১২৯ জন তাবলিগের প্রচারক চিকিৎসার স্বার্থে নিজেদের রক্ত দিতে রাজি হয়েছেন। করোনা হয়েছিল তাঁদের। এখন সুস্থ। ডাক্তাররা তাঁদের রক্ত থেকে প্লাজমা নিয়ে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার করবেন।
বিজ্ঞাপন
১৮৯৮ সাল। গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্লেগ মহামারি। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে মৃতদেহ। ঘরে ঘরে আতঙ্ক। প্লেগ থেকে বাঁচতে সে দিন বাংলা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বহু মানুষ। তেমনই দুর্দিনে স্বামী বিবেকানন্দ, সিস্টার নিবেদিতা রাস্তায় নেমেছিলেন সাধারণ মানুষের সেবার কাজে। প্লেগ এবং গুজবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি ম্যানিফেস্টো বা ইস্তাহার লিখেছিলেন বিবেকানন্দ। আরও অনেক উপদেশের সঙ্গে সেখানে বলা হয়েছিল, পালিয়ে যাবেন না। মানুষের সেবার কাজে নামুন। কারণ মানুষের ভিতরেই ঈশ্বর আছেন। রোগ জর্জরিত মানুষের সেবা করার অর্থই হলো ঈশ্বরের সেবা করা।
দীর্ঘ ১২২ বছর পরে দিল্লিতে করোনায় আক্রান্ত তাবলিগ-ই-জামাতের প্রচারকরা সে কথাই যেন ফের একবার বুঝিয়ে দিলেন নিজেদের মতো করে। বুঝিয়ে দিলেন, যতই গুজব ছড়াক, এক শ্রেণির রাজনীতি যতই তাঁদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করুক, মানবসেবাই আসলে সব চেয়ে বড় ধর্ম। দিল্লির এইমস এবং ঝাজ্জর হাসপাতালে ভর্তি ১২৯ জন তাবলিগের সদস্য জানিয়েছেন, প্লাজমা চিকিৎসার জন্য তাঁরা রক্ত দিতে চান। যাতে তার সাহায্যে আরও অনেক করোনা রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়।
করোনায় রোজা, করণীয় কী?
মুসলিমদের সবচেয়ে পবিত্র মাস রমজান এসেছে৷ কিন্তু করোনা মহামারি এবারের রমজানকে দিয়েছে অন্য এক রূপ৷ নিজে ও প্রিয়জনকে নিরাপদে রেখে কিভাবে পালন করা যাবে এ মাস?
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
করোনাকালে রমজান, কিছু পরামর্শ
রমজান মাসকে বিশ্বজুড়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা দেখে থাকেন দানশীলতা, সংযম, আত্মশুদ্ধি ও প্রার্থনার মাস হিসেবে৷ একসঙ্গে নামাজ পড়া ও সারাদিনের রোজা শেষে ইফতার ভাগাভাগি করে নেয়াকেও দেয়া হয় গুরুত্ব৷ কিন্তু চলমান করোনা মহামারি এবারের রমজানকে সবার সামনে হাজির করেছে একটু অন্যভাবে৷ সব দেশের জন্যই এ বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
রোজা রাখতে ঝুঁকি নেই
রোজা রাখলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে, এমন কোনো তথ্য এখনও কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি৷ ফলে স্বাভাবিক সময়ের মতোই রোজা রাখতে সুস্থ মানুষের কোনো বাধা নেই৷ কিন্তু ধর্মীয় বিধি অনুযায়ীও নানা রোগের ক্ষেত্রে রোজা রাখায় ছাড় দেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ সেক্ষেত্রে চিকিৎসক ও ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত পানি
কোভিড-১৯ এর কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি৷ ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপরই এখন পর্যন্ত ভরসা৷ তাই সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার ও সেহরিতে নানা ধরনের সুষম খাবারের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে৷ এছাড়া গরমের ফলে পানিশূন্যতা দূর করতে ইফতার ও সেহরির মধ্যে পর্যাপ্ত পানিও পান করা খুব জরুরি৷
ছবি: Colourbox/Haivoronska_Y
শারীরিক কার্যক্রমে জোর
অন্যসময় রোজা রেখেও কাজকর্ম করার ফলে শরীরে রক্ত চলাচল ও অন্যান্য কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকতো৷ কিন্তু করোনার কারণে মানুষের চলাচল সীমিত হওয়ায় কমেছে শারীরিক কার্যক্রমও৷ এজন্য বিজ্ঞানীরা জোর দিচ্ছেন বাসার মধ্য়েই নিয়মিত হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাচলা করার জন্য৷ তা না হলে রোজায় শরীরে পড়তে পারে বিরূপ প্রভাব৷
ছবি: Colourbox
শুভেচ্ছা ও সম্ভাষণ
কারো সঙ্গে দেখা হলে হাত মেলানোর রীতি থাকলেও, এবার শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সম্ভাষণ জানানোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছে৷ অনেক দেশে ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতি অনুযায়ী সালাম দেয়া, মাথা নাড়া বা বুকে হাত দিয়ে সম্ভাষণ জানানো হয়৷ এ বছর করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে এমন সম্ভাষণকেই স্বাগত জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরাও৷
ছবি: DW/A. Ansari
ঝুঁকিতে থাকাদের বিশেষ ব্যবস্থা
নভেল করোনা ভাইরাস সব বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করলেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা৷ এছাড়া যারা ডায়বেটিস, রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের রোগ, শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন, তারাও রয়েছেন কোভিড-১৯ এ সবচেয়ে ঝুঁকিতে৷ ফলে রমজানের সময়টাতে এই ব্যক্তিদের সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সামাজিক দূরত্ব
বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও তারাবিসহ অন্যান্য নামাজ মসজিদের বদলে বাসায় পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে৷ কিন্তু তারপরও ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিনসহ যাদের মসজিদে যেতেই হবে, তাদেরও নিজেদের মধ্যে অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে৷ এছাড়া ইফতার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটার জন্য যারা দোকানে বা বাজারে যাবেন, তাদেরও ভিড় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
