালত তার আওতার বাইরে গিয়ে এই মন্তব্য করেছে৷’’
ছবি: Harun Ur Rashid Swapan
সজাগ গণজাগরণ মঞ্চ
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ গোলাম আযমের বিপক্ষে দেওয়া আদালতের রায় প্রত্যাখ্যান করেছে৷ তাদের দাবি, গোলাম আযমকে ফাঁসি দিতে হবে৷ এই দাবি নিয়ে সোমবার আবারো শাহবাগে সমাবেত হয়েছেন অনেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড়
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে৷ প্রতিবাদ গোলাম আযমের শাস্তি হওয়ায় নয়, বরং তার ফাঁসির আদেশ না হওয়ায়৷ ডয়চে ভেলের ফেসবুক পাতায় রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আহসান টিটু লিখেছেন, ‘‘এক কথায় খুশি না! ফাঁসি চাই৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
তুরিন আফরোজ বলেন, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ার পরও আদালত তার বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে৷ কিন্তু ১৯৭৩ সালের মানবতাবিরোধী আইনে কোনো আসামির বর্তমান বয়স এবং শারীরিক অবস্থাসহ কোনো ধরনের প্রেক্ষিত বিবেচনায় নেয়ার সুযোগ নেই৷ শুধু মাত্র তিনি যে সময়ে অপরাধ করেছেন, সেই সময়ের অবস্থাকেই বিচেনায় নেয়া যায়৷ তাই এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে৷
তিনি বলেন, এই রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে আদালত সন্ত্রাসী সংগঠন বলায় দল হিসেবে জামায়াতেরও বিচারের সুযোগ তৈরি হয়েছে৷ সেই দিকটিও বিবেচনা করছেন তারা৷
তবে তুরিন আফরোজ মনে করেন, গোলাম আযম এবং তার দল একাত্তরের পরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছে তার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের সুযোগ আছে৷ এই সব অপরাধের কথা রায়েও রায়েছে৷ তাই তুরিন আফরোজের ধারণা, শুধু হতাশ না হয়ে আরো বড় আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হবে৷
এদিকে, এই রায়ের প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চ ও জামায়াতে ইসলামী মঙ্গলবার ঢাকাসহ সারা দেশে পাল্টা-পাল্টি হরতাল ডেকেছে৷ গণজারণ মঞ্চ হরতাল ডেকেছে গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি, মানে মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে৷ আর জামায়াত হরতাল ডেকেছে গোলাম আযমের মুক্তির দাবিতে৷