অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ছিপছিপে শরীরের আশায় মানুষ কী না করে! স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও শরীর সঞ্চালনের ফলে কিছু উপকার হয় বটে, কিন্তু জিনও এই প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে৷
বিজ্ঞাপন
লাইপসিশ শহরের এক জিন সংক্রান্ত গবেষণাগারে প্রোফেসর পেটার কোভাচ ও তাঁর সহকর্মীরা সেই সব জিনের মধ্যে রদবদল আনার চেষ্টা করছেন, যেগুলি আমাদের ওজন স্থির করে৷ গবেষক হিসেবে প্রোফেসর পেটার কোভাচ মনে করেন, ‘‘মানুষ মোটা হোক বা রোগা থাকুক, সেটা খাদ্যগ্রহণ ও ক্যালরির পরিমাণ এবং শরীর সঞ্চালনের উপর নির্ভর করে৷ কিন্তু ওজন ধরে রাখার বিষয়টি জিনের ওপর নির্ভর করে৷ আমরা সেটি শনাক্ত করে ভালো করে বুঝতে চাই৷''
প্রত্যেক মানুষের শরীরে হাজার হাজার জিন রয়েছে৷ রোমান হরফে এ, সি, টি এবং জি অক্ষর অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা জিনের মধ্যে জোড়া উপাদানের নাম রেখেছেন৷ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এই অক্ষরের প্রভাব মোটামুটি এক৷ তবে কখনো কখনো এই জিনের ভিন্ন রূপ দেখা যায়৷ তখন হয়তো একটি অক্ষর শ্রেণির মধ্যে অন্য এক স্থান পায়৷ সে ক্ষেত্রে মানুষের ওজনের উপর বিশাল প্রভাব দেখা যায়৷
কোন মানুষের ক্ষেত্রে ওজন কমানোর কোন পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো কাজ করবে, তা রোগীর জিনের উপর নির্ভর করে৷ সেই লক্ষ্যে জার্মানির লাইপসিশ শহরে ডাক্তার ও জিন গবেষকরা একযোগে কাজ করছেন৷ প্রোফেসর মাটিয়াস ব্ল্যুয়ার তাঁদেরই একজন৷ তিনি বলেন, ‘‘স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের উৎস সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে আমরা গবেষণা চালাচ্ছি৷ ব্যক্তির প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়াই মূল লক্ষ্য৷''
ওজন কমানো এবং স্লিম থাকার অভিনব ৭ উপায়
ওজন বেড়ে যাওয়া সারা বিশ্বেই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এতে যে দেখতে অসুন্দর লাগে তা-ই নয়, মোটা শরীরে বাসা বাঁধে নানা অসুখ-বিসুখও৷ জেনে নিন, অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া থেকে নিজেকে দূরে রেখে স্লিম থাকার সহজ কিছু ট্রিকস৷
ছবি: Colourbox
চোখের আড়াল, মনের আড়াল
‘চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল’ – এই প্রবাদবাক্যটি ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও কিন্তু খুবই প্রযোজ্য, কারণ, খাবার দেখলেই যে অনেকের খিদে পেয়ে যায়৷ তাই তৈরি বা রান্না করা খাবার অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপার দিয়ে ঢেকে রাখুন, যেন প্রথমেই চোখে না পড়ে৷ খাবার না দেখলে খাওয়ার আগ্রহও কমে যাবে৷ আর এতে স্বাভাবিকভাবেই ওজন কমবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Junos
রান্নাঘরেই টিভি বা কম্পিউটার
টিভি দেখা বা কম্পিউটারে কাজ করার সময় অনেকেই চিপসের প্যাকেট বা এ ধরনের ফ্যাটযুক্ত খাবার সাথে নিয়ে সোফায় আরাম করে বসেন৷ আর সারাক্ষণ খেতে থাকেন৷ এ সব খাবার ওজন বাড়ানোয় বিশেষ ভূমিকা রাখে৷ আপনি যদি টিভি বা কম্পিউটারটা রান্না ঘরেই রাখেন, তাহলে এ সব যন্ত্রই হয়ত আপনাকে খাওয়া থেকে দূরে রাখবে৷
ছবি: Colourbox/Andy Dean Photography
কীভাবে ?
