সাগরে নতুন জীবন নয়ত মৃত্যুর অপেক্ষায় ৮ হাজার মানুষ৷ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি মানুষগুলোর মধ্যে শুক্রবার ৭৫৯ জন প্রাণ বাঁচিয়ে ইন্দোনেশিয়া পৌঁছেছেন৷ অসহায় মানুষদের নিয়ে ‘পিংপং খেলা' বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডাব্লিউ৷
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অনুমান, এই মুহূর্তে অন্তত ৮ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি সাগরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছেন৷ তাঁদের বেশিরভাগই বৌদ্ধপ্রধান দেশ মিয়ানমার ছাড়তে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গা মুসলমান৷ বাকিরা হতদরিদ্র বাংলাদেশি৷ মানবপাচারকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে সবাই এখন মহাসংকটে৷ জীবন বাঁচানো দায়৷ শুক্রবার কোনোরকমে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশের লাংসা শহর সংলগ্ন তীরে নৌযান ভিড়িয়ে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছেন ৭৫৯ জন মানুষ৷
আচে প্রদেশের পুলিশ জানিয়েছে, ৭১২ জন যাত্রীবাহী একটি নৌযান মালয়েশিয়ায় গিয়েছিল৷ কিন্তু মালয়েশিয়ার নৌ-বাহিনী তাঁদের তাড়িয়ে দেয়৷ তাড়া খেয়ে নৌযানটি ইন্দোনেশিয়ার দিকে অগ্রসর হয়৷ এক পর্যায়ে নৌযানটি ডুবে যাওয়া উপক্রম হয়েছিল৷ তখনই পাশ দিয়ে যাচ্ছিল ইন্দোনেশীয় জেলেদের কয়েকটি নৌকা৷ তাঁদের সহায়তায় যাত্রীবোঝাই নৌযানটি অবশেষে তীরে ভেড়ে৷
শুক্রবার ৪৭ জন যাত্রী নিয়ে আরেকটি নৌকাও ভিড়েছে আচে প্রদেশে৷ প্রাণ বাঁচাতে তাঁরাও ইন্দোনেশীয় জেলেদেরই সহায়তা চেয়েছিলেন৷ জেলেরাই তাঁদের বাঁচিয়েছেন৷
থাইল্যান্ডের কোহ লিপে দ্বীপে বাধা পেয়ে ৩০০ যাত্রীবাহী আরেকটি নৌযান মালয়েশিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা গেছে৷ নৌযানটি থাইল্যান্ডের জলসীমায় প্রবেশ করছিল৷ থাই নৌ-বাহিনীর সদস্যরা বাধা দেয়৷ কয়েক সপ্তাহ ধরে না খেতে পাওয়া যাত্রীরা তখন কেঁদে কেঁদে আশ্রয় না দিলে অন্তত কিছু খাবার দেয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করে৷ শুকনো খাবার দেয়া হয় তাঁদের৷ নৌকায় করে খবর সংগ্রহ করতে এগিয়ে আসা সাংবাদিকদের যাত্রীরা জানিয়েছেন, ক্ষুধা এবং রোগযন্ত্রণায় তাঁদের মধ্যে ১০ জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন৷ তাঁদের শঙ্কা, অচিরেই নিরাপদ আশ্রয়, চিকিৎসা এবং পর্যাপ্ত খাবার না পেলে ধীরে ধীরে বাকিরাও মরবেন৷
রোহিঙ্গাদের ‘যুদ্ধের’ যেন শেষ নেই
ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ অনেক বাংলাদেশিও আছেন তাঁদের মাঝে৷ থাইল্যান্ডে গিয়ে কবরেও ঠাঁই হয়েছে অনেকের! আজকের ছবিঘরটি তাঁদের নিয়েই৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আটকে পড়া
গত ১০ মে চারটি নৌযানে করে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে প্রবেশ করে ৬০০ রোহিঙ্গা৷ একই সময়ে লাংকাওইতে প্রবেশ করে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা৷ সমুদ্র থেকে স্থলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁদের ঘিরে ফেলে৷ ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছাড়া মানুষগুলো এখনো মুক্ত নয়৷
ছবি: Reuters/R. Bintang
ক্লান্ত
মানবপাচারকারীরা তাঁদের ছেড়ে যাওয়াতে সমুদ্রবক্ষে বিপদেই পড়েছিলেন রোহিঙ্গারা৷ আনুমানিক সপ্তাহ খানেক সমুদ্রপথে ঘুরে অবশেষে ভীষণ ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত অবস্থায় তাঁরা ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছান৷ দীর্ঘ অর্ধাহার, অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে৷ তাঁদের চিকিৎসা চলছে৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা
প্রতিবছর এভাবেই মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে শত শত রোহিঙ্গা৷ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কিছু বাংলাদেশিও থাকেন সব সময়৷ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী তোলায় অনেক নৌযান ডুবে যায় সাগরে, সলিলসমাধি হয় অনেকের৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম তিন মাসে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছেন অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি৷
ছবি: Asiapics
ওদের কোনো দেশ নেই!
