নামিবিয়ার এক প্রত্যন্ত প্রদেশে হাতিরা হেলেদুলে পথ চলেছে ন্যাশনাল হাইওয়ে পার হয়ে৷ মানুষ, পাঁচটি দেশ, সেই পাঁচটি দেশের রাজনীতি, কত বাধা পার হয়ে হাজার হাজার বছরের চেনা পথে হাতিদের পরিভ্রমণ৷
বিজ্ঞাপন
তৃষ্ণা, পিপাসা, তেষ্টা৷ পানির জন্যই হাতির পাল ভোরবেলা নদীতে আসে৷ উত্তর-পূর্ব নামিবিয়ার কোয়ান্ডো নদীতে সবসময় জল থাকে৷ কাজেই তৃষ্ণার্ত গ্রীষ্মের দিনগুলিতে এখানে হাতিদের ভিড়৷ কিন্তু এলাকাটিতে ক্রমেই আরো বেশি মানুষ বসবাস করতে আসছে৷ এরা গরিব চাষি, যারা খেতের ফসলের উপর নির্ভর করে৷ হাতিদের হাত, পা, কিংবা শুঁড় থেকে কীভাবে ভুট্টার ক্ষেত বাঁচানো যায়, তাই নিয়েই রেমন্ড কিটুম্বেকা-র চিন্তা৷ রেমন্ড শোনালেন সে কাহিনি৷ বললেন, ‘‘সাতটা হাতি এসেছিল৷ আমরা আওয়াজ পেয়েই দৌড় লাগিয়েছি, তাদের তাড়ানোর জন্য৷ কিন্তু হাতিরা মানুষকে ভয় পায় না, তারা পালায়ও না৷ বরং খেতের ফসল নষ্ট করে৷ তারপর আমরা জানি না, আমরা কী খেয়ে বাঁচব৷ জীবনের ভয়ও থাকে৷''
ডাইনোসর বিলুপ্ত, এবার হাতিও কি ধীরে ধীরে যাবে?
অতিকায় ডাইনোসর আর নেই৷ এখনো টিকে থাকা স্থলচরদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণী হাতিও কি এবার বিলুপ্ত হয়ে যাবে? আন্তর্জাতিক হাতি দিবসে প্রশ্নটা খুব বড় হয়ে উঠেছে৷ ছবিঘরে দেখুন কেন এবং কীভাবে খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে হাতি৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/M. Hicken
আর মাত্র ১০ বছর?
হাতি যে হারে কমছে, তাতে ১০ বছর পর চিড়িয়াখানা ছাড়া আর সব জায়গা থেকে এই প্রাণীটির চিহ্ন মুছে গেলে নাকি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না৷ আশঙ্কাটা যে মোটেই বাড়াবাড়ি নয়, তা দুটো তথ্য দিলেই বুঝতে পারবেন৷ একশ’ বছর আগে আফ্রিকায় মোট এক কোটি হাতি ছিল৷ এখন সেখানে মাত্র সাড়ে চার থেকে সাত লাখের মতো হাতি টিকে আছে৷ এশিয়ায় আছে মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ হাজার হাতি৷ গত দশ বছরে নাকি সারা বিশ্ব থেকে ৬২ ভাগ হাতি কমেছে!
ছবি: picture-alliance/R. Harding
দাঁতের জন্য মরছে হাতি
কথায় আছে, মরা হাতির দাম লাখ টাকা৷ সত্যিই তাই৷ বিশেষ করে হাতির দাঁত তো হীরা-মুক্তা-জহরতের মতোই মূল্যবান৷ সেই দাঁতের লোভে আফ্রিকার জঙ্গল থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে একশ’টি হাতি মারা হয়৷ হাতির দাঁত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় চীনে৷ গত জুলাই মাসে জুরিখ বিমানবন্দরে ২৬২ কিলোগ্রাম ওজনের হাতির দাঁতসহ ধরা পড়ে এক চীনা নাগরিক৷
ছবি: Reuters/R. Sprich
জঙ্গিদের টাকার উৎসও হাতি!
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অবৈধ ব্যবসা এই হাতির দাঁতের কেনাবেচা৷ মাদক এবং মানবপাচারের পরই এর স্থান৷ অনেক যু্দ্ধ-দাঙ্গা-হাঙ্গামার পেছনেও ভূমিকার রাখে হাতির দাঁত৷ আফ্রিকা অঞ্চলের দুই ইসলামি জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম এবং আল-শাবাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্র কেনে হাতির দাঁতের বিনিময়ে!
