মাদক ও অস্ত্র পাচারের পর তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবসা মানবপাচার৷ এশিয়ায় এই ব্যবসার একটা বড় ঘাঁটি ভারত৷ নারীপাচার রোধে সক্রিয় শক্তি-বাহিনীর এনজিও-র সভাপতি রবিকান্তের সাক্ষাৎকারে উঠে এলো পাচার হওয়া মেয়েদের যন্ত্রণাদগ্ধ কাহিনি৷
বিজ্ঞাপন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে, গত বছরই ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাচার হয় প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ছেলে-মেয়ে৷ এখানে প্রতি ১০ মিনিটে একটি ছেলে বা মেয়ে নিখোঁজ হয়, যার ৮০ শতাংশই নাবালিকা বা সদ্য সাবালিকা মেয়ে৷ কারণ, চাহিদার দিক থেকে এদের বাজার মূল্য আকাশছোঁয়া৷ পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাচার করা ১৩ বছরের এক নাবালিকাকে উদ্ধার করে দিল্লির নারী কমিশন এবং ‘শক্তি-বাহিনী' নামের একটি বেসরকারি সাহায্য সংগঠন বা এনজিও৷ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটি গত এক মাস ধরে দিল্লির এক হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আছেন৷ নাম গোপন রেখে মেয়েটি তাঁর ছোট্ট জীবনে হিংস্র যৌন নির্যাতনের মর্মান্তিক কাহিনি শোনান৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাত্কারে সেই যন্ত্রণাদগ্ধ কাহিনিরই কিছুটা শোনালেন শক্তি-বাহিনীর প্রেসিডেন্ট রবিকান্ত৷
মেয়েটি বলেছে, এক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক গ্রাম থেকে পাচারকারীরা তাঁকে দিল্লিতে আনে৷ তারপর থেকে লাগাতার তাঁকে ধর্ষণ করে ১৮ থেকে ৮০ বছর বয়সের জনা কুড়ি লোক৷ এমনভাবে তাঁকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন চালায় তারা যে, পালাবার বা প্রতিবাদ করার শক্তিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে মেয়েটি৷ দিনে এক-দু'বার নয়, অনেকসময় পাঁচবার করেও তাঁকে ধর্ষণ করা হয়৷
ভারতের নিখোঁজ শিশুরা
বছরের পর বছর ভারতে হাজারো শিশু নিখোঁজ হওয়ার খবর শোনা যায়, যাদের অনেকেরই আর কোনো খোঁজই পাওয়া যায় না৷ এদের কেউ নিজেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, আবার কাউকে অপহরণ করে নানা রকম কাজ করতে বাধ্য করা হয়৷
ছবি: DW/B. Das
ভাগ্যের লিখন
ভারতে ‘শিশু বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের একটি সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে যে, ভারতে প্রতি ঘণ্টায় ১১ জন শিশু নিখোঁজ হয়ে থাকে৷ এদের মধ্যে কমপক্ষে চারজনকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না৷
ছবি: DW/B. Das
বন্দিদশা
দিল্লির একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ১৬ বছর বয়সি মেয়ে পিংকিকে খুঁজে পাওয়া গেছে অপরিচিত একটি বাড়িতে৷ সেখানে ওকে জোর করে ঘরের কাজ করানো হচ্ছে এবং বলা বাহুল্য, কোনো বেতন ছাড়াই৷
ছবি: DW/B. Das
দেশব্যাপী অনুসন্ধান
ছবিটিতে এক বাবার হাতে তাঁর হারিয়ে যাওয়া ছেলের ছবি আর তাঁর অন্য হাতে একটি বাক্স৷ সে বাক্সে রয়েছে মানুষের সাহায্য করা অর্থ, যে অর্থ দিয়ে এই বাবা তাঁর ছেলেকে খুঁজে বের করতে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাবেন বলে ঠিক করেছেন৷
ছবি: DW/B. Das
