আফ্রিকার দেশ উগান্ডার জলাশয়গুলোতে মাছের পরিমাণ দিন দিন কমতে থাকায় মাছের বদলে মানুষ শিকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সেখানকার নদী আর হ্রদের কুমির৷ কেবল ২০১৩ সালেই কুমিরের হামলার শিকার হয়েছেন ৩১ জন৷
বিজ্ঞাপন
দেশটির বন্যপ্রাণী বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, লেক ভিক্টোরিয়া, লেক আলবার্ট, লেক কিয়োগা এবং নীল নদের তীরে গত ১৪ বছরে নাকি অন্তত ৩৪০ জন মানুষ কুমিরের পেটে গেছে৷
সরকারি এ সংস্থার পরিচালক পিটার ওগওয়াং জানান, উগান্ডা আফ্রিকার স্বাদু পানির মাছের সবচেয়ে বড় উৎস হলেও অতি মাত্রায় মৎস্য আহরণের কারণে নদী ও হ্রদগুলোতে মাছের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে এসেছে৷ এতে কুমিরের খাবারেও টান পড়েছে৷ কিন্তু হ্রদ ও নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে মনুষ্যবসতি দিন দিন বাড়ছে৷ ফলে কুমিরেরা সহজ পথটাই বেছে নিচ্ছে৷
‘‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিছু এলাকায় কুমিরেরা আর মাছ ধরার চেষ্টা করছে না৷ বরং তাঁদের চোখ থাকছে জেলে এবং তীরের কাছাকাছি মানুষের ওপর৷ কুমির একবার কোনো মুনষ্য শিকার পেয়ে গেলে বাকিরাও ভোজে যোগ দিচ্ছে৷''
লেক ভিক্টোরিয়ায় মাছ ধরতে গিয়ে একদিন এভাবেই আক্রান্ত হয়েছিলেন স্থানীয় জেলে করিম ওনেই৷ সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে হ্রদের পানিতে কুমিরের ভাসমান পিঠ দেখে তিনি ভেবেছিলেন জলজ আগাছার স্তূপ৷ কিন্তু সেটাই হঠাৎ কুমিরের চেহারা নিয়ে তাঁর হাত কামড়ে ধরে এবং টেনে পানিতে নিয়ে যায়৷
‘‘তখন আমি মরিয়া হয়ে বাঁচার চেষ্টা করছি৷ কিন্তু কুমির আমাকে কিছুতেই ছাড়ে না...৷ এক পর্যায়ে আমার চিৎকারে লোকজন ছুটে এসে বৈঠা আর লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করলে কুমিরটা আমাকে ছেড়ে পানিতে ডুব দেয়৷''
২০০৬ সালের জানুয়ারিতে ওই ঘটনায় একটি হাত হারাতে হয়েছে ৪০ বছর বয়সি করিমকে৷ সেই সঙ্গে ছাড়তে হয়েছে মাছ ধরার পেশা৷ তাঁর বুক আর কাঁধে কুমিরের ধারালো নখের চিহ্ন যে কাউকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে৷ করিমের ছোট ভাই জাকে কিজতোকেও দুটো হাত হারাতে হয়েছে কুমিরের হামলায়৷
কামপালার ৯৫ কিলোমিটার পূর্বে ভাইরাকা এলাকার জেলে হেনরি নিয়াজি বলেন, ‘‘এই কুমিরেরা খুবই ধূর্ত, তাদের গতিও সাংঘাতিক৷ সাধারণত সন্ধ্যা, মধ্যরাত আর ভোরের আগে আগে এরা হামলা চালায়, যখন চারদিন একেবারে সুনসান থাকে৷
তবে বিকেল বেলায় লেক ভিক্টোরিয়ার ওপর দিয়ে যখন গা জুড়ানো ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যায়, তখনো হ্রদের তীরে মরচে ধরা টিনের ঘরে জেলেদের মনে থাকে কুমিরের ভয়৷
পূর্ব আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত এই দেশে কুমিরের সংখ্যা কত তার সঠিক কোনো হিসাব নেই৷ তবে কেবল লেক আলবার্টেই অন্তত ৬০০ কুমির আছে বলে বন্যপ্রাণী বিভাগের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে৷
২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭৯টি মানুষখেকো কুমির ধরে ন্যাশনাল গেম পার্কে সরিয়ে নিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিভাগের কর্মীরা৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ধরা হয় ২০০৫ সালে, যার ওজন ছিল প্রায় এক টন৷ ধারণা করা হয়, লেক আলবার্টের সেই কুমিরটি ১৫ বছরে অন্তত ৮৩ জন জেলের মৃত্যুর কারণ হয়েছে৷
হুমকির মুখে যেসব প্রাণী
হুমকির মুখে থাকা কিছু প্রজাতির প্রাণী লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে৷ এদের মধ্যে আফ্রিকার ওকাপিসহ আরো ২০০ পাখি রয়েছে৷ তবে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ওকাপি’র সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে
জিরাফের মতো দেখতে এই ওকাপি’র বাস কঙ্গোতে৷ আফ্রিকার ঐ অঞ্চলে কত প্রাণীর বাস তার হিসাব রাখে ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন)৷ সংস্থাটি সম্প্রতি হুমকির তালিকায় থাকা প্রাণীদের নাম প্রকাশ করেছে৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে, কঙ্গোর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকা এই ওকাপির সংখ্যা নব্বইয়ের দশকে ছিল ৪,৪০০৷ দশ বছর পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২,৫০০ তে৷ কঙ্গোর সহিংসতা এবং খনি ব্যবসাকে এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে৷
ছবি: cc-by-sa-3.0/Raul654
বিলুপ্তির পথে
