ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হান্স হার্ডার বলেছেন, ‘‘এত লোক ফরাসি পড়ছে, স্প্যানিশ পড়ছে৷ বাংলা কেন পড়ছে না সেটাই আমার প্রশ্ন৷''
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দীন জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হান্স হার্ডারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন৷ সেখানে অধ্যাপক হার্ডার বাংলা সাহিত্য, ভাষা, রাজনীতি ও জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন৷ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা এই জার্মান অধ্যাপককে প্রশ্ন করা হয়, বাণিজ্যিক মূল্য না থাকলে কেন মানুষ নির্দিষ্ট একটি ভাষা শিখবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বাংলা কিন্তু দুনিয়ায় ষষ্ঠ বা সপ্তম স্থানে৷ সংখ্যার দিক থেকে৷ তাহলে এমন একটি ভাষা পড়লে কিছু হবে না? নিশ্চয়ই হবে৷ এত লোক ফরাসি পড়ছে, স্প্যানিশ পড়ছে৷ বাংলা কেন পড়ছে না সেটাই আমার প্রশ্ন৷''
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্তরা তাদের বাচ্চাদের ইংরেজি মিডিয়ামের দিকে বেশি ঝুঁকিয়ে দিচ্ছেন, সেটাতে দোষ নেই যদি তারা নিজের ভাষাকেও যথেষ্ট সম্মান দিতে পারেন৷ ‘‘মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মধ্যে বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ হোক, (ইংরেজির দিকে ঝুঁকে পড়া) এটা ঘটছে৷ আমি এটার বেশি সমালোচনা করব না৷ এটা হয়৷ কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন দু'টো ভাষাই শিখতে পারে৷ নিজের ভাষার অবহেলা করা একটা আত্মবিরোধ,'' বলেন হার্ডার৷
অধ্যাপক বলেন, একটি ভাষায় আরেকটি ভাষার শব্দ যেমন ঢুকে যেতে পারে, তেমনি প্রত্যেক ভাষাকে নিজের স্বকীয়তাও বজায় রাখতে হবে৷
‘‘৫০ বা ৬০টা ইংরেজি শব্দ আমার জার্মান ভাষায় ঢুকলে কী হবে? কিছুই হবে না৷ তবে ভাষাগুলোকে একটু আলাদাও রাখা দরকার৷''
তিনি যোগ করেন, ‘‘বাংলাদেশ, জার্মানি, ফিনল্যান্ড হোক, ইংরেজি ছাড়া আমরা পারছি না৷ ইংরেজি দরকার৷ বিশ্বায়নের ফলে সবাই সবার সঙ্গে কথা বলছে, তাই একটা আন্তর্জাতিক ভাষা দরকার৷ কিন্তু সুন্দর একটা সমন্বয়, সমঝোতাও দরকার৷ ইংরেজি ভাষার জন্য আমরা আমাদের ভাষা বাদ দেব, প্রত্যাখ্যান করব, তা ঠিক নয়৷ এটা সাংস্কৃতিক শিক্ষার অভাব বা সাংস্কৃতিক বোকামি৷''
বাংলা সাহিত্য নিয়ে হার্ডার বলেন, এখানকার সাহিত্যে ঔপনিবেশিক বা ইউরোপের প্রভাব আছে৷ কিন্তু অনেক কাজই মৌলিক৷ এখানকার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির নিজস্ব স্বকীয়তা আছে বলে মনে করেন তিনি৷
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়সহ জার্মানি উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো গন্তব্য বলে মনে করেন হার্ডার৷ তিনি বলেন, ‘‘আপনি যদি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বা অ্যামেরিকার সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে এখানে উচ্চশিক্ষার খরচ নেই বললেই চলে৷''
জার্মানিতে পড়তে আসার আগে যা যা জানা প্রয়োজন
প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নিতে আসেন৷ জার্মানিতে কম খরচে উচ্চমানের শিক্ষা পাওয়া যায়৷ তবে জার্মানির উদ্দেশ্যে বিমানে চড়ার আগে শিক্ষার্থীদের কিছু বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন৷ পড়ে নিন সেগুলো৷
ছবি: DW
টিউশন ফি নেই, তবে
জার্মানির ১৬টি রাজ্যের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো টিউশন ফি নেই৷ এটা সত্য৷ তবে এক্ষেত্রে শর্ত প্রযোজ্য৷ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সুনির্দিষ্ট ডিগ্রি প্রোগ্রামে আবেদন করলে বিনা খরচায় পড়ার সুযোগ আছে৷ সেক্ষেত্রে স্থানীয়রা যেসব শর্ত মনে লেখাপড়া করে, বিদেশিদেরও সেগুলো মানতে হবে৷ ‘স্টাডি এবরোড’ প্রোগ্রাম এবং প্রাইভেট ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা ফ্রি নয়৷
ছবি: Fotolia/Janina Dierks
বেশি কাজের মানসিকতায় লাগাম টানুন
একজন বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ালেখার ফাঁকে আপনি কতটা কাজ করতে পারবেন, সেটা নির্ধারণ করে দেয়া থাকে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-র কোনো দেশের পাসপোর্টধারী নয়, এমন শিক্ষার্থীরা বছরে ১২০ দিন পূর্ণদিবস কিংবা ২৪০ দিন অর্ধদিবস কাজ করতে পারেন৷ এছাড়া সেমিস্টার চলাকালে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ করা যাবে না৷ ভালো কথা, গোপনে বাড়তি কাজের চেষ্টা করবেন না৷ ধরা পড়লে বড় সমস্যা হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/MNStudio
