1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মানসিকতায় অনার কিলিং!

২৪ অক্টোবর ২০১৬

পাকিস্তানে ‘অনার কিলিং’-এর কথা প্রায়ই শোনা যায়৷ এই বর্বরতা সেখানে যেন সামাজিকভাবেই স্বীকৃত৷ পরিবারের ‘সম্মান রক্ষায়’ আত্মীয়-স্বজনের, এমনকি বাবা-ভাইয়ের হাতে পরিবারের কোনো সদস্যকে হত্যা সেখানে প্রায় নিয়মিত ঘটনা৷

Pakistan Lahore grausame Ehrenmorde Hassan Khan verlor seine junge Frau
ছবি: picture-alliance/AP Photo/K.M. Chaudary

এর বিপরীতে বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবস্থায় অনার কিলিং নেই৷ আইনে যে কোনো ধরণের হত্যাকাণ্ড কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তারপরও কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক৷

১.মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করায় মাকে পিটিয়ে হত্যা

ঘটনাটি এবছরেরই ২০ এপ্রিলের৷ বগুড়ার বৃন্দাবনপাড়ায় জেসমিন আক্তার তুহিন নামে এক বিউটিশিয়ানকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তার স্বামী আব্দুল গফুর৷ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে তিন্নি খাতুন ঘটনার কিছু দিন আগে প্রেম করে বিয়ে করে৷ মেয়ের বিয়ে নিয়ে আব্দুল গফুর তার স্ত্রী তুহিন বেগমকে দোষারোপ করে আসছিলেন৷ ঘটনার দিন মেয়ের বিয়ে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয়৷ এক পর্যায়ে স্ত্রী তুহিন বেগমকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ ঘরে ফেলে রেখে স্বামী আব্দুল গফুর পালিয়ে যায়৷

২. চাচাতো বোনের সঙ্গে প্রেম করায় পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

এই ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়, গত ১১ অক্টোবর৷ ডেমরার সারুলিয়া এলাকায় জাহিদ হোসেন নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ ডেমড়া থানার ওসি কাওছার আহম্মেদ সংবাদ মাধ্যমকে জানান,‘‘জাহিদ তার চাচাতো বোন নিগার (ছদ্মনাম)-এর সঙ্গে প্রেম করতো৷ এই ঘটনা জানতে পেরে  ঘটনার দিন সন্ধ্যায় নিগারকে দিয়ে ফোন করে জাহিদকে ডাকিয়ে আনে তার চাচা সিদ্দিক এবং চাচাতো ভাই গাজি ও মাসুদ৷ পরে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ রাস্তার পাশে ফেলে রাখে৷''

৩. ধনীর ছেলের প্রেমে পড়ে জীবন দিলেন নিপা

ময়মনসিংহে মিনারা আক্তার নিপা এক পিঠা বিক্রেতার মেয়ে৷ তবে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইন্সটিউট থেকে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হয়৷ একই প্রতিষ্ঠানে এক ইয়ার নীচে পড়তো ধনাঢ্য পরিবারের মুহিব্বুল আরেফিন সাকিব৷ এক বছর পর সে-ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হয়৷ সেখানেই পরিচয় এবং ভালোবাসা৷ সাকিব পরিবারের অমতে ২০১৫ সালে বিয়ে করে নিপাকে৷ কিন্তু সাকিবের পরিবার তা মানেনি৷ পরে নানা দেনদরবারের পর সাকিবের পরিবার নিপাকে মেনে নিয়ে ঘরে তোলে৷ গত মার্চে নতুন করে বিয়ের দিন ঠিক করা হয়৷ কিন্তু তার আগেই লাশ হয় নিপা৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি তার শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর কক্ষ থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়৷ এসময় সাকিব বাসায় ছিলেন না৷ নিপার পরিবারের অভিযোগ, তাকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে৷ পুলিশ এখনো মামলাটির তদন্ত শেষ করতে পারেনি৷

Tajul Islam - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে৷ আর এই ধরণের ঘটনার প্রধান শিকার নারী৷ হত্যাকাণ্ডের বাইরে নির্যাতন, চুল কেটে দেয়া, একঘরে করে ফেলা, গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটানোর মতো ঘটনাও অনেক আছে৷ পরিবারের সম্মান রক্ষা বা সম্মান হানির জবাব দিতে এসব ঘটনা ঘটানো হয়

উপরের তিনটিসহ আরো কিছু ঘটনা বিশ্লেষণে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়:

১.বাংলাদেশে এখনো অবিবাহিত নারী- পুরুষের প্রেমের সম্পর্ককে সহজভাবে নেয়া হয় না৷ এর ‘দায়' বিশেষ করে নারী বা মেয়ের পরিবারের ওপর চাপানো হয়৷ আর ছেলের পরিবারও এমন সম্পর্ককে অপমান মনে করে৷

২. সামাজিক অবস্থান এবং আর্থিক অবস্থার ব্যবধানকে বড় করে দেখা হয়৷ আর অসম বয়সের প্রেমকেও নিন্দার চোখে দেখা হয়৷

