জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে জন্ম নিচ্ছে মানসিক অবসাদ৷এ প্রবণতা মহিলাদের, বিশেষ করে বিবাহিতা মহিলাদর মধ্যে বেশি৷ ওই অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করছেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে৷ বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানি ডা. আর. নিয়োগী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানসিক অবসাদ যে একটা অসুখ, তার যে চিকিত্সা দরকার, সেটা মনে রাখেন না শতকরা নব্বই জন৷''
বিশ্বে যত মহিলা আত্মহত্যা করেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তার ৩৭ শতাংশ ভারতীয়, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ৪০-এর মধ্যে৷ অধিকাংশই বিবাহিতা৷ সমীক্ষা বলছে, ভারতে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পঞ্চম বড় কারণ আত্মহনন৷ বিবাহিতা মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি কেন ? প্রথম এবং প্রধান কারণ লিঙ্গ বৈষম্য৷ দ্বিতীয় কারণ, ভারতে বিবাহ নামক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় মেয়েদের আশা-আকা্ঙ্খা পূরণের পরিসর তেমন নেই বললেই চলে৷ একদিকে সাংসারিক তথা সামাজিক প্রত্যাশার চাপ, অন্যদিকে আর্থিক স্বনির্ভরতার অভাব৷ অল্প বয়সে বিয়ে এবং অল্প বয়সে মাতৃত্বের দায় দায়িত্ব৷ মেয়েদের জীবনে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা৷ সেই চাপটা এসে পড়ে মনের উপর৷ এই চাপ উপশমে যদি সে কাউকে, বিশেষ করে স্বামী বা অন্য পরিজনকে পাশে না পায়, তাহলে সেটা পরিণত হয় মানসিক অবসাদে৷ জীবন সম্পর্কে দেখা দেয় এক অনীহা, বিতৃষ্ণা৷ বাঁচার ইচ্ছেটা চলে যায়৷ আত্মহননকে এই চাপ থেকে মুক্তির সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয়৷ এর পাশাপাশি আরো একটা বড় কারণ মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞানতা৷
‘ মানসিক অবসাদের পেছনে আছে নানা কারণ, সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্য অন্যতম’
সমীক্ষার এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, ১৯৯০ সালে যেখানে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার, ২০১৬ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৩০ হাজার ৩১৪ অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি৷ এ বিষয়ে ডা. আর. নিয়োগী বললেন, ‘‘মূলত এর বড় কারণ হচ্ছে জেনেটিক বা জিনঘটিত, যদিও এটা প্রমাণ করার মতো বৈজ্ঞানিক স্টাডি এই মূহুর্তে আমাদের হাতে নেই৷ তবে আগামী দিনে আমরা সেটা করবো, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে৷ যদিও অন্যান্য রাজ্যেও আত্মহত্যার ঘটনা যথেষ্ট বেশি৷ দ্বিতীয়ত, মানসিক অসুস্থতার চিকিত্সা দেশে খুব কম৷ বস্তুত মানসিক অসুস্থতার প্রধান কারণ অবসাদ৷ দেখা গেছে, ভারতে ১০০ জন মানসিক অবসাদে ভুগলে ৯০ জন চিকিত্সা সহায়তা নেন না৷ অন্যদিকে জার্মানি বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মানসিক অবসাদের চিকিত্সা সহায়তা নেন না মাত্র ৩০ থেকে ৪০ জন৷ এক কথায় ভারতে যেখানে চিকিত্সা সহায়তা নেন না শতকরা ৯০ জন, সেখানে ঐসব দেশে নেন না শতকরা ৩০ থেকে ৪০ জন৷''
আত্মহত্যা নয়, বেঁচে থাকাই সঠিক সিদ্ধান্ত
চরম অবসাদ, অপমান, গ্লানি, অবহেলা – একাধিক কারণে বেঁচে থাকার ইচ্ছা লোপ পেতে পারে৷ কিন্তু দুর্বল মুহূর্তের সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে ফেললে ফিরে আসার আর কোনো উপায় থাকে না৷
ছবি: Fotolia/ lassedesignen
জীবন-মৃত্যুর প্রান্তে
সামনে শূন্যতা৷ ঝাঁপ দিলেই সব শেষ৷ মত বদলের কোনো অবকাশ নেই৷ কিন্তু মনের কোণে সামান্য সংশয় তো থেকেই যায়৷ বেঁচে না থাকলে সেই সংশয় যাচাই করার কোনো উপায় আছে কি?