অ্যামেরিকার পুষ্টি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ব্রায়ান ওয়েজনিকের করা এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, কিচেনে বসে বিনোদনমূলক কোনো অনুষ্ঠান দেখার সময় অংশগ্রহণকারীরা কমপক্ষে ২০০ ক্যালোরি কম গ্রহণ করেছেন এবং এতে করে বছরে ১০ কেজি ওজন কমেছে৷
ছবি: Colourbox
সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখুন
রান্নাঘর যতটা গুছানো আর ছিমছাম থাকবে, ওজন কমানো কিন্তু ততটাই সহজ হবে৷ রান্নাঘরে খাবার-দাবার বা জিনিসপত্র একদমই এলোমেলো করে না রেখে যেখানে যা রাখার ঠিকঠাকমতো রাখুন৷ তখন আপনার এমন অনুভূতি হবে যে মনে হবে সবকিছুই আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে, এমনকি আপনার শরীরের ওজনটাও! এতে মানসিক শক্তি পাবেন৷ যে কোনো নতুন কিছু করার জন্য তো এই মানসিক শক্তিই বেশি প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
ফ্রিজ গুছিয়ে রাখুন
যেসব খাবার মোটা করে সেই খাবারগুলো ফ্রিজে ভেতরের দিকে রাখুন৷ আর যেসব খাবার তেমন মোটা করেনা বা ওজন বাড়ায় না, সেগুলো সামনের দিকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখুন৷ কিচেনের গ্লাস লাগানো আলমারিগুলোর ক্ষেত্রেও ট্রিকস প্রযোজ্য৷ অর্থাৎ চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট, বাদাম বা চকলেট জাতীয় খাবার একটু আড়াল করে রাখুন৷
ছবি: Colourbox
টেবিলে ফলমূল রাখুন
রান্নাঘর এবং বসার ঘরের টেবিলে ফলমূল রাখুন৷ বসার ঘরের টেবিলে এমন সব ফল রাখুন যেন হালকা খিদের ভাব হলে তা সেগুলো না কেটেই চট করে মুখে দেওয়া যায়৷ সোজা কথা, খিদের ভাব হলে যেন চোখের সামনে রাখা ফল খেতে পারেন৷
ছবি: Colourbox
ফুলের সুগন্ধ খিদে কমায়
খাবার ঘর বা রান্না ঘরের টেবিলে অন্তত একটি করে তাজা ফুল রাখুন, কারণ, ফুলের সুগন্ধ খাবারের সুগন্ধকে ছাপিয়ে যায়৷ মাঝে মাঝে ফুলের কাছে নাক নিয়ে সুগন্ধ গ্রহণ করুন৷ এতে করে বার বার খাওয়ার ইচ্ছে বা ‘খাই খাই’ ভাবটা দমন হবে৷ যদি তাজা ফুল রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে মাঝে মাঝে ঘরের ভেতর গোলাপ বা জেসমিন ফুলের গন্ধযুক্ত ‘রুম স্প্রে’ ছড়িয়ে দিন৷ সুবাসিত মোমবাতি জ্বালিয়েও কিন্তু একই ফল পেতে পারেন!