পালিয়ে যায়
যেসব শিশুরা বাড়ি থেকে নিজের ইচ্ছায় চলে যায় বা পালিয়ে যায়, ওরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে কাজের ছেলে-মেয়ে হিসেবে বা এ ধরণেরই কোনো কাজ করে থাকে৷ যেমন চায়ের দোকান, পেট্রোল পাম্প বা কার্পেট তৈরি কারখানায়৷ ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লির একটি পেট্রোল পাম্প থেকে এমনই কিছু শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ৷
ছবি: DW/B. Das
ধৈর্য ধরে থাকা
ছেলেটির হাতে ছয় বছর আগে ওর হারিয়ে যাওয়া বোনদের ছবি৷ ওদের খুঁজে পাবে এই আশায় এখনো বুক বেধে আছে ছেলেটির পুরো পরিবার৷ নিখোঁজ বোনদের ফিরে পাওয়ার জন্য পরিবার থেকে মাঝে মাঝেই বোনদের ছবি এবং নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিসহ প্রচারপত্র বিলি করা হয়৷
ছবি: DW/B. Das
দীর্ঘ প্রতিক্ষা
নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এই শিশুটিকে খুঁজে পাওয়া গেছে অবশেষে৷ শিশুটি ওর বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ঠিক এ জায়গাতেই অপেক্ষা করছে গত প্রায় এক বছর যাবত৷ কবে শেষ হবে এই অপেক্ষার পালা?
ছবি: DW/B. Das
খুশির দিন ফিরে এসেছে
নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অর্জুন আবারো মায়ের কোলে ফিরে এসে অত্যন্ত আনন্দিত, ভীষণ খুশি৷ অর্জুন ওর মাকে তার কষ্টের কথা জানিয়েছে৷ বলেছে, গত দু’বছর ওকে বেধে রাখা হয়েছিল এবং কাজ করতে বাধ্যও করা হয়েছিল৷ তবে ওর মা কিন্তু অর্জুনকে ফিরে পাবার আশা কখনো ছেড়ে দেয়নি৷
ছবি: DW/B. Das
অতিরিক্ত সাবধানতা
এই মা তাঁর কয়েকজন শিশুর মধ্যে একজনকে হারিয়েছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘আর কখনো আমি আমার শিশুদের চোখের আড়াল হতে দেব না৷ উল্লেখ্য, ‘শিশু বাঁচাও আন্দোলন’ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে www.bba.org.in ঠিকানায়৷
ছবি: DW/B. Das
8 ছবি1 | 8
রবিকান্তের কথায়, বাড়ির কথা তুলতেই মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে৷ তারপর কিছুক্ষণ শ্বাস নেবার পর জানায় যে, প্রতি সপ্তাহে তাঁকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেলা হতো, পাছে পুলিশ ধরতে না পারে৷ শেষে মেট্রো করে দিল্লির অদূরে ফরিদাবাদে এক খরিদ্দারের কাছে নিয়ে যাবার পথে হারিয়ে যায় মেয়েটি৷ এরপরই দিল্লির মহিলা কমিশন এবং শক্তি-বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে৷ ততদিনে ক্রমাগত যৌন নির্যাতনে নাবালিকা মেয়েটির শরীর ক্ষতবিক্ষত, ঘা-ও হয়ে গেছে নানা জায়গায়৷ এমনকি এইডস সংক্রমণের আশঙ্কাও রয়েছে৷ রবিকান্ত জানান, পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্তে তেমন গা না করলেও, শেষ৷ পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বে শক্তি-বাহিনীই মূল অপরাধী আসলামকে ধরতে সক্ষম হয়৷