ছবি: picture-alliance/AP Photo/African Parks
জঙ্গল কমছে, কমছে হাতি
জনসংখ্যা বাড়ছে৷ আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ পড়ছে জঙ্গলের ওপর৷ মানুষ জঙ্গল কেটে সেখানে গড়ছে বাসস্থান, কলকারখানা৷ ফলে জঙ্গলের প্রাণীরা পড়ছে বিপদে৷ হাতির জন্যও জঙ্গল ক্রমশই কমছে, বাড়ছে বিপদ৷ গত এক শতকে আফ্রিকার জনসংখ্যা চারগুণ বেড়েছে৷ হাতির সংখ্যা সেখানে এক কোটি থেকে কমে সাত লাখ বা তারও কম হওয়াই তো স্বাভাবিক, তাই না?
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Gambarini
হাতিরক্ষায় তৎপর ওবামা
চীনের পর হাতির দাঁত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় যুক্তরাষ্ট্রে৷ তবে ধীরে ধীরে হয়ত সেখানে অবৈধ এ ব্যবসাটা কমবে৷ গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এই ব্যবসা একেবারে বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/M. Hicken
5 ছবি1 | 5
তবে রেমন্ড কিটুম্বেকা-কে সাহায্য করার লোক আছে৷ বেনেটি লিকুকেলা নামিবিয়ার একটি পরিবেশ সুরক্ষা সংগঠনের হয়ে কাজ করেন৷ চেষ্টা করেন, হাতি ও মানুষের মধ্যে সংঘাত এড়ানোর৷ অনেক সময় সহজ পন্থাতেই সেটা সম্ভব হয় এমন সব পদার্থ ব্যবহার করে, চাষিরা যা সহজেই পেতে পারেন৷
লঙ্কার ধোঁয়া
আইআরডিএনসি পরিবেশ সুরক্ষা সংগঠনের বেনেটি লিকুকেলা জানালেন, ‘‘আমরা হাতির মলের সঙ্গে লঙ্কা মেশাই৷ এর লক্ষ্য হলো, হাতির পাল হানা দেওয়ার ফলে যে সব চাষিরা তাদের ফসল হারিয়েছেন, সেই সব চাষিদের সাহায্য করা৷ আমরা হাতি তাড়ানোর জন্য লঙ্কা ব্যবহার করি কেননা লঙ্কার ধোঁয়া হাতিদের নাকে আরো বেশি করে লাগে৷ হাতিরা মানুষের তুলনায় এক'শ গুণ বেশি ভালো শুঁকতে পারে কিনা!''
মরিচের ঘুঁটের ধোঁয়ায় নাকমুখ জ্বালা করে, যেন কাঁদানে গ্যাস৷ এখানে এত মানুষ বাস করা সত্ত্বেও হাতিদের জন্য জায়গা থাকবে – এই হলো বেনেটি লিকুকেলা-র লক্ষ্য৷ হাতিরা যে সব পথে হাজার হাজার বছর ধরে পরিভ্রমণ করছে, সেই সব রুটগুলো তাদের ফিরিয়ে দেওয়াই হলো মূল কথা৷ এখন তাদের বেঁচে থাকার মতো পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে৷ এলাকার রেঞ্জাররা নিয়মিতভাবে মুক্ত ‘করিডর'-গুলো ঘুরে দেখেন, হাতিদের গতিবিধির উপর নজর রাখেন আর চাষিদের যাতে বিপদ না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখেন৷ লিকুলেলা জানালেন, ‘‘হাতিদের পরিভ্রমণের যে পথটি বোটসোয়ানা থেকে জাম্বিয়া আর অ্যাঙ্গোলার দিকে চলে গেছে, আমরা তার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছি৷ দুঃখের বিষয়, পথটা ট্রান্স-জামবেজি হাইওয়ের উপর দিয়ে গেছে, যার ফলে হাতি ও মানুষ, উভয়েরই বিপদ ঘটতে পারে৷''
সৈন্য হিসেবে প্রাণী
যুদ্ধে জন্তু-জানোয়ারের ব্যবহার সেই আদিকাল থেকে৷ আগে যোদ্ধারা হাতি কিংবা ঘোড়ার পিঠে করে যুদ্ধের ময়দানে যেতেন, আর এখন প্রাণীদের ব্যবহার করা হয় গোয়েন্দা সহ শান্তিপূর্ণ নানান কাজে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Neubau
গোয়েন্দা ডলফিন
ক’দিন আগে ইসরায়েলের এক গোয়েন্দা ডলফিনকে গ্রেপ্তারের দাবি করেছে হামাস৷ ঐ ডলফিনের গায়ে নাকি ক্যামেরা আর ক্ষুরধার তীর লাগানো ছিল৷ সাগরের পানির নীচে মাইন আছে কিনা – তা জানতে বিশ্বজুড়ে নৌ-বাহিনীর সদস্যরা অনেকদিন থেকেই ডলফিনের সহায়তা নিচ্ছেন৷ সোনারের মাধ্যমে ডলফিন মাইন খোঁজার কাজটি করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Alan Evans
মৌমাছি