ছবি: picture-alliance/dpa
আবেগ নয়, চাই যুক্তি
পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও সেটি দ্রুত কার্যকর না করাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ নেতিবাচক আবেগের কালো মেঘ কেটে গিয়ে যুক্তির খুঁটি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত মন থেকে দূর করতে পারে৷
ছবি: Fotolia/Chlorophylle
চরম কষ্টের তাড়না
আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের পেছনে থাকে চরম বেদনা, হতাশা বা গ্লানি৷ সেই কষ্ট সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়৷ দিশাহারা অবস্থায় মনে হয়, সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে৷ অথচ সেই কষ্ট কম করা, তা নিয়ে চলতে পারাও কিন্তু সম্ভব৷
ছবি: vkara - Fotolia.com
‘এই জগতে আমাদের ঠাঁই নেই’
একা নয়, প্রিয় মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে পার্থিব জগত ছেড়ে চলে যাবার কঠিন সিদ্ধান্তও নেন কেউ কেউ৷ সমাজ, ধর্ম, সম্প্রদায় বা রাষ্ট্র তাদের সম্পর্ক মেনে না নেওয়ায় কোণঠাসা হয়ে মৃত্যুই একমাত্র পথ বলে মনে হয়৷ অথচ বিকল্প কি একেবারেই থাকে না?
ছবি: Getty Images/AFP
অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ
জগতটা শুধু নিজেকে নিয়ে নয়৷ নিজের দুঃখ, কষ্ট, কঠিন সমস্যার গণ্ডির বাইরেও আছে এক বৃহত্তর পৃথিবী৷ অন্যরাও সেখানে পুরোপুরি সুখি নয়৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ, সম্ভব হলে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে নিজের মনও শান্ত হতে পারে৷ অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজের জগত দেখলে নতুন উপলব্ধি জাগতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিঃসঙ্গতা থেকে আত্মহত্যার হাতছানি
নিঃসঙ্গতা, চরম একাকিত্ববোধ থেকেও আত্মহত্যার চিন্তা মনে আসে৷ অথচ নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার বদলে চারিদিকে তাকালে কাউকে না কাউকে ঠিকই পাওয়া যাবে৷ পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বা অন্য কোনো বৃত্তের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে নেওয়া সম্ভব, যে দুঃখ-বেদনার কথা শুনতে প্রস্তুত৷ মন হালকা হলে আত্মহত্যার হাতছানিও উধাও হয়ে যাবে৷
ছবি: Fotolia/ lassedesignen
6 ছবি1 | 6
মানসিক অবসাদের প্রধান কারণ সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানি ডা. নিয়োগী ডয়চে ভেলেকে বললেন, মানসিক অবসাদের পেছনে আছে নানা সামাজিক কারণ. সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্য যার অন্যতম৷ তৃতীয়ত, পশ্চিমী মিডিয়া, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে সুইসাইডের ব্যাপক প্রচার৷ কোনো আত্মহত্যার ঘটনার বিভিন্ন দিক অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়৷ যেমন, কেন, কিভাবে এবং কী অবস্থায় আত্মহত্যা করলো ইত্যাদি৷ সেই মেথডটা তাঁরা নিয়ে নেয় এবং সেইভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করে৷ যেমন ধরুন, ২০১৪-১৫ সালে কলকাতায় কিছু হাইরাইজ বিল্ডিং তৈরি হয়, সেখান থেকে অনেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে৷ এইসব ঘটনা ফলাও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরা হয়৷ অবশ্য, উঁচু বিল্ডিং থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিল বয়স্করা বেশি৷ এসবের পরও একটা কথা বলা যায়, আত্মহননের সব থেকে বড় ভূমিকা গার্হস্থ্য হিংসা৷ যেমন ধরুন, কাজ করতে ইচ্ছা করছে না অবসাদের কারণে৷ ঘরের অন্যরা মনে করছে, সে ইচ্ছা করে কাজ করছে না৷ মহিলারা এমনিতেই জেনেটিক্যালি বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়৷ তার সঙ্গে আছে প্রেম-ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যান, ব্যর্থতা, বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি৷
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আত্মহত্যার হার সমান নয়৷ দক্ষিণী রাজ্য কর্নাটকের প্রতিলাখে ৩০ জন. তামিলনাড়ুতে ৩০ জন. অন্ধ্রপ্রদেশে প্রতিলাখে ২৫ জন৷ আত্মহত্যার হার তুলনামূলকভাবে সবথেকে কম জম্মু-কাশ্মীর, উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড এবং দিল্লি,পাঞ্জাব, ঝাড়খন্ড এবং বিহারে৷ পুরুষদের আত্মহত্যার পেছনে সাধারণত কাজ করে মদ ও মাদকাসক্তি, গার্হস্থ্য হিংসা, দারিদ্র্য তথা বেকারত্ব৷
বলিউডের যে তারকারা অবসাদের শিকার