অবশ্য শুধু এই মেয়েটি-ই নন, শক্তিবাহিনীর প্রেসিডেন্ট রবিকান্ত ডয়চে ভেলেকে ঝাড়খন্ড থেকে পাচার হওয়া ১১ বছরের এক নাবালিকার হৃদয় মোচড়ানো গল্প-ও বলেন ডয়চে ভেলেকে৷ সেই মেয়েটিকেও উদ্ধার করে এই শক্তিবাহিনী৷ রবিকান্ত বলেন, এই অপরাধ চক্রের হাত অনেক লম্বা৷ তাছাড়া ওপর মহলের সঙ্গে বেশ ভালো রকম যোগসাজস আছে এই চক্রের৷ কাকে, কোথায়, কিভাবে ‘সাপ্লাই' করতে হবে – সে'সব ‘প্ল্যান' আগে থেকেই তৈরি থাকে৷ সুধু তাই নয়, বিক্রি করার আগে মেয়েদের চুটিয়ে ভোগ করে নেয় দালালরা৷ এরপর খরিদ্দাররা তো আছেই৷ বাজারে স্বভাবতই মেয়েদের চাহিদা বিরাট৷ দামও পাওয়া যায় ভালো৷ অপহৃত বা পাচার করা মেয়েদের জায়গা হয় শুধু গণিকা পল্লিতেই নয়, তার বাইরেও হয়৷ আর সেটা হয় ইন্টারনেট ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে৷ অন্যদিকে নাবালক ছেলেরা বিক্রি হয়ে যায় বেগার শ্রমিক হিসেবে কোনো এক বিপজ্জনক পেশায়৷
অ্যাসিড সন্ত্রাস!
একটা সময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসতো নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর৷ এমন বর্বরোচিত হামলা এখনও হয় কিছু দেশে৷ কয়েকটি দেশ ঘুরে জার্মান ফটোগ্রাফার অ্যান-ক্রিস্টিন ভোর্ল-এর তোলা ছবি নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Griebeler
বাংলাদেশের ফরিদা
ফরিদার স্বামী ছিলেন ড্রাগ এবং জুয়ায় আসক্ত৷ ঋণের দায়ে একসময় বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় নেশাগ্রস্ত লোকটি৷ রেগেমেগে ফরিদা বলেছিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করবেন না৷ সেই রাতেই হলো সর্বনাশ৷ ঘুমন্ত ফরিদার ওপর অ্যাসিড ঢেলে দরজা বন্ধ করে দিল পাষণ্ড স্বামী৷ যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন ফরিদা৷ প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তাঁকে৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
মায়ের স্নেহে, বোনের আদরে...
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার সময় ফরিদা ছিলেন ২৪ বছরের তরুণী৷ ১৭টি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা সুস্থ৷ তবে সারা গায়ে রয়েছে দগদগে ঘায়ের চিহ্ন৷ পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোর ত্বক মসৃণ রাখতে প্রতিদিন মালিশ করে দেন মা৷ নিজের কোনো বাড়ি নেই বলে মায়ের সাথেই বোনের বাড়িতে থাকেন ফরিদা৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
উগান্ডার ফ্লাভিয়া
ফ্লাভিয়ার ওপর এক আগন্তুক অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ৫ বছর আগে৷ আজও ফ্লাভিয়া জানেন না, কে, কেন তাঁর ওপর হামলা চালালো৷ বিকৃত চেহারা নিয়ে অনেকদিন ঘরেই ছিলেন৷ বাইরে যেতেন না৷ এক সময় ফ্লাভিয়ার মনে হলো, ‘‘এভাবে ঘরের কোণে পড়ে থাকার মানে হয় না৷ জীবন এগিয়ে চলে৷ আমাকেও বেরোতে হবে৷’’
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আনন্দময় নতুন জীবন
এখন প্রতি সপ্তাহে একবার সালসা নাচতে যায় ফ্লাভিয়া৷ আগের সেই রূপ নেই, তাতে কী, বন্ধুদের কাছে তো রূপের চেয়ে গুণের কদর বেশি! ফ্লাভিয়া খুব ভালো নাচ জানেন৷ তাই একবার শুরু করলে বিশ্রামের সুযোগই পান না৷ এভাবে পরিবার আর বন্ধুদের সহায়তায় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ফ্লাভিয়া৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
ভারতের নীহারি