ছবি: Colourbox
7 ছবি1 | 7
এখনো অতিরিক্ত ওজনের মানুষকে জিনভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি৷ গবেষকরা এখনো পর্যন্ত প্রায় ২১ লক্ষ জিন শনাক্ত করেছেন, ওজনের উপর যেগুলির প্রভাব রয়েছে৷ তবে একভাবে শরীরের ওজনের উপর এসব জিনের প্রভাব অত্যন্ত কম৷ প্রোফেসর পেটার কোভাচ মনে করেন, ‘‘এটা ঠিক যে এই সব জিনের প্রভাব অত্যন্ত কম৷ এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী জিনও বড়জোর দুই কিলো পার্থক্য আনতে পারে৷''
সবচেয়ে পরিচিত ও প্রভাবশালী জিনের নাম এফটিও৷ সেটি আমাদের মেদের কোষে মেদ ঝরানোর কাজ করে৷ অর্থাৎ, মেদ জমবে না ঝরবে, এই জিনই সেটা স্থির করে৷ আমাদের শরীরে মোট তিন ধরনের ফ্যাট সেল রয়েছে৷ সাদা কোষ মেদ জমায়৷ খয়েরি কোষ মেদ ঝরায় ও সেটা করতে গিয়ে উত্তাপ সৃষ্টি করে৷ তৃতীয়ত, ধূসর ফ্যাট সেল একইসঙ্গে মেদ ঝরাতে এবং জমা রাখতে পারে৷ কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এফটিও জিন মেদ শুধু জমাতে পারে, কিন্তু ভালো করে ঝরাতে পারে না৷ ফলে ওজন বেড়ে যায়৷
জিমে যাওয়ার আগে যা করবেন
শীতকালে ওজন বেড়ে গেছে বা নিজের অতি পছন্দের পোশাকগুলো আর হচ্ছে না? চিন্তা নেই৷ কারণ মাত্র কয়েক সপ্তাহ জিমে গেলেই আপনি আপনার কাঙ্খিত ওজন ফিরে পারেন৷ তবে তার আগে ঠিক কী কী করতে হবে জেনে নিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রথম কথা
যে কোনো বয়সেই মানুষ ব্যায়াম শুরু করতে পারে৷ শরীরের পেশিগুলোকে শক্ত বা মজবুত রাখতে ও ফিট থাকতে বয়সের চিন্তা ছাড়াই ব্যায়াম শুরু করুন৷ এর জন্য সহজ পথ জিমে যাওয়া৷ তবে যারা কখনো জিমে যাননি, তাদের প্রাথমিক কিছু নিয়ম অবশ্যই ভালো করে জেনে নিতে হবে৷ তা না হলে পরে অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে৷
ছবি: Imago/Westend61
শরীরকে গরম বা ‘ওয়ার্ম আপ’ করে নিন
যে কোনো রকম খেলাধুলা বা ব্যায়াম করার সময় সবরকম ব্যথা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আগেই শরীরকে গরম করে নেয়া জরুরি৷ কারণ ব্যায়ামের সময় শরীরে রক্ত সঞ্চালণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়৷ এতে করে শরীরে তেমন কোনো চাপ অনুভূত হয় না আর মস্তিষ্কও সচল থাকে৷ এ কথা জানান জার্মানির অন্যতম অর্থপেডিক্স ও ক্রিড়া বিষয়ক ডাক্তার অ্যার্নস্ট-হেলমুট শোয়্যার৷
ছবি: DW
গতি বাড়াতে হবে ধীরে
ব্যায়াম শুরু করার সাথে সাথে শরীর ও মন ভালো থাকলে, ভালো লাগলে আনন্দের কথা অবশ্যই৷ কিন্তু তাই বলে চট করে এর গতি না বাড়িয়ে বা বেশি বেশি ব্যায়াম না করে বরং ধাপে ধাপে গতি এবং মাত্রা বাড়ান৷ হঠাৎ করে বাড়ালে প্রথমে তা বোঝা না গেলেও, পরে কিন্তু বেশি চাপে আগ্রহ কমে যেতে পারে এবং শরীরেও নানারকম ব্যথা হতে পারে৷
সপ্তাহে তিনদিন ব্যায়াম করা বা জিমে যাওয়াই যথেষ্ট৷ কারণ এতে শরীরের বিশ্রাম যেমন হয়, তেমনি ভালোভাবে, সবরকম নিয়ম মেনে ব্যায়াম করাও সম্ভব৷ আর ধীরে ধীরে ওজন কমলে তা ধরে রাখাও হয়ত কিছুটা সহজ হবে৷ আসলে যে কোনো নতুন নিয়মের সাথে নিজেকে একাত্ম করতেও কিছুটা সময় লাগে বৈকি!