তারকাদের ঝলমলে জীবন দেখে মনে হতে পারে, তাদের জীবনে কোনো অবসাদ বা ডিপ্রেশন নেই৷ বলিউডের অবসাদগ্রস্ত তারকাদের অনেকে এই মানসিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও কেউ কেউ সমাধান হিসেবে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP
দীপিকা পাড়ুকোন
দীপিকা ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন একথা নিজেই স্বীকার করেছেন একটি সাক্ষাৎকারে৷ তিনি বলেছেন, ‘‘একটা সময় আমার মনে হত আমি কি করব? কোথায় যাবো? আমি কেবল কাঁদতাম৷’’ দীপিকা নিজের অবসাদের ব্যাপারটি যে বুঝতে পেরেছেন এ কারণে বিশেষজ্ঞরা তাঁকে সাহসী বলেছেন৷
ছবি: DW/P. M. Tewari
আনুষ্কা শর্মা
দীপিকার পর আনুষ্কাও তাঁর অবসাদের কথা জানিয়েছেন৷ তিনি এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করেছেন৷ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘যখন আপনার পেটে ব্যথা হয় তখন কি আপনি চিকিৎসকের কাছে যান না? এটাও সেরকমই একটি ব্যাপার৷’’ আনুষ্কা জানিয়েছিলেন তাঁর অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার রয়েছে আর সেটার চিকিৎসা চলছে৷
ছবি: AP
পারভীন ববি
২০০৫ সালে পারভীন ববিকে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল৷ ময়নাতদন্তে জানা গিয়েছিল, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল মৃতদেহ উদ্ধারের ৭২ ঘণ্টা আগে৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি বেশ কিছুদিন ধরে না খেয়ে ছিলেন৷ পারভীন ডিপ্রেশন এবং সিজোফ্রেনিয়ার শিকার ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সিল্ক স্মিতা
দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী সিল্ক স্মিতার জীবনী নিয়ে তৈরি হয়েছিল বিদ্যা বালন অভিনীত ডার্টি পিকচার মুভিটি৷ নাম, যশ, খ্যাতির শিখরে থেকে একসময় তিনি মানসিক স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছিলেন৷ ১৯৯৬ সালে নিজের ঘরে ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেন তিনি৷
ছবি: ALT Entertainment/Balaji Motion Pictures
জিয়া খান
২০১৩ সালে জিয়ার আত্মহত্যা বলিউডে তোলপাড় তুলেছিল৷ মাত্র ২৫ বছরের জিয়া নিজের ঘরে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিলো৷ ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তাই তাঁর আত্মহত্যার কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মনীষা কৈরালা
গর্ভাশয়ে ক্যান্সারের কারণে মনীষা অবসাদে ভুগছিলেন৷ কিন্তু এসময় পরিবার ও বন্ধুরা তাঁকে সঙ্গ ও সাহস দেয়ায় তিনি সেই অবসাদ থেকে ফিরে এসেছেন৷ মনীষা বলেন তিনি নিরাশাবাদী নন, তাই ডিপ্রেশনের সাথে লড়াই করে জিতেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শাহরুখ খান
বলিউডের বাদশাহ বলা হয় তাঁকে৷ কিন্তু তিনিও ডিপ্রেশনের শিকার৷ এটা শুনতে অস্বাভাবিক লাগতে পারে৷ কেননা জীবনে নাম, যশ, খ্যাতি কোনোটারই অভাব নেই তাঁর৷ কিন্তু এক সাক্ষাৎকারে শাহরুখ বলেছিলেন, কাঁধে অস্ত্রোপচারের পর বেশ অনেকটা সময় তিনি অবসাদে ভুগছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP
অমিতাভ বচ্চন
অ্যাংরি ইয়াং ম্যান হিসেবে পরিচিত অমিতাভ বচ্চন বরাবরই কঠিন সব ভূমিকায় অভিনয় করেন৷ ৯০ এর দশকে নির্মাতা হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন তিনি৷ কিন্তু সেই কোম্পানি পরিবেশিত মুভিগুলো ফ্লপ হওয়ায় ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছিলেন৷ সেই সময় তিনি গভীর অবসাদে ভুগছিলেন৷ তাই মানসিক অসুস্থতার কারণে শারীরিক কিছু অসুস্থতাও দেখা দিয়েছিল তাঁর৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
ধর্মেন্দ্র
এক, দুই না টানা ১৫ বছর ধরে অবসাদে ভুগেছিলেন বলিউড অভিনেতা ধর্মেন্দ্র৷ ডিপ্রেশনের কারণে তিনি মদ্যপান শুরু করেন এবং এতে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েন যে সংসারে অশান্তি শুরু হয়৷ কিন্তু বর্তমানে তিনি এসব পেছনে ফেলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন৷
ছবি: Mskadu
গুরু দত্ত
১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর নিজের বাসায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল হিন্দি চলচ্চিত্রের অন্যতম সৃজনশীল পরিচালক গুরু দত্তকে৷ বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি অবসাদে ভুগছিলেন৷ প্রতি রাতে মদ্যপান এবং ঘুমের ওষুধ ছিল তাঁর সঙ্গী৷ যেদিন মারা যান সেদিনও একসাথে অনেক ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন৷