নীহারির বয়স তখন ১৯৷ একরাতে আত্মহত্যা করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শরীরে৷ স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি মনে হয়েছিল তখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
নতুন রূপ
যে ঘরটিতে বসে নীহারি তাঁর চুল ঠিক করছেন এটা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘর৷ এখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা কাঠিই ছিল৷ তা দিয়েই আগুন জ্বালিয়েছিলেন শরীরে৷ তবে এখন আর দুর্বল মনের মেয়েটি নেই নীহারি৷ নিজেকে সামলে নিয়ে একটা সংস্থা গড়েছেন৷ সংস্থাটির নাম, ‘পোড়া মেয়েদের রূপ’৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
পাকিস্তানের নুসরাত
দু-দুবার অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে নুসরাতের ওপর৷ প্রথমে স্বামী আর তারপর দেবর৷ ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন নুসরাত৷ ভালোই আছেন এখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আশার আলো
দু-দুবার অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ায় মাথার অনেকটা চুলও হারিয়েছেন নুসরাত৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাথার ক্ষতস্থান পুরোপুরি সারিয়ে চুল এবং আগের হেয়ারস্টাইল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
বন্ধুদের মাঝে...
নিজের ভাবনা, যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে কিংবা গল্প করতে প্রায়ই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এ যান নুসরাত৷ সেখানে এমন অনেকেই আসেন যাঁদের জীবনও অ্যাসিডে ঝলসে যেতে বসেছিল৷ এখন সকলেই জানেন, তাঁরা আর একা নন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
9 ছবি1 | 9
ডয়চে ভেলে: কিন্তু এই ছেলে-মেয়েদের পাচার করা হয় কিভাবে? প্রশ্ন রাখা হয় শক্তি-বাহিনী-র সভাপতি রবিকান্তের কাছে৷
রবিকান্ত: প্রধানত দুটো পথে৷ প্রথমত ভুয়ো ‘প্লেসমেন্ট এজেন্সি'-র নামে আর দ্বিতীয়ত প্রেমের অভিনয় করে৷ প্রথমে গ্রামের গরিব পরিবারের বিশ্বাস অর্জন করে বোঝানো হয় যে, দিল্লির মতো বড় বড় মহানগরিতে প্লেসমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে সহজেই ভালো মাইনের চাকরি জুটিয়ে দেয়া হবে৷ সেই বাবদ অভিভাবকদের কিছু টাকা অগ্রিমও দিয়ে দেয় দালালরা আর মেয়েটিকে নিয়ে এসে ভালো দামে শাঁসালো খরিদ্দারের কাছে বিক্রি করে দেয়৷ নাবালিকা হলে অক্ষত যোনির দাম বেশি হয়৷ আর দ্বিতীয় পথটা হলো, প্রথমে প্রেম ভালোবাসার অভিনয় করে বিয়ে করে, তারপর তাঁদের নিয়ে আসা হয় শহরে৷ শেষে মোটা টাকার বিনিময়ে জোর করে অন্য লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়৷ তারপর পালিয়ে যাবার বা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাবার পথ আটকাতে যত তাডাতাড়ি সম্ভব মেয়েটিকে গর্ভবতী করার তাগিদ থাকে৷
পাচার-চক্রের মোকাবিলা করতে শক্তি-বাহিনীর মতো এনজিওগুলোর ভূমিকা কী?
সাধারণত অপরাধীদের ধরতে, পাচার হওয়া ছেলে-মেয়দের উদ্ধার করতে এবং তাঁদের পুনর্বাসনের কাজে প্রশাসন ও আইন বলবতকারী এজেন্সিগুলিকে সবরকম সাহায্য করে থাকে এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো৷ আমরা তো করি-ই৷
দারিদ্র্যই কি মানবপাচারের একমাত্র কারণ?