আইইউসিএন জানিয়েছে, ওকাপি এখন হুমকির মুখে৷ তাদের তৈরি তালিকার একেবারে তলানিতে আছে ওকাপির নাম৷ অর্থাৎ এরাই সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে রয়েছে৷ এমন অনেক প্রাণী আছে, আজ থেকে ২০০ বছর আগেও যাদের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন বালি টাইগার৷ বাঘের প্রায় সব প্রজাতিই আজ হুমকির মুখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুইশ প্রজাতির পাখি হুমকির মুখে
নতুন রেড লিস্টে দুইশ প্রজাতির পাখিও রয়েছে৷ এদের মধ্যে অনেক শকুন আছে, যাদের বাস ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়৷ আইইউসিএন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, চীন ও মালয়েশিয়ার অনেক শকুন এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে৷ ইথিওপিয়া, জিম্বাবুয়ে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা অনেক শকুন এখন হুমকির মুখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এশিয়ার হাতি দ্রুত কমছে
বিশ্বে এখনও এশিয়ান এলিফেন্টের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজার৷ কিন্তু এরাও হুমকির মুখে রয়েছে৷ গত তিন প্রজন্ম ধরে এই প্রজাতির হাতির সংখ্যা কমছে৷ আইইউসিএন বলছে, তিন প্রজন্মে হাতির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান হাতি দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/Horst Galuschka
পাচার ও দাঁত বিক্রির কারণে বিপদ
কেবল এশিয়া নয়, আফ্রিকার হাতিরাও হুমকির মুখে৷ বন উজাড় এবং দাঁতের জন্য শিকারীদের উৎপাতও হাতিদের সংখ্যা কমানোর জন্য দায়ী৷ সেইসাথে অবৈধভাবে শিকার এবং চুরি করে পাচার করাও দিন দিন বাড়ছে৷ হাতি পাচার রোধে এ মাসের ২ থেকে ৪ ডিসেম্বর বতসোয়ানায় ‘আফ্রিকান এলিফেন্ট সম্মেলন’-এর আয়োজন করে আইইউসিএন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিলুপ্তির পথে মাছ
ডলফিনের মত দেখতে এই পরপয়েসদের সচরাচর দেখা যায় ক্যালিফোর্নিয়ায়৷ মাছ ধরার জালে আটকে প্রায়ই মারা যায় এরা৷ কখনো কখনো জেলেরা এদের ধরে নিয়ে যায়৷ ফলে হুমকির মুখে রয়েছে এই প্রজাতিটি৷ বিশ্বে এখন মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ পরপয়েস রয়েছে৷
ছবি: WDC
কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে আশার আলো
কিছু কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে অবশ্য উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেমন লেদারব্যাক কচ্ছপ৷ অথচ এক দশক আগে এই প্রজাতির কচ্ছপটি ছিল রেড লিস্টে, অর্থাৎ হুমকির মুখে৷ দুই মিটার লম্বা এবং আধা টন ওজনের এই কচ্ছপগুলো আকারে সবচেয়ে বড় হয়৷ এদের হুমকির মুখে পড়ার কারণ সাগরের দূষণ৷
ছবি: gemeinfrei
প্রাণী কল্যাণ সংস্থার অবস্থা
এছাড়া ব্ল্যাকব্রোও অ্যালবাট্রসের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে৷ নতুন লাল তালিকায় এই প্রজাতির পাখির আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে৷ আইইউসিএন এর পরিচালক ইয়ান স্মার্ট জানান, অনেক প্রজাতির উন্নতি হলেও এখনও ২১,০০০ প্রাণী হুমকির মুখে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষবার দেখার সুযোগ: পান্ডা, গন্ডার, লিঙ্কস
হুমকির মুখে থাকা প্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম জায়ান্ট পান্ডা৷ বিশ্বে এদের সংখ্যা মাত্র ১০০০ থেকে ২০০০৷ আর আছে সুমাত্রার গন্ডার, যাদের মোট সংখ্যা মাত্র ২২০৷ এছাড়া লাইবেরিয়ার লিঙ্কসও আছে এই তালিকায়৷ এদের সংখ্যা মাত্র ৮০ থেকে ১৫০টি৷ ১৯৬৩ সাল থেকে এই রেড লিস্ট প্রকাশ করে আসছে আইইউসিএন৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
গত ৩০ মার্চ ৮০০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি কুমির বন্যপ্রাণী বিভাগের রেঞ্জারদের হাতে ধরা পড়ে, যেটি গত এক বছরে ভাইরাকার অন্তত ছয় জেলেকে হ্রদে টেনে নিয়ে গেছে৷
বন্যপ্রাণী বিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) চার্লস তুমভেসিগে বলেন, ‘‘আমাদের হাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই৷ মাংসের টোপ দিয়ে কুমির ধরতে গিয়ে আমাদের লোকজন নিজেরাই আহত হচ্ছে৷ তবে সরকার আমাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে৷ আমরা স্থানীয়দের পরামর্শ দিচ্ছি যাতে তাঁরা হ্রদে সাঁতার না কাটেন, বড় নৌকা ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের চেষ্টা করেন৷''
তবে আসল কথাটি এসেছে একজন জেলেরই মুখ থেকে৷ সরাসরি সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন হামজা মুগারিয়া৷
‘‘কুমির মানুষখেকো হচ্ছে এর কারণ লেকে আর পর্যাপ্ত মাছ নেই৷ সরকার এ বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না৷ এমনকি সাত বছরের একটা ছেলেকেও মাছ ধরার অনুমতি দেয়া হচ্ছে!''