প্রতিবার নামাজের আগে ওজুর ফলে এমনিতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত হয়৷ কিন্তু এবার একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলছেন চিকিৎসকেরা৷ শুধু পানির বদলে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে সাবান ব্যবহারের৷ মসজিদেও পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা সরঞ্জাম, টিস্যু, ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে৷ পাশাপাশি প্রতিবার নামাজের আগে-পরে কার্পেটসহ মসজিদ ভবনের অন্যান্য ব্যবহার্য বস্তু পরিষ্কার করারও আহ্বান জানানো হচ্ছে৷
ছবি: Imago Images/allover-mev
যাকাত ও সদকা
রমজান মাসে মুসলিমদের দানশীলতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়৷ তবে যাকাত বা সদকা দেয়ার সময়ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে৷ যাতে একসঙ্গে বেশি মানুষ জড়ো না হন, সেজন্য এলাকার সবাই মিলে বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শৃঙ্খলাবদ্ধ উপায়ে পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: DW/H.U.R. Swapan
মানসিক স্বাস্থ্য
লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব ইত্যাদি মানতে গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য পড়ছে হুমকির মুখে৷ রমজানে ধর্মপ্রাণ মানুষ মসজিদে যেতে ও সামাজিক যোগাযোগ বেশি পছন্দ করেন৷ কিন্তু এ বছর তাদেরকে থাকতে হচ্ছে কড়া বিধিনিষেধের মধ্যে৷ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও যে আত্মশুদ্ধি, প্রার্থনা, দান, সেবা, সবই করা সম্ভব তা প্রচার করার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারে পাশাপাশি ধর্মীয় নেতাদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: picture alliance/empics/D. Lipinski
10 ছবি1 | 10
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে, লকডাউন শুরু হওয়ার আগে দিল্লির নিজামুদ্দিন অঞ্চলে তাবলিগের মারকাজে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। দেশ বিদেশ থেকে কয়েক হাজার প্রচারক সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। মার্চের শেষ সপ্তাহে জানা যায়, সেই সমাবেশে যোগ দেওয়া বহু প্রচারক করোনা-আক্রান্ত। যা নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক রাজনৈতিক আক্রমণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ভুয়া খবর, ছবি। ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয় সমাজ। রাজনীতি রাজনীতির পথে হেঁটেছে। মানব ধর্ম মানব ধর্মের পথে। তাবলিগের প্রচারকরা সে কথা আরও একবার শুধু বুঝিয়ে দিলেন না, জিতিয়ে দিলেন মুনুষ্যত্বকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত সপ্তাহেই দিল্লির সরকার জানিয়েছে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুরনো প্লাজমা চিকিৎসায় সাফল্য মিলছে। অর্থাৎ, করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন কিন্তু এখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন এমন রোগীদের রক্ত থেকে প্লাজমা নিয়ে তা অসুস্থ রোগীর শরীরে দিলে তাঁদের শরীরেও পৌঁছে যাচ্ছে করোনার সঙ্গে লড়াইয়ের অ্যান্টিবডি। এবং তাতে লাভ হচ্ছে। বস্তুত, তাবলিগের প্রচারকদের পাশাপাশি আরও বহু সাধারণ মানুষ দিল্লির বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে রক্ত দিতে চেয়েছেন। তাঁরাও গত এক মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
শুধু তাবলিগ নয়। মানবতার এই লড়াইয়ে আরও অনেকেই যোগ দিয়েছেন। পুনেতে একটি মসজিদ কোয়ারান্টিন সেন্টার তৈরির জন্য ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সরকার বিবেচনা করে দেখছে সেখানে রোগীদের রাখার ব্যবস্থা করা যায় কি না। এর অনেক দিন আগেই দিল্লির বিখ্যাত মনজু কা টিলা অঞ্চলে বহু পুরনো একটি গুরুদ্বার কোয়ারান্টিন সেন্টার তৈরির জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের অন্যত্রও গুরুদ্বার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কোয়ারান্টিন সেন্টারের জন্য। দিল্লি সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিখরা দুস্থ মানুষদের জন্য বিনামূল্যে খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। যাকে বলা হয় লঙ্গর। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় নিরলস ভাবে সেখানে খাবার তৈরি করে তুলে দেওয়া হচ্ছে গরিব মানুষের হাতে।
মুম্বইয়ে সাঁইবাবার আশ্রম সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে যা ব্যবহার করা হবে। একই কাজ করেছে কোলহাপুর মন্দির। পরিসংখ্যান তথ্য বলছে, দেশের মোট অর্থের একটি বড় অংশ রয়েছে বিভিন্ন ধর্মস্থানের হাতে। সারা বছর ভক্তরা যে টাকা দান বা প্রণামী হিসেবে ধর্মস্থানে দেন। বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সেই অর্থ ব্যয় করছে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবে। বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘের মতো মঠ এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষের সাহায্যে।
এটাই বাস্তব। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ ভাবেই সমস্ত ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখনও যাঁরা, করোনার সংক্রমণ নিয়ে রাজনীতি করে চলেছেন, ধর্মীয় বিভেদ তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, বিবেকানন্দের ভাষায় তাঁরা 'ভগবানের নিকট মহা পাপ, মহা অপরাধ' করছেন। বিভেদ নয়, আমাদের ধর্ম হোক, মানবসেবার। ধন্যবাদ তাঁদের, যাঁরা স্বেচ্ছায় সেই সেবা কাজে নেমে পড়েছেন।