প্রাচীনকালে গ্রিক ও রোমানরা শত্রুদের কাবু করতে মাঝেমধ্যে প্রাসাদের দিকে মৌমাছির চাক ছুড়ে মারত৷ তবে আজকাল একটু শান্তিপূর্ণ ভূমিকায় মৌমাছিদের দেখা যায়৷ ল্যান্ডমাইন শনাক্ত করার কাজে তাদের ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: Colourbox.com
সি লায়ন
ডলফিনের মতোই সামুদ্রিক সিংহ পানির নীচে মাইন শনাক্ত ও গোয়েন্দাগিরির কাজ করে৷ এছাড়া তারা সন্দেহজনক কোনো মানুষকে আঘাত করে আহত করতে পারে, যেন পরবর্তীতে ঐ সন্দেহভাজনকে টেনে উপরে তোলা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Ude
আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বাদুড়
মার্কিন নৌবাহিনী একসময় বাদুড়ের গায়ে বোমা বসিয়ে সেগুলো জাপানের শহরগুলোতে বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেছিল৷ কিন্তু এই কাজে বাদুড় মানুষকে ততটা সহায়তা না করায় ঐ পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন মার্কিন নৌ সেনারা৷
ছবি: Karl-Heinz Bickmeier/NABU
হাতি
যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির ব্যবহার প্রথম শুরু হয় ভারতে৷ এরপর সেটা পশ্চিমা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে৷ গ্রিক জেনারেল ‘পিরাস অফ এপিরাস’, হানিবাল এঁরা যুদ্ধে হাতি ব্যবহারে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Usis-Dite/Leemage
কুকুর
প্রাচীনকালে শত্রুদের আঘাত করতে, নিজের সীমানা সুরক্ষিত রাখতে কুকুরের সাহায্য নেয়া হতো৷ তবে আজকাল তথ্যের বাহক হিসেবে, ট্র্যাকিং করতে কুকুর ব্যবহৃত হয়৷ সাম্প্রতিককালে ইরাক ও আফগানিস্তানে বোমা খোঁজার ক্ষেত্রে মার্কিন সামরিক বাহিনী কুকুরের সাহায্য নিয়েছে৷ সেক্ষেত্রে অনেক সময় কুকুরকে বুলেট প্রুফ বর্ম পরিয়ে দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Ben Birchall
ঘোড়া
একটা সময় ছিল যখন ঘোড়া ছাড়া যুদ্ধের কথা ভাবাই যেত না৷ সব অঞ্চলের প্রায় সব সেনাবাহিনীই যুদ্ধে ঘোড়া ব্যবহার করেছে৷ পরবর্তীতে ট্যাঙ্ক আর মেশিনগানের মতো আধুনিক অস্ত্র আসার পর ঘোড়ার ব্যবহার কমে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Neubau
7 ছবি1 | 7
বাধাবিপত্তি
শুধু হাইওয়ে পার হওয়াই নয়, হাতিদের মাইগ্রেটরি রুট বিভিন্ন দেশের সীমান্ত পার হয়ে গেছে৷ কাজা, অর্থাৎ কাভাঙ্গো-জামবেজি সংরক্ষিত এলাকা আয়তনে ফ্রান্সের সমান – পাঁচটি দেশ এর মধ্যে পড়ে৷ রাজনৈতিক প্রতিবন্ধক ছাড়া আরো অনেক বাধাবিপত্তি দূর করতে হয়েছে৷ জাম্বিয়ার পরিবেশ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জেমস সাম্বি জানান, ‘‘এখানে একটা বেড়া ছিল৷ বেড়াটা এখান থেকে শুরু হয়ে ডিভুন্ডু অবধি প্রায় দু'শ কিলোমিটার গেছে৷ কাজেই বেড়াটা ৭০ কিলোমিটার সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷''
আনুমানিক দু'লক্ষের বেশি হাতি কাজা সংরক্ষিত এলাকার বাইরে থাকে৷ সারা বছর ধরে তারা শত শত কিলোমিটার পরিভ্রমণ করে – ন্যাশনাল পার্কের বাইরেও৷ তবে সেখানেও আজ তারা মোটামুটি নিরাপদ, কেননা বহু গ্রাম ও এলাকা এই সব বন্য জীবজন্তু থাকার ফলে লাভবান হয়৷ অনেকে তাদের নিজস্ব সুরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি করেছে৷ বেনেটি লিকুকেলা এলাকার পৌরপ্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন৷ স্থানীয় মোড়লদের উৎসাহের কারণেই হাতিদের দীর্ঘ পরিভ্রমণের পথগুলি খোলা রাখা সম্ভব হয়েছে৷
মানুষ যা মূল্যবান বলে মনে করে, মানুষ তা রক্ষাও করে৷ উত্তর-পূর্ব নামিবিয়ায় পরিবেশ সুরক্ষা এই সহজ নীতিটির উপর ভিত্তি করে৷ শুধু সেই কারণেই হাতিরা তাদের নিজস্ব পথে যেতে পারে, যদিও পথে মানুষের তৈরি কিছু কিছু বাধা পড়তে পারে বৈকি!