যথাযথভাবে অনুদানের আবেদন করুন
আশার কথা হচ্ছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন অনুদান এবং ফেলোশিপের ব্যবস্থা রয়েছে জার্মানিতে৷ আপনার বিষয় যাই হোক না কেন, আপনি যদি তাতে মেধাবী হন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য পরিশ্রমে আগ্রহী হন, তাহলে অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারেন৷ ‘জার্মান অ্যাকাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস’ বা ডিএএডি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে থাকে৷ তবে অনুদানের আবেদন প্রফেশনালদের মতো হওয়া চাই৷
ছবি: DW
ভিসা জটিলতা
উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে জার্মানিতে পড়তে আসার ভিসা পাওয়া একটু জটিল৷ তাঁদের বেশকিছুদিন সময় হাতে রেখে ভিসার আবেদন করতে হয়৷ আর জার্মানিতে আসার পর মাঝেমাঝেই যেতে হয় ‘আউসলান্ডারবেহ্যোর্ডে’ বা বিদেশিদের জন্য নির্ধারিত সরকারি কার্যালয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সব কিছুর কপি রাখুন
জার্মানিতে আসার পর আপনি নিয়মিতই বিভিন্ন চিঠি পাবেন৷ এমনকি কবে কবে বাড়ির সামনে কোন কোন ধরনের ময়লা রাখা যাবে, সেটাও জানবেন চিঠির মাধ্যমে৷ বুদ্ধিমানের কাজ হবে সব চিঠি জমা করে রাখা৷ তবে প্রয়োজন অনুযায়ী উত্তর দিতে ভুল করবেন না যেন৷ জার্মানিতে বসবাসের এক বিরক্তিকর দিক হচ্ছে দেশটির জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া৷ সেই প্রক্রিয়ার অংশ এ সব চিঠি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জার্মান বলতে পারলে অনেক সুবিধা
এটাও সত্য, জার্মানির বড় শহরগুলোতে জার্মান না জেনেও বসবাস করা য়ায়৷ এছাড়া বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ইংরেজিতে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে৷ তবে কিছুটা জার্মান ভাষা শিখতে পারলে দেশটিতে জীবনযাপন অনেক সহজ হয়ে যাবে৷ আর আপনি যদি পড়ালেখা শেষে জার্মানিতে চাকুরি করতে চান, তাহলে ভাষা জানাটা অনেক জরুরী৷ এক্ষেত্রে ডয়চে ভেলের জার্মান ভাষা শিক্ষা কোর্স আপনাকে সহায়তা করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিজেকে নিজেরই সহায়তা করতে হবে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাইভেট কলেজগুলো ব্যয়বহুল হলেও শিক্ষার্থীদের অনেক খেয়াল রাখেন৷ শিক্ষার্থী কোনো ক্লাস ক্রমাগত মিস করে গেলে তাকে তা জানানো হয়৷ ক্যাম্পাসে কখন, কোন প্রোগ্রাম হচ্ছে তাও সুনির্দিষ্টবাবে শিক্ষার্থীদের জানাতে উদ্যোগ আছে৷ জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম৷ কখন, কোথায় কেন ক্লাস হচ্ছে কিংবা কোন প্রোগ্রাম চলছে তার খোঁজ রাখার দায়িত্ব আপনার৷
ছবি: DW
জার্মানদের সঙ্গে থাকুন
জার্মানির বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করে থাকে৷ তবে তাদের সেবা নেয়া বাধ্যতামূলক নয়৷ অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেছে দেয়া অ্যাপার্টমেন্ট শিক্ষার্থীর পছন্দ হয় না৷ আশার কথা হচ্ছে, অনেক ওয়েবসাইট রয়েছে যেগুলো থেকে থাকার জায়গা বেছে নেয়া যায়৷ কাজটা কঠিন৷ তবে চেষ্টা করবেন এমন জায়গায় থাকার যেখানে জার্মান শিক্ষার্থীরা থাকেন৷ তখন ভাষা শেখাটা আপনার জন্য সহজ হবে৷
ছবি: Fotolia
আপনি একা নন
শিক্ষার্থী হিসেবে জার্মানিতে বসবাস শুরুর দিকে অনেক কঠিন মনে হতে পারে৷ মনে হতে পারে আপনি একাই বুঝি এত পরিশ্রম করছেন৷ তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আপনার আগেও অনেক আপনার মতোই পরিশ্রম করে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন৷ তাই নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করতে শিখুন৷ এ জন্য বিভিন্ন অনলাইন ফোরামের সহায়তা নিতে পারেন৷
ছবি: Fotolia/Amir Kaljikovic
থাকবেন, নাকি চলে যাবেন?
শুরুর দিকে জার্মানিতে বসবাস কঠিন মনে হলেও দেশটি ক্রমশ আপনার ভালো লাগতে শুরু করতে পারে৷ অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে৷ ডিগ্রি, চাকুরি আর নিরাপদ জীবন - এসব বিবেচনা করে আপনি হয়ত একসময় জার্মানিতে থেকে যেতে চাইবেন৷ কিংবা থাকবেন নাকি চলে যাবেন সেই দ্বিধায় পড়ে যাবেন৷ সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আপনার, আমরা শুধু আপনাকে আগেভাবে জানিয়ে রাখলাম৷