চীন ভিসার মেয়াদ বাড়াতে অস্বীকৃতি জানানোয় জার্মানিতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন ডাভিড মিসাল৷ তিনি মনে করেন, মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য মানবাধিকার নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করায় তাঁকে সেদেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
সাংবাদিকতা বিষয়ক জার্মান শিক্ষার্থী ডাভিডের ভিসা বাড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ৷ তিনি বেইজিংয়ের সুপরিচিত সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী ছিলেন৷ পড়াশোনার অংশ হিসেবেই সম্প্রতি তিনি সেদেশের মানবাধিকার আইনজীবীদের উপর নিপীড়নের বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন৷ আর তাতেই চীনা কর্তৃপক্ষ তাঁর উপরে চটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
চীনে মুসলিমদের বন্দি করে ‘ব্রেনওয়াশ’
চীনে ২ কোটি মুসলিমের বাস৷ ইসলামি চরমপন্থা কমাতে মুসলমানদের ইসলামের পথ থেকে সরিয়ে চীনের রীতিনীতিতে অভ্যস্ত করার জন্য খোলা হয়েছে বন্দিশিবির৷ অন্তত ৯ লাখ মানুষকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
যে কারণে মুসলিমদের আটক করা হচ্ছে
গত কয়েক বছরে চীনে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ বেড়ে গেছে৷ কট্টরপন্থি উইগুর মুসলমানদের হামলায় গত কয়েক বছরে মারা গেছে কয়েকশ’ মানুষ৷ এ কারণেই উইগুর ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে আটক করে তাদের মতাদর্শ পরিবর্তনের জন্য বন্দিশিবির খোলা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/T. Peter
ভয়াবহ স্মৃতি
যেসব শিবিরে মুসলমানদের রাখা হচ্ছে, সেটাকে বলা হচ্ছে ‘ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্প’ বা দীক্ষাদান শিবির, যদিও এটি মুসলমানদের কাছে ‘ব্রেইন ওয়াশ’ কেন্দ্র হিসেবেই বেশি পরিচিত৷ বন্দি শিবিরের একজন ওমির বেকালি৷ তিনি নিজের দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করেছেন সংবাদ সংস্থা এপি’র কাছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
নির্যাতন
কয়েক বছর আগে চীন থেকে কাজাখস্তানে চলে গিয়েছিলেন বেকালি৷ ২০১৭ সালে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চীনে আসেন৷ আসার পরই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়৷ এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বেকালি সেই বন্দি শিবিরে তাঁর উপর চলা অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
আত্মহত্যার চেষ্টা
বেকালি জানান, আটকের এক সপ্তাহ পরে তাকে একটি অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হয়৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো খাবার বা পানি দেয়া হয়নি৷ যখন তিনি তাদের নির্দেশ মানতেন না, তখন দেয়ালের সামনে ৫ ঘণ্টা টানা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো৷ তখন টানা ২০ দিন ধরে তার উপর যে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়, তারপর তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
ভাবনায় পরিবর্তন
বেকালি জানান, এই বন্দিশিবিরে যারা থাকেন, তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা অর্থাৎ ধর্মীয় চিন্তা পরিবর্তন করতে হয়৷ নিজেদের সম্প্রদায়কে ত্যাগের কথা ভাবতে বাধ্য করা হয়৷ মুসলমান ছাড়াও এ শিবিরে বিদেশি কয়েকজনকেও রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
ইসলামের ঝুঁকি
ঐ বন্দি শিবিরে যারা নির্দেশক ছিলেন, তারা কট্টরপন্থি এবং জঙ্গি সংগঠনগুলোর দৃষ্টান্ত দিয়ে ‘ইসলামের খারাপ দিক’ এবং ইসলামের কী কী ঝুঁকি রয়েছে, তা বলতেন৷ বেকালির ভাষায়, এটা একটা অবর্ণনীয় যন্ত্রনা, ‘‘কেননা আমি নিজের ভাবনার সমালোচনা করছি, নিজের সম্প্রদায়কে অস্বীকার করার কথা ভাবছি৷’’ গত বছরের ডিসেম্বরে ঐ বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পান তিনি৷ কিন্তু সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
ধর্ম ছেড়ে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রশংসা
বন্দি শিবিরে সবাইকে খুব ভোরে উঠতে হতো৷ চীনের জাতীয় সংগীত গাইতে হতো৷ সকাল সাড়ে সাতটায় চীনের পতাকা উত্তোলন করতে হতো৷ এছাড়া এমন সব গান গাওয়া হতো যেগুলোতে কেবল কম্যুনিস্ট পার্টির প্রশংসা করা হয়েছে৷ এছাড়া তাঁদের চীনা ভাষা এবং চীনের ইতিহাস পড়তে হতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/How Hwee Young