দারিদ্র্য ছাড়া অন্য কারণও আছে৷ যেমন বন্যা, খরা, যুদ্ধ, সন্ত্রাস বা সরকারি সুযোগ-সুবিধা না থাকা৷ এ সব কারণে অন্যত্র যেতে গিয়ে ছেলে-মেয়েরা পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে৷ ছেলেরা পড়ে বেগার শ্রমিকের যাঁতাকলে আর মেয়েরা? তাঁদের কথা তো আগেই বলেছি৷ এক হয় তাঁরা গণিকা হন অথবা হন রক্ষিতা৷ প্রতি মাসে বা বছরে যত ছেলে-মেয়ে নিখোঁজ হয়, তার অর্ধেকের বেশি নিখোঁজই থাকে৷ তবে পুলিশ অভিযোগ নিতে গড়িমসি করে বলে এখন অবশ্য অভিযোগ নথিভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করেছে সুপ্রিম কোর্ট৷ দেখা যাক, এতে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয় কিনা৷
জবরদস্তির পতিতাবৃত্তি থেকে জীবনের আনন্দে
প্রতি বছর নেপালের কয়েক হাজার মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বেছে নিতে হয় যৌনকর্মীর জীবন৷ শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ – সবই সইতে হয় তাঁদের৷ চাকরির আশায় ঘর ছেড়ে অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়া এমন মেয়েদেরই জীবনের আনন্দে ফেরায় ‘মাইতি নেপাল’৷
ছবি: Gábor Halász
ঘর ছেড়ে আঁধারের পথে
মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে প্রতি বছর নেপালের অন্তত দশ হাজার মেয়ে ঘর ছাড়ে৷
ছবি: DW/E. Felden
যেখানে নরক
পরিবারে অভাব৷ তাই ভালো চাকরির আশ্বাসে মানবপাচারকারীদের বিশ্বাস করে ঘর ছাড়ে মেয়েরা৷ কিন্তু আশা অনুযায়ী চাকরি জোটে না৷ বেশির ভাগ মেয়েকেই ভারতে নিয়ে জোর করে নামানো হয় পতিতাবৃত্তিতে৷ অত্যাচার, নির্যাতন তো আছেই, ধীরে ধীরে এইডসসহ অনেক জটিল রোগ বাসা সচ্ছল জীবনের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়া মেয়েদের শরীরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তাঁদের পাশে ‘মাইতি নেপাল’
অনেক বছর ধরেই দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে নেপালেের মেয়েদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করছে মানবপাচারকারীরা৷ একবার যৌনকর্মী হলে আর নিস্তার নেই – এমন যাঁরা ভাবতেন, অত্যাচার-নির্যাতন সইতে সইতে যাঁরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেককেই ২২ বছর ধরে স্বপ্ন দেখাচ্ছে মাইতি নেপাল৷ ১৯৯৩ সালে এই সংগঠনটি গড়েছিলেন অনুরাধা কৈরালা৷ সেই থেকে বাধ্য হয়ে যৌনকর্মীর জীবন মেনে নেয়া মেয়েদের জীবনের পথে ফেরাচ্ছে মাইতি নেপাল৷
ছবি: Gábor Halász
মঞ্চে জীবনের অভিনয়
যৌনপল্লি থেকে নিয়ে এসে মেয়েদের জীবনে আনন্দও এনে দেয় মাইতি নেপাল৷ সে আনন্দ ধরে রাখার উপায়ও শেখায়৷ মঞ্চনাটক করে মেয়েরা৷ সেই নাটকেও থাকে মানবপাচারকারী এবং তাদের দুরভিসন্ধির কথা৷ সেই নাটকে অভিনয় করেন যৌনপল্লিফেরত মেয়েরা৷ এভাবে অন্য মেয়েদের যৌনপল্লি থেকে দূরে থাকার উপায়ও জানায় যৌনকর্মীর জীবনকে পেছনে ফেলে আসা মেয়েরা৷