ছবি: Colourbox/unbekannt
সঠিক পোশাক এবং জুতো
যে কোনো পোশাক ও জুতো পরে ব্যায়াম করলে অনেক সময় তাতে উপকারের চেয়ে অপকারই হতে পারে৷ তাই এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে এ সব জিনিস কেনা উচিত৷ আজকাল অবশ্য প্রায় সব জায়গাতেই, মানে সব বড় বড় দোকানেই ব্যায়ামের উপযুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত পোশাক পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রযুক্তির ব্যবহারে সাহায্য নিন
জিমে যেসব যন্ত্রপাতি থাকে, সেগুলো ব্যবহারের নিয়মগুলো প্রথমে ট্রেইনারের কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত৷ এমনটা করলে পেট, নিতম্ব বা বাহুর চর্বি কমিয়ে পেশি শক্ত করে কাঙ্খিত ফিগার পাওয়া সহজ হবে৷ তবে নিয়ম জেনে না নিলে, যন্ত্রপাতির ভুল ব্যবহারে কিন্তু শরীরে অনেকরকম ক্ষতিও হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Hans Wiedl
যথেষ্ট পানি পান করতে হবে
ব্যায়াম করার সময় যথেষ্ট ঘাম হয়, তাই শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যায়ামের আগে-পরে এবং ব্যায়াম করার সময় যথেষ্ট পানি পান করতে হবে৷ তা না হলে ব্যায়াম করার সময় মাথা ঘুরে যেতে পারে৷ তবে চিনি মেশানো কোনো পানীয় নয়৷ স্বচ্ছ পানি পানই এক্ষেত্রে শ্রেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সতর্ক থাকুন
ব্যায়াম করার পর শরীরের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, শরীরে এর ঠিক কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে৷ ব্যায়াম করার সময় বা জিমে বিশেষ কোনো ‘এক্সসারসাইজ’ করার সময় কোনোরকম ব্যথা বা অন্য কোনো অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্রাম নিতে হবে৷ তাই প্রয়োজনে ট্রেনারের পরামর্শ নিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/britta pedersen
আনন্দ করে ওজন কমান
গ্রুপের সাথে ব্যায়াম করলে আনন্দ বেশি হয়৷ তবে শরীর এবং মন দু’টোর জন্যই ভালো হয় গ্রুপ এবং একা – এই দু’ভাবে ব্যায়াম করা৷ একা ব্যায়াম করা যেমন মনযোগ এবং আত্মনির্ভরতা বাড়ায়, তেমনই গ্রুপে ব্যায়াম করলে নিজের অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করা যায়৷ জানান ডাক্তার অ্যার্নস্ট-হেলমুট শোয়্যার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
অন্য একটি প্রভাবশালী জিন হলো এমসিফোরআর৷ সেটি খিদের অনুভূতি সৃষ্টি করে৷ সেটির কিছু রূপ মানুষের মধ্যে খিদের অনুভূতি দাবিয়ে রাখে৷ ফলে সেই মানুষটি রোগা থাকেন৷ অন্য কিছু রূপ আবার সব সময়ে খিদের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে৷
জিনের এমন রূপ থাকলে কখনোই খিদে মেটে না৷ তখন অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে ওজনও বেড়ে যায়৷ প্রোফেসর ব্ল্যুয়ার বিষয়টির উপর আলোকপাত করে বলেন, ‘‘অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে কোনো জিন হয়তো নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়৷ খাদ্যগ্রহণের মাঝের ফারাক বাড়িয়ে অথবা কম ক্যালরির খাবার খাইয়ে আচমকা সেটি সক্রিয় করে তোলা যেতে পারে৷ তখন চর্বির মেটাবোলিজম অথবা শর্করার মেটাবোলিজম আরো ভালোভাবে কাজ করে৷ ফলে ওজন কমাতে সুবিধা হয়৷''
মোটকথা, আমরা জিনের ক্রিয়ার সামনে মোটেই অসহায় নই৷ তবে এখনো ওজন কমাতে চাইলে শরীর সঞ্চালন ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই৷