রাষ্ট্রপ্রধানকে ধন্যবাদ
বেকালি জানান, খাবার হিসেবে প্রতিদিন সবজির স্যুপ আর রুটি দেয়া হতো৷ মাঝে মাঝে শুকরের মাংস এবং মদ খেতে বাধ্য করা হতো৷ তবে খাওয়ার আগে বাধ্যতামূলকভাবে কম্যুনিস্ট পার্টিকে ধন্যবাদ জানাতে হতো, পাশপাশি মাতৃভূমি এবং চীনা রাষ্ট্রপতিকেও ধন্যবাদ জানাতে হতো৷
ছবি: Getty Images/K. Frayer
নতুন পরিচয়
চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং এলাকায় এই বন্দিশিবিরগুলো স্থাপনের লক্ষ্য হলো মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় পরিবর্তন আনা৷ তাদের নিজেদের ধর্মীয় চিন্তাভাবনা পুরোপুরি দূর করা এবং তাদের নতুন রূপে পরিচয় করানো৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Wong
৯ লাখ বন্দি
জিনজিয়াং-এর থেকে নির্বাসিত মানুষদের দ্বারা পরিচালিত তুরস্ক ভিত্তিক একটি টেলিভিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে বেশ কিছু ফাঁস হওয়া সরকারি তথ্য রয়েছে, যার মাধ্যমে জানা গেছে, এসব বন্দিশিবিরে ৯ লাখ মানুষ বন্দি আছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার মতে, সংখ্যালঘুদের এত বিশাল গণ কারাগার বিশ্বে আর কোথাও নেই৷
ছবি: J. Duez
গোপন কার্যক্রম
চীনা কর্তৃপক্ষ এই বন্দিশিবিরের কথা স্বীকার করে না৷ তবে, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়তে মতাদর্শ পরিবর্তন করা দরকার৷ সংবাদ সংস্থা এপি বন্দিশিবিরের বেশ কয়েকজন বন্দি এবং নির্দেশকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন৷ প্রত্যেকেই নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, কেননা, তাদের পরিবার রয়েছে চীনে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. W. Young
হারানোর কিছু নেই
বেকালি কাজাখস্তান ফিরে গেছেন৷ ভেবেছিলেন কারো কাছে কিছু বলবেন না৷ কিন্তু গত মার্চে চীনা কর্তৃপক্ষ তার বাবা-মা এবং বোনকে ধরে নিয়ে যায়৷ তাই তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিশ্বকে তাঁর গল্প বলার সিদ্ধান্ত নেন৷ বেকালি জানান, তিনি এসব কথা জানাতে চান, কারণ, তাঁর আর হারানোর কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
12 ছবি1 | 12
মিসাল জার্মান বার্তাসংস্থা ডিপিএকে জানিয়েছেন যে রবিবার চীন ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে তাঁকে, কেননা তাঁর সেদেশে অবস্থানের ‘রিসিডেন্ট পার্মেট'-এর মেয়াদ কমিয়ে ফেলা হয়েছে এবং তাঁর ‘স্টুডেন্ট ভিসা'-র মেয়াদও বাড়ানো হয়নি৷
ডাভিড মিসালের অধ্যাপক তাঁকে মানবাধিকার বিষয়ক তথ্যচিত্রটি নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন, সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিল বলে লিখেছে হংকং ফ্রি প্রেস (এইচকেএফপি)৷ তথ্যচিত্রে তিনি চীনা কর্তৃপক্ষ কিভাবে মানবাধিকার আইনজীবীদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে তা বিশদভাবে তুলে ধরেছেন৷
জার্মান শিক্ষার্থীকে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ না করতে দু'বার সতর্ক করা হয়েছিল বলেও জানা গেছে৷ তবে তিনি সেই সতর্ক বার্তা এড়িয়ে গেছেন, কেননা চীনের সমাজ এবং রাজনীতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন তিনি৷
এইচকেএফপি-র প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, উত্তর-পশ্চিমের জার্মানির ওসনাব্র্যুকের বাসিন্দা মিসালকে চলতি বছরের শুরুতে চীনের ভুহান শহরে মানবাধিকার আইনজীবী লিন কিলেই-এর সঙ্গে আটক করা হয়েছিল৷ সেসময় তাঁরা সেখানে এক কারাবন্দি অ্যাক্টিভিস্টকে দেখতে গিয়েছিলেন৷ গতমাসে লিনকে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধ্বংসের' ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে চীন৷
তথ্যচিত্রের জন্য বেশ কয়েকজন মানবাধিকার আইনজীবী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডাভিড মিসাল। ২০১৫ সালে ৩০০-র মতো আইনজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল৷ তাঁদের অনেকেই ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মতো অভিযোগে দীর্ঘমেয়াদে কারাবাসের শাস্তি দেয়া হয়েছে৷ কেউ কেউ এখনো তাঁদের বিরুদ্ধে চলা মামলার রায়ের অপেক্ষা রয়েছেন৷
‘জার্মান অ্যাকাডেমিক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম বা ডিএএডি-র আওতায় সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছিলেন মিসাল। আর একবছর সময় পেলে তিনি সেখানে তাঁর উচ্চশিক্ষা শেষ করতে পারতেন৷