ছবি: Gábor Halász
নজরদারি
আর কোনো মেয়ে যাতে মানবপাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে দেশ না ছাড়ে সেদিকে সবসময় নজর রাখে মাইতি নেপাল৷ বিশেষ করে ভারত সংলগ্ন সীমান্তে গিয়ে বাসগুলোর ওপর কড়া নজর রাখেন সংস্থার কর্মীরা৷ কোনো মেয়ে এবং তার সঙ্গের কোনো পুরুষকে দেখে সন্দেহ হলেই তাঁরা পুলিশ ডাকেন৷
ছবি: Gábor Halász
নয় বছরের সেই মেয়েটি
গীতা নামের এই নারীকে মানবপাচারকারী যখন যৌনপল্লিতে নিয়ে যায়, তখন তাঁর বয়স মাত্র নয়৷ সেখান থেকে যখন ফিরলেন তখন এইচআইভি-র সংক্রমণে তাঁর শরীর কাহিল, বেঁচে থাকার আশাও প্রায় শেষ৷ একে তো যৌনকর্মী তার ওপর এইচআইভি-র রোগী –তাই অনেক সমাজসেবকও তখন গীতার কাছেই ঘেঁষতেন না৷ তখনই তাঁর পাশে দাঁড়ায় মাইতি নেপাল৷
ছবি: AP
নতুন ঠিকানা
নেপালের সীমান্ত এলাকায় ১১টি গৃহ নির্মাণ করেছে মাইতি নেপাল৷ যৌনপল্লি থেকে ফেরা মেয়েদের জন্য ঘর৷ মেয়েদের ভোকেশনাল ট্রেনিং বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণও দেয়া হয় সেখানে৷
ছবি: Gereon Wagener
দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে...
কাঠমান্ডুর মাইতি নেপাল সেন্টারের উঠোনে প্রতিদিন বসে নাচের আসর৷ মেয়েরা যাতে অতীত ভুলে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সুন্দর আগামীর পথ রচনা করতে পারে সেজন্যই নাচ শেখানো হয় তাদের৷ এ পর্যন্ত ১২ হাজার শিশু ও নারী মাইতি নেপালের সহায়তায় যৌনপল্লি ছেড়েছে৷ সীমান্ত থেকে বাঁধা পেয়ে অল্পের জন্য যৌনকর্মী হওয়া থেকে বেঁচেছে প্রায় ৩০ হাজার জন৷
ছবি: Gábor Halász
জার্মানিতে মাইতি নেপালের মেয়েরা
মাইতি নেপাল-এর কয়েকজন এখন জার্মানিতে৷ কোলন শহরের এলি হয়েস রেয়ালশুলে-তে সেদিন নেপালি নাচই নাচলেন৷
ছবি: DW/E. Felden
যেন প্রজাপতি...
কোলনে মাইতি নেপালের মেয়েরা যেন প্রজাপতির মতো উড়ছিলেন৷ তাঁদের জীবনও তো প্রজাপতির মতোই৷ শৈশব থেকে জীবনের একটা সময় পর্যন্ত শুঁয়োপোকার মতো তাঁদেরও অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে৷ কষ্টের সময় কেটে যাওয়ার পর এখন প্রজাপতির মতোই যেন ডানা মেলে উড়ছে৷
ছবি: DW/E. Felden
ইউরোপ সফর
নভেম্বর পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠান করবে মাইতি নেপালের মেয়েরা৷ এ সময়ে জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে হবে তাঁদের অনুষ্ঠান৷
ছবি: DW/E. Felden
11 ছবি1 | 11
বন্ধুরা, আপনার কী মনে হয়?মানবপাচারের আসল কারণ কী? জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