৩. বিবাহিতদের বিবাহের বাইরে প্রেম ‘নিষিদ্ধ'৷

৪. পারিবারিক সম্মান বা অবস্থানের মর্যাদার নামে বাংলাদেশেও হত্যাকাণ্ড অথবা নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷

Jotirmoy Borua - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অনার কিলিংয়ের মানসিক অবস্থা এখানে বিদ্যমান৷ পাকিস্তানের মতো এখানে এটা প্রকট নয়৷ তবে যা হচ্ছে তা ব্যক্তি ও পরিবারের অহংবোধ থেকে৷ এখানে সমস্যাটি হলো ধনী-গরীবের ব্যবধান নিয়ে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘পরিবারের সম্মানকে কেউ কেউ তাদের বিবেচনায় দেখেন৷ আর তখন তারা মানবিকতা হরিয়ে ফেলেন৷ এটা এখানে ধর্মীয় কারণেও ঘটে৷ এটা একটা মনোজাগতিক অবস্থা৷ আমরা কেউ স্বীকার করি আর না করি, এই মানসিক পরিস্থিতি বিদ্যমান৷''

অনার কিলিং প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন,‘‘আইনে তো আমাদের দেশে যে কোনো হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে৷ আর সামাজিক অবস্থাও অনার কিলিংয়ের নয়৷ এটা সামন্তবাদী বা ফিউডাল সমাজ নয়, যেমনটা পাকিস্তান বা অন্যকোনো দেশ৷ তবুও বিষয়টি আমাদের এখানে আলোচনায় আসা উচিত৷ কিছু ঘটনা ঘটছে৷ তবে তা সংখ্যায় খুবই অল্প বলে হয়তো আমরা তা নিয়ে ভাবছি না৷''

জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে,‘‘এটা বেড়ে গেলেতো আমাদের ভাবতে হবে৷ আইনের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনত হবে৷ আইনের কথা ভাবতে হবে৷ তবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা অনার কিলিংয়ের পক্ষে অবস্থান নেয় না৷''

Hafizur Rahman - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

এবার ২০১৪ সালের একটি ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে যা তখন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে৷ শেরপুর সদর উপজেলার বেতমারী গ্রামের এক হিন্দু ছেলের সঙ্গে এক মুসলিম মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ তারা ঘর বাঁধতে পালিয়ে চলেও যায়৷ আর এই ঘটনা জানাজানি হলে ওই গ্রামে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যায়৷ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর তখন আক্রমণ করে কিছু দুর্বৃত্ত৷ কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়৷ তারা মুসলমান মেয়ের সঙ্গে হিন্দু ছেলের বিয়ে মানতে নারাজ৷ পরে ছেলে-মেয়ে দু'জনকে আটক করে যার যার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয় সেখানকার পুলিশ৷

এ বছরের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এক নারী কন্ঠ শিল্পী ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করেন এক মুসলিম যুবককে৷ তাতে ক্ষুব্ধ হন মেয়ের পরিবারের সদস্যরা৷ থানায় মামলা ঠুকে দেন৷ পুলিশ দু'জনকেই আটক করে৷ পরে মেয়েটিকে ছাড়া হলেও ছেলেটি মামলার ঘানি টানছে৷

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশে বিয়ের ব্যাপারে ধর্মীয় ব্যবস্থা বেশ কঠিন৷ আইনে আন্ত:ধর্ম বিয়েতে কোনো বাধা না থাকলেও সামাজিক এবং ধর্মীয় বাধা আছে৷

Elina Khan - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘অল্প হোক, তারপরও অনার কিলিং আছে৷ আমরা হয়তো সেটাকে সেভাবে দেখি না৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরাই এর প্রধান শিকার৷ আর ধর্ম, সামাজিক অবস্থান এখানে কাজ করছে৷ আগে নারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়া হতো৷ হাইকোর্ট সেটা বন্ধ করেছে৷ আমি মনে করি, অনার কিলিং নিয়েও আমাদের ভাবার সময় এসেছে৷''

তবে মানবাধিকার কর্মী এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘পাকিস্তানে যেমন অনার কিলিংয়ে ক্ষমা পাওয়া যায়, কমিউিনিটি এটাকে গ্রহণ করে, বাংলাদেশে সেই অবস্থা নেই৷ এ ধরণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে৷ কিন্তু যেটা হয়, তা হলো পারিবারিক বা অন্যকোনোভাবে ঘটনাকে গোপন করা হয়৷ আলামত নষ্ট করা হয়৷ ধামাচাপা দেয়া হয়৷''

অ্যাডভোকেট এলিনা খান আরো বলেন,‘‘আমি মনে করি, এক্ষেত্রে আইন সংশোধনের প্রয়োজন আছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে এ ধরণের ঘটনা প্রমাণে গুরুত্ব দিতে হবে৷ হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে৷ দরকার আইন ও বাস্তবায়ন৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