বৌদ্ধপ্রধান দেশ মিয়ানমারে ৮ লক্ষের মতো রোহিঙ্গা মুসলমানের বাস৷ তবে সংখ্যাটা দ্রুতই কমছে৷ বৌদ্ধদের সঙ্গে দাঙ্গার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই৷ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করে না৷ তাদের মতে, রোহিঙ্গারা ‘বাংলাদেশি অভিবাসী’৷ আবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে ঐতিহাসিক কারণেই তাঁদের মিয়ানমার থেকে আগত বহিরাগতের মর্যাদা দেয় বাংলাদেশ৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আধুনিক দাস-বাণিজ্য
মানবপাচারকারীদের কাছে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ ছাড়া রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিরা যেন ক্রীতদাস৷ মাত্র ২০০ ডলারের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নৌযানে তুললেও যাত্রীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়৷ খেতে না দেয়া, ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করা, শারীরিক নির্যাতন – বলতে গেলে সব ধরণের অত্যাচারই চলে তাঁদের ওপর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Yulinnas
থাইল্যান্ড নিয়ে আতঙ্ক
রোহিঙ্গারা থাইল্যান্ডেও যান৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, ২০১২ সালে আড়াই লাখ মানুষ অবৈধভাবে থাইল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন৷ অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য থাইল্যান্ড অবশ্য একেবারেই নিরাপদ ঠিকানা নয়৷ মানবপাচারকারীরা সে দেশে নিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করে৷ মুক্তিপণ না দিলে মেরেও ফেলা হয়৷ সম্প্রতি মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে বেশ কিছু গণকবরের সন্ধান পেয়েছে থাই সরকার৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
পরিত্যক্ত
থাইল্যান্ড সরকারের অভিযান শুরুর পর অনেক রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিকে গভীর জঙ্গলে ফেলে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়৷ মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এ পর্যন্ত অন্তত শ’ খানেক অভিবাসন প্রত্যাশীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে থাই কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: AFP/Getty Images/Str
7 ছবি1 | 7
এদিকে মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সাগরে আটক শত শত রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশির প্রতি থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া সরকারের আচরণের কঠোর সমালোচনা করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই তিন দেশের উদ্দেশ্যে মানবাধিকার সংস্থাটির আহ্বান, ‘‘মানুষ নিয়ে পিংপং খেলা বন্ধ করুন৷'' জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন দেশ তিনটির প্রতি সীমান্ত খোলা রেখে অসহায় মানুষগুলোকে বাঁচাতে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান, ‘‘সাগরে আটকে পড়া জীবনগুলো বাঁচান৷''
রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে ঘণীভূত সংকট নিরসনের জন্য আঞ্চলিক পর্যায়ে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে থাইল্যান্ড৷ আগামী ২৯শে মে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অংশগ্রহণে একটি সম্মেলন হওয়ার কথা৷ কিন্তু মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের পরিচালক বলেছেন, ‘‘তারা (থাইল্যান্ড) যদি নিজেদের ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে, সেই আমন্ত্রণ আমরা গ্রহণ করবো না৷''